রাশিয়া তদন্তের কেন্দ্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের যোগসাজশ রয়েছে—এই অভিযোগ নিয়ে ১৮ মাস ধরে বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট মুলার তদন্ত করে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বা তাঁর ক্যাম্পেইন এই আঁতাতে সরাসরি যুক্ত কি না, এত দিন সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। বৃহস্পতিবার এ প্রশ্নের আংশিক উত্তর মিলেছে।
এদিন সকালে ট্রাম্পের সাবেক ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেন, যাঁর অন্য নাম ‘ট্রাম্পের ফিক্সার’ বা তাঁর সব অপকর্মের বাহক, ম্যানহাটনের একটি ফেডারেল আদালতে আত্মসমর্পণ করে জানালেন, ট্রাম্পের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক বিষয়ে এত দিন মিথ্যা বলেছেন। শুধু বিশেষ কৌঁসুলি নয়, কংগ্রেসের কাছেও লিখিতভাবে মিথ্যা বলেছেন। মস্কোতে একটি ট্রাম্প টাওয়ার নির্মাণের ব্যাপারে তিনি একটি রুশ ব্যাংক ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ট্রাম্পের নির্দেশেই এই যোগাযোগ। ইতিপূর্বে তিনি জানিয়েছিলেন ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের পর এ নিয়ে তিনি মস্কোর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করেননি। কোহেন জানিয়েছেন, কথাটা মিথ্যা, আসলে ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত মস্কোতে এই হোটেল নির্মাণের ব্যাপারে তিনি কথাবার্তা চালিয়ে যান। এর এক মাস আগে, অর্থাৎ জুন মাসে, রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হন।
রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসেবে বাছাইপর্বে প্রচারণার সময় ট্রাম্প বরাবর দাবি করে এসেছেন, মস্কোর সঙ্গে তাঁর কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। জুলাই ২০১৬ সালে যখন কোহেন তাঁর হয়ে মস্কোর ট্রাম্প টাওয়ারের জন্য একটি রুশ ব্যাংক থেকে মোটা ঋণের ব্যাপারে কথাবার্তা চালাচ্ছেন, সে সময়ও ট্রাম্প স্পষ্টভাবে জানান, রাশিয়ায় তাঁর কোনো বিনিয়োগে নেই। ‘রাশিয়ার সঙ্গে আমার কোনো রকম লেনাদেনা নেই।’ পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরে, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প পুনরায় বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে কোনো ‘ডিল’ তিনি করছেন না।
রবার্ট মুলার আদালতের কাছে যে নথি পেশ করেছেন তাতে স্পষ্ট, মস্কো হোটেলের ব্যাপারে ট্রাম্পের প্রতিনিধি হিসেবে কোহেন ক্রেমলিনের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি পুতিনের প্রেস সেক্রেটারি দিমিত্রি পেশকভের সঙ্গে এ নিয়ে টেলিফোনে কথা বলেন। এই আলাপচারিতা সে বছর জুন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এটা সম্ভবত কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে সেই জুন মাসেই নিউইয়র্কের ট্রাম্প টাওয়ারে ক্রেমলিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন রুশ আইনজীবীর সঙ্গে হিলারি ক্লিনটনের ব্যাপারে ক্ষতিকর নথি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ট্রাম্প জুনিয়র ও ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের শীর্ষ পরামর্শদাতারা বৈঠকে মিলিত হন।
কোহেনের আত্মসমর্পণের কথা প্রকাশিত হওয়ার পর ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের জানান, মস্কোতে তিনি একটি হোটেল বানানোর চেষ্টা করছেন—এ কোনো গোপন কথা নয়। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন শুরু হওয়ার পরেও তিনি সে চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কারণ তিনি নির্বাচনে জিতবেন এমন কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। ফলে ব্যবসায়িক সুযোগ যাতে হাতছাড়া না হয়, সে জন্য তিনি এ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখেন। তবে এ নিয়ে কথা খুব একটা অগ্রসর হয়নি।
ক্যাম্পেইনের কোনো পর্যায়েই ট্রাম্প মস্কো টাওয়ারের ব্যাপারে কোনো কথা জানাননি। ২০১৭ সালের জানুয়ারির আগে পর্যন্ত এ ব্যাপারে পত্রপত্রিকায়ও কোনো কথা ওঠেনি।
এদিকে বোমা ফাটানোর মতো একটি খবর দিয়েছে ওয়েবসাইট বাজফিড। বিচার বিভাগীয় সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে তারা জানিয়েছে, মস্কোর হোটেল প্রকল্পে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে রুশ প্রেসিডেন্টকে এই টাওয়ারের সর্বোচ্চ তলায় ৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি অ্যাপার্টমেন্ট উপহার হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। মাইকেল কোহেন ২০১৬ সালের জুনে দিমিত্রি পেশকভের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় এই প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবের বিষয়ে ট্রাম্প নিজে কতটুকু জানতেন তা স্পষ্ট নয়, তবে কোহেন আদালতকে জানিয়েছেন, তিনি এই হোটেল প্রকল্প বিষয়ে সব তথ্য ট্রাম্পকে যথাসময়ে জানাতেন।
কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প কেন পুতিনের ব্যাপারে এতটা নম্র ছিলেন, মস্কো টাওয়ারের ঘটনা থেকে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। প্রেসিডেন্ট তিনি হবেন না, কিন্তু এই ক্যাম্পেইন শেষে যাতে মস্কোর সঙ্গে ‘ডিল’টি অক্ষত থাকে, তিনি সেই রণকৌশল অনুসরণ করে থাকবেন। ট্রাম্পের সমর্থক হিসেবে পরিচিত বিখ্যাত আইনজ্ঞ এলেন ডারশভিৎস বলেছেন, ট্রাম্প কাজটি ঠিক করেননি এ কথা ঠিক, সে জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া যায়। কিন্তু তাই বলে অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে, তা মনে হয় না।
নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের সময় আমেরিকার ‘শত্রু’ হিসেবে পরিচিত একটি বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা বেআইনি কি না, সে ব্যাপারে আইন বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এক মত নন। তবে এই প্রশ্নে ট্রাম্প মার্কিন জনগণের কাছে মিথ্যা বলেছেন, এ ব্যাপারে তাঁদের কোনো সন্দেহ নেই। গত সপ্তাহে ট্রাম্প মুলারের কাছে লিখিতভাবে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। সেখানেও যদি তিনি একই মিথ্যা বলে থাকেন, তাহলে বড় ধরনের ঝামেলায় পড়ে যেতে পারেন। আগামী জানুয়ারি থেকে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ভার চলে যাচ্ছে বিরোধী ডেমোক্র্যাটদের হাতে। তাঁরা যে এ ব্যাপারটি নিয়ে নিজস্ব তদন্ত শুরু করবে—তা একদম নিশ্চিত।