ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি মাস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব শহীদ ও ভাষা সৈনিকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্কে’র মাসিক ৯৯ তম আসর। পুরো অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন। চকবাজারের দুর্ঘটনায় নিহত সবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই কবি শহীদ কাদরীর ‘একেই বলতে পারো একুশের কবিতা’ আবৃত্তি করে শুনান কবি পত্নী নীরা কাদরী। আরও যাঁরা আবৃত্তি করেন তাঁরা হলেন, গোলাম মোস্তফা, পারভীন সুলতানা, শুক্লা রায়, লুবনা কাইজার, এজাজ আলম ও সেলিম ইব্রাহীম।
অমর একুশে বইমেলা ২০১৯ এর নতুন বই পরিচিতি পর্বে অংশ নেন আবু সাঈদ রতন, খালেদ সরফুদ্দীন, আহম্মদ হোসেন বাবু, বেনজির শিকদার, সালেহীন সাজু ও পলি শাহীনা।
আবু সাঈদ রতন তাঁর নতুন বই ‘অদ্ভুত যত ভূত’ সম্পর্কে বলেন, সাতটি ভূতের গল্প নিয়ে রচিত এটি একটি শিশুতোষ ছড়ার বই। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা বইটি প্রকাশ করেছেন সাহিত্য বিকাশ।
খালেদ সরফুদ্দীনের অষ্টম বই ‘খাস কথা’ সম্পর্কে তিনি বলেন, যে কথাগুলো সহজে বলা যায় না সে কথাগুলোকে তিনি এই বইতে সহজভাবে বলেছেন।
আহম্মেদ হোসেন বাবুর দুটো কাব্য গ্রন্থ ‘দেখা হয় যদি ও নির্ভীক নোঙর’ এসেছে এবারের বইমেলায়। বই দুটো সম্পর্কে তিনি বলেন, ছোটবেলার যে বন্ধুরা জীবন থেকে চলে গেছে তাঁদের স্মরণ করেন তিনি কবিতায়। এ ছাড়া তাঁর কবিতায় প্রেম, দ্রোহ, বিরহ, সামাজিক বৈকল্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এসেছে।
‘অনুভূতির মিছিলে ভালোবাসার জীবাশ্ম’ কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা বেনজির শিকদার বলেন, মনের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করেছি কবিতায়। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ এবং প্রকাশিত হয়েছে কাশবন প্রকাশন থেকে।
১০০ টি কবিতা নিয়ে পাঁচ ফর্মার বই ‘দখিনের জানালা’ সালেহীন সাজুর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। মুক্তিযুদ্ধ, প্রবাস, প্রকৃতি, প্রেম, দ্রোহ বিষয়গুলো উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। ধ্রুব এষের প্রচ্ছদে বইটি বের হয়েছে অন্বয় প্রকাশ থেকে।
পলি শাহীনার নতুন বই ‘হৃৎকথন’ সম্পর্কে তিনি বলেন, জীবনকে ঘিরে কিছু মূল্যবান সময়, অনুভূতি, ভাবনা, বোধ উঠে এসেছে বইটিতে।
এবারের আসরে যাঁরা আলোচনায় অংশ নেন তাঁরা হলেন, হাসান ফেরদৌস, মো. ফজলুর রহমান, তমিজ উদদীন লোদী, রাণু ফেরদৌস ও হুসনে আরা।
ভাষার মাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক হাসান ফেরদৌস বলেন, একুশ নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রবলভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। ১৯৭৪ সালে রাশিয়ায় তাঁর একুশ উদ্যাপনের স্মৃতি আসরে উপস্থিত সবার সঙ্গে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, বরফের ভেতর ফুল না পেয়ে মধ্য রাতে কাগজের ফুল দিয়েছিলাম শহীদ মিনারে। তখন মনে ছিল গভীর আবেগ। এখন কেন যেন সে আবেগে ঘাটতি দেখি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, টিভিতে কিছু টকশো দেখি যেখানে শুদ্ধ ভাষা পাওয়া যায় না। বিষয়টি দুঃখজনক। লোক দেখানো কৃত্রিম বিষয়গুলোকে ভাঙতে হবে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ঘরে বাংলায় কথা বলতে হবে। তাঁদের বুকের ভেতরে বাংলা মূল্যবোধ ঢুকিয়ে দিতে হবে, তাঁরা যেন বড় হলে শেকড়ের কাছে ফিরে যায় ভাষার হাত ধরে।
সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মো. ফজলুর রহমান বলেন, একুশ শোকের মাস নয়, একুশ এখন আমাদের কাছে উদ্যাপনের মাস। তবে এবারের একুশ উদ্যাপনে চকবাজারের দুর্ঘটনায় আমরা শোকাহত। তিনি আরও বলেন, বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পাওয়ায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা বেড়ে গেছে। একসময় বাংলা সাহিত্যের চর্চা কলকাতায় হতো। এখন বাংলাদেশে সাহিত্য চর্চা প্রধান হয়ে গেছে। প্রবাসী বাঙালি লেখকদের অনেক নতুন বই এসেছে এবার যা আনন্দের। সাহিত্য একাডেমি প্রবাসী লেখকদের নিয়মিত অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন।
কবি তমিজ উদদীন লোদী বলেন, পৃথিবীর সব ভাষা-ভাষী মানুষ নিজের ভাষাকে আত্মস্থ করে, ভালোবাসে। এখন প্রশ্ন ভাষা কীভাবে এল? বিজ্ঞানীরা বলছেন, অনেক সময় নিয়ে ভাষা এসেছে। এলিয়েন, নারীর মনের মতো রহস্যময় বিষয়গুলোর চেয়েও ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, ভাষা হলো সবচেয়ে বড় রহস্য! কোনটা আসলে আদি ভাষা? অষ্টাদশ শতাব্দীতে আদি ভাষার উৎস খুঁজতে গিয়ে বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ভাষা বিজ্ঞানীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ভাষা সংস্থা আয়োজন করে ভাষার আদি খোঁজার বিষয়টা বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘদিন পরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাঁরা আবার আদি ভাষার সন্ধান শুরু করে। এখানে বিজ্ঞানীরা নানান ভাষার কথা বলেছেন। ল্যাটিনো ভাষাকে তাঁরা পুরোনো ভাষা বলেছেন। উল্লেখ্য, স্পেনীয়রা ল্যাটিনো ভাষা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষা এসেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাটা হলো পুরোনো ভাষা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এতেও স্থির হয়নি। তাঁরা বলছেন, ইউরোপীয় টা হলো তারও আগের ভাষা। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে যখন তাঁরা দিশা পেলেন না তখন জীব বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে দেখলেন, ভাষা যেহেতু বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ যেখানে প্রথম উদ্ভব হয়েছে সেখান থেকে শুরু। মানুষের উদ্ভব হয়েছে প্রথম আফ্রিকা থেকে। তাই ভাষাটাও প্রথম শুরু হয়েছে সেখান থেকে। তিনি আরও বলেন, প্রকৃতির দিকে যখন তাকাই নানান বৈচিত্র্য দেখতে পাই। তাদেরও হয়তো নিজস্ব একটা ভাষা রয়েছে। এই যে গাছে গাছে কি কথা হয়? পাখিরা কি কথা বলে? কীট পতঙ্গগুলো কি কথা বলে? তাদের ভাষা আমরা বুঝি না কিন্তু আমরা তা লিপিবদ্ধ করি আমাদের বর্ণমালায়। অনেক ভাষার বর্ণমালা নেই। আমাদের ভাষায় বর্ণমালা রয়েছে। যেমন স্প্যানিশ ভাষায় অনেক সমৃদ্ধ সাহিত্য আছে কিন্তু তাদের বর্ণমালা নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পেয়েছেন। ওনার মতো করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারা শংকর, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, আখতারাজ্জুমান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক উনাদেরকেও যদি যথাযথ ভাবে উপস্থাপন করা যেত হয়তো আমরা আরেকটা নোবেল পেয়ে যেতাম। বিশ্ব সাহিত্য ঘাটলেও দেখা যায়, আমাদের এমন অনেক সমৃদ্ধ সাহিত্য লুকিয়ে আছে অন্তরালে যা আমরা অনুসন্ধান করতে পারিনি। এখানে পথের পাঁচালির কথা উল্লেখ করতে পারি।
আদি ভাষা আসলে কি তা এখনো অনাবিষ্কৃত। অনুমান করা হচ্ছে আফ্রিকার ভাষাই আদি ভাষা। যদিও বিজ্ঞানীরাও এখনো একমত হতে পারেননি যে এটাই আদি ভাষা কিনা? আমাদের বাংলা ভাষা দীর্ঘকাল
থেকে ছিল না। হাসান আজিজুল হক বলেছেন,
‘ভাষার ভেতরে একটা নীরব দানব আছে।’ সমস্ত পৃথিবীর এত ভাষা যুক্ত হচ্ছে ভাষার সঙ্গে যা সম্পূর্ণ নতুন ভাষা হবে। ৫০০ বছর পর বাংলা একাডেমি হয়তো নতুন অভিধান বানাতে হবে। অনেক বোদ্ধা বলেন আমাদের বাংলা ভাষা টিকবে কিনা? আমি আশাবাদী বাংলা ভাষা টিকে থাকবে। কারণ, এই ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া হয়েছে।
রাণু ফেরদৌস বলেন, ভাষা শহীদদের নিয়ে, একুশ নিয়ে আমরা অনেক অনুষ্ঠান করি ঠিকই কিন্তু আমরা ব্যক্তিগত ভাবে একক পর্যায়ে কিছু করতে কি পারি? এটি আমাদের চেষ্টা করা উচিত। তিনি নিউইয়র্কে ইউনেসকোর পরিচালিত তাঁর সন্তানের স্কুলের একটি ঘটনার কথা বর্ণনা করে বলেন, স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলে ওই স্কুলে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি বিশেষ মর্যাদায় উদ্যাপনের ব্যবস্থা করেন। বাংলা ভাষার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরও কিছু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কুইন্সের একটি লাইব্রেরিতে বাংলা কবিতা পড়ার অনুষ্ঠানও করেন।
অধ্যাপিকা হুসনে আরা বলেন, একুশ মানে মাথা নত না করা। মাথা নত না করার অর্থ ব্যাপক। ভাষার সঙ্গে বিষয়কেও ধারণ করতে হবে। পরামর্শ না দিয়ে নিজেদের অন্তরে ধারণ করতে হবে, অন্যের কাছে দৃষ্টান্ত হতে হবে। কথা ও কাজে এক হতে হবে। অন্যকে আপ্লুত না করে ভাষাকে বুকে ধারণ করতে হবে। পরস্পরের সহিত আন্তরিকতার সঙ্গে হাতে হাত ধরে এগিয়ে যেতে হবে।
নিউইয়র্কে বাঙালির কণ্ঠস্বরকে আরও বেশি শক্তিশালী করার জন্য হেলাল শেখ পাবলিক অ্যাডভোকেট পদে তাঁকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার জন্য আসরে উপস্থিত সকলের কাছে আবেদন জানান।
এবারের আসরে যাঁরা কবিতা, ছড়া পাঠ করেন তাঁরা হলেন, কাজী আতীক, তাহমিনা খান, জেবুন্নেসা জ্যোৎস্না, শাম্মী আক্তার, দলিলুর রহমান, উইলি মুক্তি, নিলুফার রেজা, মিশুক সেলিম, লিয়াকত আলী, কামরুন্নাহার রীতা, সবিতা দাস, সীমু আফরোজা, আরিফা রহমান, স্বপ্ন কুমার, রুপা খানম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে আরও যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হলেন, পপি কুলসুম, রাহাত কাজী শিউলি, ফরিদা ইয়াসমিন, শামস আল মমীন, রাশা, রাজীব আহসান, মারীষ্টেলা শ্যামলী, রেজাউল হক, মমতাজ বেগম সুমী, সেলিনা আক্তার, মাসুম, শুভ্রা রায়, শাহ যে চৌধুরী, মিথুন কামাল প্রমুখ।
মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ যদি সৃষ্টি না হতো তাহলে আজ আমরা নিউইয়র্কে সাহিত্য একাডেমির এই অনুষ্ঠানটি করতে পারতাম না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাদ দিয়ে আমরা সম্পূর্ণ নই। সর্বসম্মতিক্রমে তাই আমরা আমাদের আগামী মাসের ১০০ তম আসরটি বাংলাদেশের স্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করব।
সবাইকে শততম পর্বের আমন্ত্রণ ও ধন্যবাদ জানিয়ে আসরের সমাপ্তি টানেন পরিচালক মোশাররফ হোসেন।