প্রবাস পথিক: ভাষা মানে শুশ্রূষা
নিউইয়র্কে বাংলা ভাষার ভালো একটি অবস্থান গড়ে উঠছে। পরিবেশ পরিস্থিতিই বাংলাকে তার অবস্থান তৈরি করে দিচ্ছে। সবচেয়ে আশান্বিত হতে হয় এখানকার বড় বড় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে। এখানে রোগীদের জন্য সব ধরনের বার্তা বাংলায় পরিবেশনের ব্যবস্থা রয়েছে। হাসপাতালের নিয়ম-নীতি ও বিধি যেমন বাংলায় সুস্পষ্ট জানানো হচ্ছে, একইভাবে রোগীর বিবরণীও বাংলায় গ্রহণ করা হয়। বোঝা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানে রীতিমতো বাংলা বিভাগ রয়েছে। সেখানে বাংলার সার্বক্ষণিক চর্চা ও ব্যবহার রয়েছে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়েছে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের এলমহার্স্ট হাসপাতালে গিয়ে। সেখানে বাংলাভাষীদের মন ভালো হওয়ার মতো অনেক সুযোগ রয়েছে। হাসপাতালে প্রবেশের সময় কাচের দরজায় সাঁটানো কাগজে বেশ কিছু ভাষায় ‘স্বাগতম’ লেখা চোখে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই নিজস্ব ভাষার এই আহ্বান দেখে বুক জুড়িয়ে যায়। অভ্যর্থনা বিভাগে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মাঝে জ্বলজ্বল করে বাঙালির মুখ। সেখানে বাংলা ভাষায় সালাম ও কুশল বিনিময়ের সুব্যবস্থা রয়েছে। অভ্যর্থনাতেই জানতে চাওয়া হয়, পুরো চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমটিতে বাংলা ভাষায় চাই কি-না। উত্তর হ্যাঁ বলা হলে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য রয়েছে ভাষা সহায়তার সব রকম ব্যবস্থা। ভাষাগত দূরত্বে দুর্ভোগে পড়ার কোনো আশঙ্কা আর নেই। প্রবাসে যেকোনো পরিবেশ থেকে আসা যেকোনো বয়সী বাঙালিই নিতে পারছেন এই সেবা। এর জন্য তাঁকে আবেদনও করতে হচ্ছে না। একইভাবে সেবিকা কিংবা চিকিৎসকের কক্ষে যাওয়ার পরও প্রথম জিজ্ঞাসাটিই হচ্ছে ভাষা সহায়তা নিয়ে। হ্যাঁসূচক জবাব পেলেই সেখান থেকে মুক্ত শব্দের ফোন চলে যাবে একজন বাঙালি দোভাষীর কাছে। তারপর রোগী ও চিকিৎসকের কথোপকথনের মাঝে পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ অনুবাদের কাজটি করে যাবেন দোভাষী। রোগী নিজের দেশের মতোই নিজের সমস্যাগুলো। এই আয়োজনগুলো শুধু সুন্দর নয়, বলা ভালো পরিকল্পিত ও কার্যকর।
আমি একজন বাঙালি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বললাম বিষয়টি নিয়ে। তিনি বলতে চাইলেন, এগুলো বাণিজ্যিক প্রয়োজনে করা হয়েছে। তাঁর কথা মেনে নিলেও এই উদ্যোগগুলোর অনন্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে না। আমি একজন নতুন মানুষ হিসেবে বাইরে থেকে দেখি বাংলা ভাষার জয়। আরেকজন বাঙালি ডাক্তারের সঙ্গে কথা হলো। তিনি অন্য প্রদেশে থাকেন, বললেন, নিউইয়র্কের অনেকগুলো সৌন্দর্যের এটিও একটি। এখানে সবগুলো হাসপাতালেই ভাষা সহায়তার এই ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি অবশ্য অকপটে বললেন, ভাষার সঙ্গে বাণিজ্যের সম্পর্ক তো থাকবেই। মনের ভাব প্রকাশের জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় নিয়ামক ভাষার সৃষ্টিই তো মানুষের নির্বিঘ্ন লেনদেনের সুবিধার জন্য। তার মানে, শুধু বাণিজ্যিক বিবেচনা করে এই উদ্যোগকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
এ প্রসঙ্গে একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই। চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাই গিয়েছি। সেখানে একটি বহুজাতিক কোম্পানির ক্লিনিকে গিয়ে দেখলাম তিনটি ভাষার ব্যবহার। ইংরেজি, হিন্দি ও তামিল। কিছুটা হতাশ হয়েও কাজ সারতে হলো ইংরেজিতে। অবাক হলাম, সেখানে কিছু বাঙালিও কাজ করেন। বাংলাদেশ থেকে অনেক রোগীও সেখানে গিয়েছেন। কিন্তু সেখানে বাংলা ভাষার কোনো ব্যবহার নেই। ক্লিনিকের প্যাথলজি বিভাগের সব কর্মীই পশ্চিমবঙ্গের। কিন্তু কেউই সেখানে বাংলা বলেন না। বলেন, হিন্দি ও ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে। আমি বাংলায় মুখ খুলতে বাধ্য হলাম। বললাম, ‘আপনারা নিজের ভাষাটিকে কেন উপেক্ষা করছেন?’ তাঁদের কাছে আমার এই প্রস্তাব খুবই অমূলক ও সেকেলে মনে হলো। জানাল, এটি একটি বহুজাতিক হাসপাতাল। এখানে বাংলাভাষা ব্যবহার করা মানে নিজেকেই খাটো করা। ও ভাষার চল এখানে নেই। বললাম, ‘রোগীরা কি করবে? সব রোগী কি আপনাদের ইংরেজি হিন্দি আর তামিল বুঝবে?’ তাঁরা আমার সঙ্গে আর আলোচনা দীর্ঘ করার আগ্রহ দেখালেন না। বোঝা গেল, তাঁরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে খাটো করে দেখতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। অথচ আমেরিকায় এসে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নজির দেখে যারপরনাই আশান্বিত হই।
বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গেই আলোচনা করেছি। অনেকেই জানিয়েছেন, নিউইয়র্কের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোর হাসপাতালে এই ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু বাংলা ভাষা অনুসরণ ও সহায়তা করার জন্যই সেখানে রীতিমতো জনবল নিযুক্ত রয়েছে। যদিও তাদের ভাষা দক্ষতা খুব বেশি উন্নত নয়। তারপরও রোগী সেবার প্রয়োজনটুকু মেটানো সম্ভব হচ্ছে। ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে হাসপাতাল, প্যাথলজি কিংবা যেকোনো কেন্দ্রে বাংলা ভাষার অবস্থান অনেক ওপরে। লোকবসতির সংখ্যাও যদি বিবেচনা করা হয়, তারপরও এই অবস্থান দেখে গর্বিত হতে হয়। ইংরেজির পরে স্প্যানিশ, তারপরেই বাংলা। যেকোনো নির্দেশনা ও ঘোষণা স্প্যানিশ ভাষার পাশাপাশি বাংলায় লেখা। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এখানে ব্যবহার করা হয় বাংলা ইউনিকোড অক্ষর। বোঝা যায়, কম্পিউটারের ইংরেজি বোতাম ব্যবস্থায় লেখা হওয়ায় কিছু ভুল থেকে যাচ্ছে। তাতে কি? বাংলা তো আছে!
দীর্ঘকাল মার্কিন জাহাজে নাবিকের সহযোগী ছিলেন নিপু ভাই। এখন অবসরজীবন। জ্যাকসন হাইটসের বাঙালি সমাজে ঘুরে বেড়ান দেশে থাকার আনন্দ নিয়ে। তাঁর সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ভাষা মানুষের অন্যতম এক শুশ্রূষা। বিদেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ভাষায় কথা বলার সুযোগ অনেক বড় এক পাওয়া। এই সুবিধা পেয়ে একজন সেবাপ্রার্থী অথবা রোগী অনেকটাই সুস্থবোধ করেন। শুধু তাই নয়, হাসপাতালগুলোতে মানসিক শক্তি বাড়ানোর জন্য ধর্মীয় বাণী শোনারও ব্যবস্থা রয়েছে। আমেরিকানরা বিশ্বাস করে, ওষুধ রোগ সারানোর জন্য ওষুধ একমাত্র উপায় নয়। রোগীর মানসিক শক্তি বাড়াতে পারলে ওষুধ কিংবা পথ্য তার শরীরে ঠিকমতো কাজ করে। বিষয়গুলো হয়তো চিকিৎসা বিজ্ঞানের পূর্বশর্তের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু এই সত্যে পুরোপুরি বিশ্বাস ও অনুশীলনটিই বড় কথা। এই যুক্তিতেই ভাষাটি এখানে মানসিক শক্তির প্রথম শর্ত হিসেবে কাজ করে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাস ফেব্রুয়ারি চলছে। মাতৃভাষার গুরুত্ব দিনে দিনে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নতুন করে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। বাংলা ভাষাই যে মাতৃভাষার প্রশ্নে সবচেয়ে গর্বিত ও উজ্জ্বল তাও দিনে দিনে মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। তবে এই বিবেচনা সামনে রেখে দেখতে ইচ্ছে করে প্রবাসী বাঙালি নতুন প্রজন্মের ভাষা-সংস্কৃতি। তারা উচ্চাকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে ইংরেজির মধ্যে যে অপরিহার্যতা নিয়ে প্রবেশ করছে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার মধ্যে তার কাছাকাছি স্পৃহা নিয়েও প্রবেশ করতে চাইছে না। অথচ প্রবাসী সন্তানেরও মায়ের ভাষা বাংলা, পূর্বপুরুষের ভাষা বাংলা। বাংলা ভাষা দিনে দিনে আন্তর্জাতিকতায় বহু উচ্চে উঠবে, তখন প্রবাসী নতুন প্রজন্মকে তাদের অজ্ঞতার জন্য বড় আফসোস করতে হবে।