নিজের মনেই ভালোবাসুন
সইফা ছিলেন যেমন সুন্দরী, তেমন মেধাবী। গায়ের রং দুধে-হলুদে বলা যায়। একহারা গড়ন। জন্মেছেন বনেদি পরিবারে। বাবা হামিদ ভক্ত চৌধুরী ব্রিটিশ আমলের জমিদার। উনি হামদু মিয়া নামেই পরিচিত ছিলেন। মেয়ের বিয়ে হাতি-ঘোড়া সাজিয়ে দিলেও, সে বিয়ে টিকেনি বেশি দিন। মেয়ের বাড়ি থেকে দুঃসংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিজের সাদা ঘোড়ায় চেপে বসেন। নিজে গিয়ে কিছুটা জোর করেই মেয়েকে পালকিতে উঠতে বাধ্য করেন। সইফা বাবার চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন, পাগল স্বামীর ঘর করতে তাঁর আপত্তি নেই। তাঁর বর এক কথায় সুপুরুষ। ব্রিটিশ আমলের হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষিতের মধ্যে তিনি একজন। থানার দারোগা ছিলেন; সইফাও তাঁকে দারোগা বলেই ডাকতেন। শৈশব পেরোতে না পেরোতেই যাকে সাথি করে পেয়েছেন, তাঁকে ছাড়তে তিনি একেবারেই প্রস্তুত নন। কিন্তু জমিদার বাবার আদেশ অমান্য করারও সাহস ছিল না তাঁর। তাই চোখের পানি মুছতে মুছতে চল্লিশ দিন বয়সের ছেলেকে নিয়ে উঠেছিলেন পালকিতে। যেখানে ভালোবাসার কমতি ছিল না, সেখানে হঠাৎ করেই যেন বিষাদ নেমে আসে। কিন্তু ওই মানুষটাকে তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি।
সইফার বর ভালোই ছিলেন। সেই দারোগা এক ভোর রাতে শ্রীহট্ট থানা থেকে একা পথে ঢাকার দক্ষিণের শীলঘাটে নিজ বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। পথে হঠাৎ তিনি চেতনা হারান। বাড়ির কাছেই। আশপাশের মানুষেরা ধরাধরি করে তাঁকে ঘরে নিয়ে এল। চেতনা ফিরল। কিন্তু ফিরল না তাঁর স্বাভাবিক মনোজগৎ। তিনি নিজের মনোজগতেই থাকলেন। একা একা পরিদের সঙ্গে কথা বলেন। পরিদের জন্য থালায় ফুল সাজিয়ে সূর্যোদয় হলে, ঘরের বাইরে এসে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন সূর্যের দিকে তাকিয়ে। এভাবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাকিয়ে থাকতেন। সবাই বলত ‘পরির আছর’। আস্তে আস্তে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। আশফাক চৌধুরীর পরিচিতি দারোগা থেকে ‘পাগলে’ বদলে যেতে সময় লাগেনি। সেই পাগল একদিন স্ত্রীকে ঘুমন্ত রেখে নবজাতক ছেলেকে বিছানা থেকে উঠিয়ে পাহাড়ি টিলার কেয়া বনে রেখে আসেন। সইফা ঘুম থেকে উঠে বিছানায় ছেলেকে না দেখে কান্না জুড়ে দেন। এ সময় এক কৃষক বাড়িতে এসে জানান যে, পাগলকে কিছু একটা নিয়ে টিলায় উঠতে দেখেছেন তিনি। বাচ্চার কান্নাও শুনেছেন তিনি। সে সব এলাকায় বাঘ-শিয়ালের চলাচল ছিল নিয়মিত। ফলে শিশু সন্তানকে নিয়ে সবাই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে। অবশেষে খোঁজাখুঁজি করে বাচ্চাকে পাওয়া গেল সুস্থ অবস্থায়। এ ঘটনা শোনার পর হামদু মিয়া মেয়েকে পাগলের সংসারে থাকার সম্মতি দিতে পারেননি। বাবা অনেকটা জোর করেই সইফাকে তালাক দিতে বাধ্য করেন।
সইফার পরপর দুবার বিয়ে হলেও কখনোই তিনি দীর্ঘ দিন স্বামীর ঘর করতে পারেননি। তবে তাঁর মুখে কখনোই কেউ দ্বিতীয় স্বামীর নাম শোনেনি। যদিও দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে উনি এক কন্যা সন্তানের মা হয়েছিলেন। মেয়ের জন্মের মাত্র নয় দিনের দিন দ্বিতীয় স্বামী মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর ধারণা হয়েছিল যে, তাঁর ওপর কোনো অভিশাপ রয়েছে; তাই তাঁর বিবাহিত জীবন সুখের নয়। তাঁর মতে, দশ-এগারো বছর বয়সে মিলনরত দুটো গোখরো সাপকে বাঁশের লম্বা গর্ছি (নাগরী) দিয়ে মারতে মারতে মেরে ফেলেছিলেন তিনি। এ থেকেই তিনি অভিশপ্ত হয়েছেন বলে ধারণা জন্মায় তাঁর।
প্রথম বরকে কখনোই ভুলতে পারেননি সইফা। জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত মনে রেখেছেন। সে মনে রাখার তরিকা একটু আলাদা। সেটা যে তিনি কাউকে কখনো বলেছেন, তা কিন্তু নয়। একটা পিতলের চায়ের চামচ তাঁর পানদানিতে সব সময় থাকত। রাতে ঘুমানোর সময় বালিশের নিচে ঠিক কলমের মতো রেখে দিতেন ওই চামচ। যদি কখনো কেউ সরাতো বা নিজে কোথাও রেখে ভুলে যেতেন, তবে চিৎকার দিয়ে সবাইকে তটস্থ করে ফেলতেন। ‘এই আমার দারোগার হাতের চামচ কে নিল? আমার দারোগার হাতের চামচ কই?’ এটা শুধু একটা চামচ ছিল না তাঁর কাছে, ছিল ভালোবাসার নিদর্শন। দারোগার উপহার দেওয়া এই চামচকে তিনি অবলম্বন করেছিলেন।
সামাজিক প্রথায় তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হলেও তাঁর প্রেম ছিল একমাত্র প্রথম স্বামীর জন্য। তাঁর দ্বিতীয় বরও ছিলেন সুদর্শন, ছিলেন বনেদি জমিদার। কিন্তু তাঁর যিকর তিনি কখনোই করেননি। কারণ তাঁর মন ছিল পুরোপুরি অন্য একজনের প্রেমে ভরপুর। সে মানুষটিকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন স্মৃতিতে।
মানুষ নিজের মনে যাকে গ্রহণ করে, যার জন্য হৃদয়ে একটা মিষ্টি অনুভূতি বোধ করে; তাই ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষ কাছে আছে নাকি দূরে, তা এখানে কোনো ব্যবধান সৃষ্টি করে না। এই মনের মানুষের সঙ্গে যখন দৈহিক ও মানসিকভাবে সংযোগ তৈরি হয়, তখন তারা একাকার হয়ে যায়। আর ভালোবাসার ব্যক্তির কাছ থেকে সাড়া না পেলে নিজের মনেই আবার কষ্ট পায় মানুষ। ভালোবাসার মূলমন্ত্রটি মূলত নিজের কাছে। একজন মানুষের প্রতি আপনি কি অনুভব করছেন, তা-ই সব নির্ধারণ করে দেয়। সে যেই হোক! একজন মা যে চোখে সন্তানকে দেখছেন, সন্তান হয়তো তা অনুভবও করতে পারছে না। কিন্তু তাতে মায়ের ভালোবাসায় টান পড়ে না। মা দিয়ে চলেন বিনিময়হীন ভালোবাসা। এ রকম ভালোবাসা বন্ধু, আত্মীয়স্বজন অনেকের জন্যই থাকে। অর্থাৎ ভালোবাসার আসল চাবিটা নিজের কাছেই থাকে।
ভালোবাসার ক্ষেত্রে বাধা এলে তাই সেগুলোকে ইতিবাচকভাবে নেওয়াই ভালো। প্রকৃতিও কখনো কখনো আমাদের বঞ্চিত করে। সইফার উদাহরণটি বিশ্লেষণ করলে এই প্রকৃতি বিরুদ্ধতারই প্রমাণ মেলে। মাত্র কিছুদিন আগে আমার বোনের মেয়ে মারা গেল, যার বর আমেরিকায় এলে তাদের সংসার পুরোদমে শুরুর কথা ছিল। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর থেকে তার জীবনে ঝড় বয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে কী বলা যেতে পারে। তাই কাউকে পাওয়া না পাওয়ার মাঝে ভালোবাসা সীমাবদ্ধ নয়। মানুষের মন রহস্যে ঘেরা। সেখানে জায়গা করে নেওয়া যেমন যোগ্যতা, ঠিক তেমনি সেখানে থাকাটাও একটা যোগ্যতা। মানুষের মনে জায়গা করার পর তা চিরস্থায়ী অধিকারে থাকবে এমন নয়। নিজের করা আচরণের জন্যই মানুষ ওই জায়গাটি হারায়। ফলে এ জন্য প্রতিশোধপরায়ণ হওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়। ভালোবাসার জন্য মরে যাওয়া বা প্রতিশোধ নেওয়া—এগুলো মানসিক রোগ। এসবের সঙ্গে ভালোবাসার নাম জুড়ে দেওয়াটা ভালোবাসা বোধটিরই অপমান।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দেহ একটা মাধ্যম মাত্র। ভালোবাসার ক্ষেত্রে দেহ অনেক সময় কোনো মানে রাখে না; মনটাই আসল। একজন মানুষ মন থেকে যখন তার ভালোবাসার মানুষকে গ্রহণ করে, তখন শরীর আপনাআপনিই চলে আসে। মন ও শরীরের মিলনের মধ্য দিয়েই ভালোবাসা পূর্ণাঙ্গ হয়। সে লক্ষ্য থাকবে; কিন্তু তা একমাত্র লক্ষ্য না হওয়াই উচিত। নিজের মনে ভালোবেসে যাওয়াটাই হচ্ছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।
এ রকম নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পাওয়া মানুষের সংখ্যাও খুব কম। তবে এটাও সত্য যে, ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাকে যত্ন করতে হয়। যত্নের প্রথম কথা হচ্ছে যোগাযোগ। অনেক সময় আবার যোগাযোগও যত্নের কাজটি করে না ঠিকমতো। দেখা যায় যোগাযোগ হচ্ছে, কিন্তু সম্পর্কগুলো টিকছে না। হয়তো অহমটাই বড় হয়ে যায়। যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ মাত্রই একটা পরিবর্তনশীল মন, কখনোই যা শতভাগ নির্ভুল নয়। তাই অনেক সময় মানুষটিকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে তার দোষগুলোকেও আপন করে নিতে হয়। কারণ আরেকজন শতভাগ নির্ভুল মানুষ যে পাওয়া যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। মনের মানুষের ভুলগুলোও গ্রহণ করা উচিত। আর মন না চাইলে ভালোবাসার ক্ষেত্রে জোর করাটা বোকামি। জোর করে সম্পর্ক তৈরি বা অধিকার আদায় করা গেলেও ভালোবাসা যায় না।
বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রেমিকদের জন্য এটুকুই আমার কথা। কেউ আপনার গোলাপ ফুল গ্রহণ করে তো ভালো; দুজনে একাকার হয়ে যান। আর না করলেও ক্ষতি নেই। গোলাপটাকে যত্ন করুন। একদিন না একদিন আপনার ভালোবাসা আসবেই। অন্য কোনো রূপে, অন্য কোনো ভাবে; তাকে চেনাটাও যোগ্যতা।