গিয়েছিলাম লন্ডনের বিখ্যাত লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে একটা সেমিনারে। লেডিস লাইব্রেরি (সবার জন্য উন্মুক্ত)। বসে বসে ভাবছিলাম, আর পান করছিলাম আমার প্রিয় কাপ্পুচিনো। পরিচিত হলাম আমার পাশের টেবিলে বসা কয়জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে, তাঁদের মুখে শুদ্ধ কুইন্স ইংলিশের ফুলঝুরি। শুনে বা দেখে বিন্দুমাত্রও বোঝার উপায় নেই, এরা বাংলাদেশি। অনেকক্ষণ কথোপকথনের পর একজনকে প্রসঙ্গক্রমে জিজ্ঞেস করলাম, হওয়ার আর ইউ ফ্রম? বলল, ‘আমার বাড়ি বাংলাদেশ। সিলেট, বড়লেখার লাতুতে …।’ কী যে এক আনন্দ পেলাম শুনে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
বললাম, ছোট বেলায় আমি এক সময় অল্প কয়েক মাস লাতু প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি। ২১ বছর বয়সী লাবনী আহমেদ এলএসইতে ইকোনমিকসে শেষ বছরের ছাত্রী। আর সঙ্গে আরও তিন বন্ধু। সবাই বাঙালি। চুটিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করলাম ওদের সঙ্গে। ক্ষণিকের জন্য ফিরে গেলাম আমার ফেলে আসা তারুণ্যের সময়টাতে। কথা প্রসঙ্গে জানলাম ওদের সবার গল্প। কৃতিত্ব ও ওদের অদম্য আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনা। আনন্দে আর উল্লাসে মনটা ভরে গেল। প্রায় ৬০-৭০ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়ছে ওদের শিক্ষালয়ে। ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। কোথা থেকে কোথায় পদার্পণ করেছে, আমাদের সম্প্রদায় বিলেতে!
বাংলাদেশি অভিবাসীদের সন্তানেরা সারা গ্রেট ব্রিটেনের এক উৎকৃষ্ট জনগোষ্ঠী হিসেবে ক্রমান্বয়ে আবির্ভূত হচ্ছে মৃদু পায়ে। একসময় ব্রিটিশ সমাজের সব সামাজিক জরিপের সিঁড়ির নিম্ন স্তরে অবস্থানকারী এ সম্প্রদায় সব সামাজিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের ভুল প্রমাণিত করে এগিয়ে যাচ্ছে বীরদর্পে। যেন ওদের মনের বাসনাটাই ছিল
দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর ও পারাপার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার!
আশি কিংবা নব্বই দশকের মাথাব্যথা আজ মাথার মুকুট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে । ব্রিটিশ গণমাধ্যমে আজ বাঙালিদের জয়গান। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ব্রিটেনে ৬ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছে। তারা এক লাখ বিশ হাজারের মতো পরিবার। আর আজ বিলাতের ওই ১২০, ০০০ পরিবারে আছে কম করে হলেও ১২o,০০০ গ্র্যাজুয়েট। অনেক পরিবারে রয়েছে একের অধিক গ্র্যাজুয়েট।
আজ বিলাতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা উড়িয়ে দিয়েছে এক বিজয় কেতন। বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন বিভিন্ন জরিপে উপাত্তের নিম্নমুখী জায়গাটা দখল করত আমাদের সম্প্রদায়। আর আজ এরাই পড়ছে অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, এলএসই, কিংস কলেজের মতো বিশ্ব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়ছে ইঞ্জিনিয়ারিং, পদার্থ বিজ্ঞান, মেডিসিন, ন্যানো টেকনোলজি, নিউরো সায়েন্স, ইংলিশ লিটারেচারসহ সব বিষয়ে। সমানভাবে পড়াশোনা করে এগিয়ে যাচ্ছে বীর বাঙালির সন্তানেরা। অতি সন্তর্পণে লালন করে যাচ্ছে বাঙালির ঐতিহ্য। দেশপ্রেম ও সামাজিক অনুশাসনে অনুপ্রাণিত এ প্রজন্মকে দেখে আনন্দে মনটা সেদিন ভরে গিয়েছিল।
ঘরে ফিরে ভাবলাম- আসলেই আমার উচিত এই উৎকর্ষ নিয়ে কিছু গবেষণা করব। আর যদি সময় পাই, তাহলে লিখব কয়েকটা লাইন। আশ্চর্য হয়ে গেলাম গবেষণার উপাত্তগুলো দেখে।
বাঙালি মেয়েরা আজ ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছে। নারীর ক্ষমতায়নের এক বিশাল মাইলফলক। লন্ডনে শতকরা ৭২ জন বাঙালি বসবাস করে। লন্ডনের স্কুলগুলোর অন্যতম প্রধান দ্বিতীয় ভাষা বাংলা। ৬২ শতাংশ বাঙালি শিক্ষার্থী কম করে হলেও পাঁচটা জিসিএসসি নিয়ে পাস করে আসছে। কোনো কোনো সময় প্রতিশোধও যে এত মধুর হয় তা আমার জানা ছিল না। এর মিষ্টতা খুঁজে পেলাম, যখন পড়লাম বাংলাদেশিরা এগিয়ে আছে পাকিস্তানি সম্প্রদায় থেকে। ৯১ শতাংশ বাংলাদেশি নিজেদের ব্রিটিশ মনে করে। অন্য কোনো অভিবাসী সম্প্রদায় নিজেদের এতটা ব্রিটিশ মনে করে না।
আজ আমাদের সম্প্রদায়ের সন্তানেরা চাকরি করছে দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে, হাউস অব কমন্সে, হাউস অব লর্ডসে, ব্রিটিশ আর্মিতে, বিশ্ব বিখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা এমআই ফাইভে, এম আই সিক্সে, লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে। তাঁরা কাজ করছে মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ডের লেনদেন হওয়া সব মার্চেন্ট ব্যাংকে। এমন কোনো সংস্থা নেই যেখানে আমাদের পদচারণা নেই।
একসময় যাদের কেউ কেউ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি (বটমলেস বাস্কেট)’ বলেছিল, আর আজ ওই সম্প্রদায়ের সন্তানেরা বাস্কেট ভরে ভরে অর্থ উপার্জন করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিতে ও ব্যবসায় রাখছে উল্লেখযোগ্য অবদান।
আমি এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং নিজেও ছিলাম এক বালক মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতালের সেবক ছিলাম ১৯৭১ সালের সেই দিনগুলোতে। স্বপ্নেও ভাবিনি এমন সুন্দর দিন দেখাবে আমাদের সন্তানেরা। লেখতে গিয়ে চক্ষু দ্বয় আনন্দ অশ্রুতে সিক্তপ্রায়।
কবি তো তাই লিখেছিলেন আজ থেকে প্রায় ৯৭ বছর আগে
‘বল বীর-
বল উন্নত মম শির’
লেখক ইংল্যান্ডে বসবাসকারী
লেখক, পাবলিক স্পিকার ও
কমিউনিটি নেতা।