বিলকিস আক্তার পেশায় একজন সেবিকা। আমার কর্মস্থলের পাশেই একটা ক্লিনিকে সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় কফি শপে। নিউইয়র্ক নগরের মাল্টি-কালচার সোসাইটিতে পোশাক পরিধানের ব্যাপারে বিশেষ কোনো নিয়ম নেই। যে যার খুশি মত রুচিশীল পোশাক পরেন। যে যার ইচ্ছামতো যেকোনো পোশাক পরলেও এশিয়ান, চাইনিজ, স্প্যানিশ, আফ্রিকান—এই মানুষগুলো সহজে একে অন্যকে চিনে ফেলে। পোশাক যেমনই হোক, স্বজাতিকে চেনা যায়।
সকালে কফি কেনার জন্য একই সারিতে অপেক্ষারত অবস্থায় পরিপাটি ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরিহিত স্বজাতি বিলকিসকে চিনতে আমার বিন্দু পরিমাণ বেগ পেতে হয়নি। আমিই প্রথম কথা বলি। বিলকিসও প্রথম সাক্ষাতেই আমার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলেন। কাছে টেনে নেয়। সেদিন থেকেই আমাদের ঘনিষ্ঠতা শুরু। লাঞ্চ ব্রেকে বিলকিস আমার কাজের জায়গায় ছুটে আসে। কখনো জুস হাতে, কখনোবা কফি হাতে। মিষ্টিভাষী বিলকিস আর আমি জমিয়ে গল্প করি। গল্পের বেশির ভাগ জুড়ে থাকে ফেলে আসা দেশ, পরিবার, স্বজন, গান, কবিতা, সংসার ইত্যাদি। আমাদের কাজের মাঝের অবসরটুকু কাটতো হাসি, আনন্দ আর প্রাণচাঞ্চল্যে। নির্দিষ্ট সময় শেষে বুক পকেটে সুখস্মৃতি নিয়ে বিলকিস আর আমি যে যার কাজের জায়গায় ফিরে যেতাম। অপেক্ষায় থাকতাম দুজনেই পরের দিনের আনন্দ–আড্ডার জন্য।
নিউইয়র্ক নগরে এবার কিছুটা আগেভাগেই বেশ শীত জেঁকে বসেছে। সকালের ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে কাজে গেলেও মন কেমন নেতিয়ে আছে। কফি হাতে উষ্ণতা নিয়ে বিলকিস কখন আসবে, সে অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছি। দূর থেকে বিলকিসকে আসতে দেখে আমার মন ময়ূরের মত নেচে উঠল। ঝিম ধরা সকাল, শীত শীত অনুভূতি কেটে যাবে এখুনি। কিন্তু কাছে আসতেই বিলকিসের শুকনো মনমরা মুখটা আমার কাছে স্পষ্ট হলো। অন্যদিনের মত আজ ওকে প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে না। অনেকটা নীরবে আমার সঙ্গে বসে তাঁর হাতের কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন চলে যাওয়ার জন্য। আমি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কি আজ শরীর খারাপ? বরফ শীতল গলায় উত্তর দিল, ‘শরীর ঠিক আছে। মন খারাপ।’
–কী হয়েছে জানতে চাইলাম, উত্তরে জানাল কাজের জায়গায় সহকর্মীর সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে তিনি তাঁকে রিফিউজি (শরণার্থী) বলেছেন। যদিও এ জন্য পরে সেই সহকর্মী তাঁকে ‘সরি’ বলেছে, তবুও কোনো কিছুতেই মন ভালো হচ্ছে না। বিলকিসের কথা শুনে মনে পড়ে যায় আমার নিজের কথা। আমি নিজেও এই ভর্ৎসনার শিকার হয়েছি আমার দোকানে কর্মরত এক আমেরিকানের কাছ থেকে। দোকানে সময়মতো না আসা এবং আসার পরেও কাজের প্রতি মনোযোগ না দেওয়ায় দু–একটা কথা বলার পরে তিনি রেগে আমাকে ‘রিফিউজি’ বলেছিলেন। সেদিন ওই আমেরিকান লোকটাও আমাকে ‘সরি’ বলেছিল। অনেক বছর আগের বুকের ক্ষতটা আজ যেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথাও অনুভূত হচ্ছে। আমরা দুজন চুপ হয়ে আছি। কারও মুখে কোনো কথা নেই।
নীরবতা ভেঙে বিলকিস বলতে শুরু করেন, ‘বাবা–মায়ের খুব আদরের সন্তান ছিলাম। সবাই যখন রিকশায় চড়ে স্কুলে যেত, আমি তখন ভাইদের সঙ্গে বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতাম। ভাই, কাজিনদের সঙ্গে ফুটবল, মার্বেল, ব্যাডমিন্টন খেলতাম। দাবা প্রতিযোগিতায় মফস্বল থেকে জেলা শহরে গিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। স্কুল, কলেজে নিজ হাতে লাগানো কাঠ গাছগুলো অনেক বড় হয়েছে, পথচারীদের ছায়া দেয়। ঝড়, বৃষ্টির মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশ ও দেশের মানুষদের রক্ষা করে। গত বছর দেশে গিয়ে গাছের গায়ে সাদা রং দিয়ে আমার নাম লিখে এসেছি। পুতুল খেলায় ঘরের কোণে আমার মন বসতো না। বড় ভাই বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর আমারও ইচ্ছে ছিল, পড়াশোনা শেষে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করব। দেশকে ভালোবেসে দেশেই থাকব। কিন্তু তা আর হল না। বাবা, মায়ের ইচ্ছেতেই বিয়ে হয়ে যায়, নিউইয়র্কে চলে আসি। এ দেশে এসে অনেক বছর আমার দেশের সবুজ পাসপোর্ট বহন করেছিলাম। দেশে ফিরে যাব বলে আমেরিকার নাগরিকত্ব পর্যন্ত নেই নিইনি।’
বিলকিস বলেন, ‘আট বছর পর দেশে ফিরে অনুভূতিগুলো চেনা মনে হলেও দৃশ্যগুলোকে অচেনা মনে হলো। আমার নিজের পরিবারেই দেখলাম ভালো ফলাফল পেয়ে পড়াশোনা শেষ করে ভাইবোনেরা সার্টিফিকেট নিয়ে বসে আছে চাকরির আশায়। চাকরি পাচ্ছে না। বয়সে ওরা আমার ছোট। ওদের চোখে স্বপ্ন জ্বলজ্বল করছে। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু স্বপ্ন পূরণের জায়গা খুবই সীমিত। দেশে যাওয়ার কয়েক দিন পরেই সবাই জিজ্ঞেস করা শুরু করেছে, আমি কবে নিউইয়র্কে ফিরে যাব? মামাতো ভাই খুব অনুনয় করে বলল, তার সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) পরীক্ষার জন্য আমি যেন তাঁকে পাঁচ লাখ টাকা ধার হিসেবে দিই। জানতে পারলাম, পাঁচ লাখ টাকা উপঢৌকন হিসেবে দিলে তার এসআই পদে চাকরিটা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমার মাথা ঘুরতে লাগল। চারপাশে সব শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়ে এবং তাদের বাবা–মায়ের করুণ চাহনি আমার হৃদয়ে এসে আঘাত করতে লাগল। নিশ্চুপ আমি কয়েক দিন পরেই নিউইয়র্কে ফিরে আসি। নিউইয়র্কে কাজ করে আমার জীবনধারণের সুযোগ আছে, দেশে ওদেরতো সে সুযোগ খুব কম। সেবার দেশ থেকে এসেই আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করি। কাজে মনোযোগ দিই। দিনরাত পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাই। আমার পাঠানো টাকায় মামাতো ভাইয়ের চাকরি হয় বাংলাদেশে। ফুপাতো বোন পড়াশোনা শেষ করে এখন স্কুলে শিক্ষকতা করে। নিউইয়র্ক থেকে আয় করে পাঠানো আমার টাকায় পড়াশোনা শেষ করে ফুপাতো বোনটা দেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এখন জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু আমার আর দেশে ফিরে যাওয়া হলো না। এ দেশেই রয়ে গেলাম রিফিউজি হয়ে।’
কথা শেষে দীর্ঘশ্বাস টেনে বিলকিস চলে গেল তাঁর কাজের জায়গায়। ঘড়ির কাঁটা কারও সুখ-দুঃখের হিসাব কষে চলে না, কোনো কারণে কখনোই থেমে থাকে না। সময় বয়ে চলে সামনের দিকে তার নিজস্ব গতিতে। দুপুরের সূর্য খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। আজ আমি কোনোভাবেই কাজে মন বসাতে পারছি না। মনে পড়ছে ডাক্তার শীলা জাহানের কথা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু থাকতে পারেননি। ভুল বোঝাবুঝির জের ধরে রোগীর আত্মীয়-স্বজন তাঁর বন্ধুর ক্লিনিক ভাঙচুর এবং বন্ধুর ওপর চড়াও হতে দেখে শীলা জাহান তাজ্জব হয়ে যান। আইন যে যার মত করে হাতে তুলে নেয়। কে দোষী বা কে নির্দোষ সে ফয়সালা প্রশাসন করবে। প্রশাসনের তোয়াক্কা না করে যে যার ইচ্ছামতো আইনের প্রয়োগ করতে দেখে কিছুদিন দেশে থেকে হতাশ হয়ে নিউইয়র্কেই ফিরে আসেন। কেন-ই বা ফিরে আসবেন না? প্রতিটি মানুষ নিরাপদ, নিশ্চিন্ত, সুন্দর একটি জীবন চায়। যাদের সে সুযোগ আছে, তারা তো সে সুযোগ গ্রহণ করবেই। বিলকিসের মত ডাক্তার শীলা আপাও একদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন এ দেশে তাঁর শেকড় প্রোথিত হওয়ার গল্প।
খুব করে আজ মনে পড়ছে এমন আরও অনেক দেশান্তরী মানুষের গল্প। বিদেশে থাকা বেশির ভাগ মানুষের বুকে একটা নীরব বেদনার সাগর রয়েছে। যে সাগরের প্রতিটি ঢেউ খুব নীরবে বয়ে বেড়ায় ফেলে আসা দেশ, পরিবার, স্বজন, বন্ধু, আপনজনদের গল্পগাথা।
আমার প্রতিবেশী সুরভি আপা দেশের ওকালতি পেশা ছেড়ে, তাঁর স্বামীর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা গুটিয়ে নিউইয়র্কে এসে এখন দুই সন্তান নিয়ে কোনোমতে একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকেন। গল্পচ্ছলে একদিন জানতে পারলাম, দেশে বিশেষ করে ইংলিশ মিডিয়ার কিন্ডারগার্টেনে বাচ্চাদের ভর্তি করাতে নাকি লাখ লাখ টাকা লাগে। এই টাকা দিয়েও নিস্তার নেই। প্রতি মাসেই কোনো না কোনো ফি দিতে হয় হাজার হাজার টাকা। এভাবে হাঁপিয়ে ওঠে একদিন নিউইয়র্কে আসার সুযোগ মিলে যায়। ভিজিট ভিসায় এসে এখন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমে এখানে শান্তিতে জীবনযাপন করছেন। ছেলে, মেয়ে দুজন ভালো স্কুলে পড়ে।
রাস্তায় আসা-যাওয়ার পথে প্রায় দেখা হয় রফিক মামার সঙ্গে। বাড়ি, জমি, দোকানসহ দেশে তাঁর কত টাকার সম্পত্তি আছে, তিনি নিজেও জানেন না। জীবনের ঝলমলে সময়টা কাটিয়েছিলেন ডলার কামাই করে আর সম্পত্তি কিনে। ভেবেছিলেন ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে দেশে ফিরে যাবেন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখন দেশে ফিরে যাওয়ার মত শারীরিক অবস্থা নেই রফিক মামার। ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাই কোলেস্টেরলে ভুগছেন। দেশে সবকিছু থাকলেও শরীরের এ অবস্থা নিয়ে আজ দেশে ফিরতে পারছেন না।
মুখগুলো একের পর এক মনে পড়ছে আর বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। মনের মেঘ যেন আরও গাঢ় হচ্ছে। দেশ ছেড়ে আসার আগে আমাকে বলা বাবার কথাগুলো কানের মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম....‘প্রতি বছর দেশে আসবি। পারলে ছয় মাস পর পর আসবি।’ অথচ বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে শত চেষ্টা করেও আমি দেশে যেতে পারিনি। শেষবারের মত বাবার মুখটা দেখতে পারিনি। বাবার কবর হয়ে গেছে শুনে খোলা আকাশের নিচে মাঝ রাতের বোবা অন্ধকারকে চিৎকার করে নিজের বুকের অসীম যন্ত্রণার কথা বলেছি, ‘আমেরিকায় আসা যতটা কঠিন, ফিরে যাওয়া তার চেয়েও কঠিন।’