কাছ থেকে দেখা টরন্টো সিটি নির্বাচন ২০১৮
গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হলো টরন্টো সিটি কাউন্সিলের নির্বাচন। জন টোরি দ্বিতীয়বারের মতো টরন্টোর মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা স্কারবোরো সাউথওয়েস্ট থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন গ্যারি ক্রফোর্ড। জন, গ্যারিসহ অন্যান্য যারা কাউন্সিলর ও ট্রাস্টি নির্বাচিত হয়েছেন- সবার প্রতি রইল আন্তরিক অভিনন্দন। নতুন কাউন্সিল একুশ শতকের টরন্টো গড়ার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে—এটাই প্রত্যাশা।
এই নির্বাচনে একজন কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলাম। পরে প্রাদেশিক সরকারের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ার্ডের সীমানা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। এ অবস্থায় আরেক প্রার্থী মহসিন ভূঁইয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসে তাঁর প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে কমিউনিটির স্বার্থে একক একজন বাংলাদেশি প্রার্থী করার লক্ষ্যে আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াই। কিন্তু একক প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে আমাদের ফল খুব একটা ভালো হয়নি। এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। সংবাদপত্র ও ফেসবুকে অনেকে লেখালেখি করছেন। গত ছয় মাসের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা থেকে সাবেক একজন প্রার্থী হিসেবে এই আলোচনায় আমিও কয়েকটি কথা যোগ করতে চাই।
কাউন্সিলর নির্বাচন এমপি ও এমপিপি নির্বাচন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে দলীয় কোনো ভোট ব্যাংক থাকে না; ফেডারেল বা প্রাদেশিক নির্বাচনের মতো এত ডোনারও থাকে না। নিজেকে তুলে ধরা ও তহবিল সংগ্রহ প্রার্থীকেই করতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের পকেট থেকে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। নিজেকে তৈরি করতে একজন প্রার্থীকে তাই মূলধারার বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে হয়। বিভিন্ন সামাজিক ও এলাকাভিত্তিক ইস্যুতে সোচ্চার থেকে, বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে একজন প্রার্থীর উচিত নিজের পরিচিতি বাড়ানো এবং একটি শক্তিশালী টিম গঠন করে নিজের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভোটারের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
এবারের নির্বাচনে আমাদের প্রার্থী মোট ভোটের ১০ শতাংশ পেয়েছেন। ২০১৪ সালের সিটি নির্বাচনে ৩১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক প্রার্থী ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। আর ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তিনজন দাঁড়িয়ে মোট ভোটের ১১ শতাংশ পেয়েছিলেন। নির্বাচনে জিততে হলে মোট ভোটের ৩৫-৪০ শতাংশ পেতে হয়, যার কাছাকাছিও যেতে পারছি না আমরা। ২০১৬ সালের শুমারি অনুযায়ী ২০ নম্বর ওয়ার্ডে বাংলাভাষীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের প্রার্থীরা বাংলাদেশি ভোটের বাইরে তেমন কিছু পাচ্ছেন না।
টরন্টো সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ শহর। এখানকার বহুত্ববাদী সমাজ নিয়ে আমরা গর্ব করি। একজন বাংলাদেশি-কানাডীয় হিসেবে নিজের শেকড় নিয়ে আমি গর্বিত। কিন্তু নির্বাচনে দাঁড়ালে আমি কখনোই চাই না যে শুধু বাংলাদেশি পরিচয়ের কারণেই মানুষ আমাকে ভোট দিক। আমরা বাংলাদেশি ও কানাডীয় দুটি সত্তাকে গুরুত্ব দিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চাই। এখানকার সচেতন ভোটারেরা প্রার্থীর যোগ্যতাকেই সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হিসেবে মনে করেন। ফলে একজন প্রার্থীর উচিত নিজের কমিউনিটির পাশাপাশি অন্য কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কানাডার মূলধারায় প্রবেশ করা।
মানুষের দরজায় গিয়ে ভোট চাওয়ার সময় আমার মনে হয়েছে এখানকার মানুষ ব্যক্তিগত সংযোগ খুব পছন্দ করে। তারা চায় প্রার্থী তাদের কাছে আসুক, তাদের কথা শুনুক ও নিজের লক্ষ্যগুলো তাদের সামনে তুলে ধরুক। র্যালি জাতীয় প্রচারণা এখানে খুব বেশি কাজে আসে না।
গণতন্ত্রে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা থাকাটা খুবই জরুরি। সব ভোটার আপনাকে ভোট দেবে না, ভোট চাইতে গেলে দরজা খুলবে না। এখানে বিরোধিতাটাকে ব্যক্তিগতভাবে না নিয়ে বিরুদ্ধমতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত। নির্বাচনী দল গঠন করাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রার্থীর কৌশলগত দলের আকার হওয়া উচিত খুবই ছোট। তুলনায় স্বেচ্ছাসেবক দল হওয়া উচিত বড়। আর মনে রাখা দরকার ভোটারেরা প্রার্থীকে দেখতে চায়, তার পরিকল্পনার কথা শুনতে চায়। সেই লক্ষ্যেই নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত।
আমাদের ওয়ার্ডের মূল ইস্যুগুলো হচ্ছে, ট্রানজিট সিস্টেম আধুনিকীকরণ, স্কারবোরোর সাবওয়ে, সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য আ্যাসিস্টেড লিভিং ফ্যাসিলিটির ব্যবস্থা করা, পর্যাপ্ত পরিমাণ ডে-কেয়ার, নতুন কর্মসংস্থান, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আ্যাফোর্ডেবল হাউজিংয়ের ব্যবস্থা করা, পর্যাপ্ত খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা। এই ইস্যুগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। মূলধারায় নিজেকে তুলে ধরতে হলে এমপি, এমপিপি ও কাউন্সিলরদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে প্রার্থী হিসেবে হাজির না হয়ে সামনের চার বছর যদি সত্যিকার অর্থে কেউ মানুষের জন্য কাজ করা যায়, তবে আমার বিশ্বাস ভোটারেরা তাকে খালি হাতে ফেরাবে না।
এটি ছিল আমার প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ। নির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে। অনেক মানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সমর্থন দিয়েছেন। নতুন কিছু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছি, দরজায় দরজায় যাওয়ার কারণে অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সবার নাম এখানে নেওয়া সম্ভব নয়। তাঁদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার কৌশলগত ও স্বেচ্ছাসেবক দলের জন্য কোনো ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়। এই দূর প্রবাসে তাদেরকেই আমি আত্মীয়-পরিজন হিসেবে মনে করি। বলতে দ্বিধা নেই নির্বাচনে দাঁড়িয়ে কিছু নেতিবাচক অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়েছে।
মহসিন ভাইকে আমি অভিনন্দন জানাই তাঁর সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়ার জন্য। আমাদের কমিউনিটি থেকে তোফাজ্জল ভাই ও মনোয়ার হোসেন মেয়র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। আশা করি তাঁদের বার্তাটা ভোটারদের কাছে পৌঁছেছে। ট্রাস্টি পদে দাঁড়িয়ে ফেরদৌস বারী ভাই কী পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন সেটা আমার নিজের চোখে দেখা। আমি আশা করব সামনের বার দাঁড়ালে তিনি নির্বাচিত হবেন। মহসিন ভাই একক প্রার্থী হওয়ার পর কমিউনিটির অনেক মানুষ নিঃস্বার্থভাবে তাঁর জন্য কাজ করেছিলেন; তাঁদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। কিছু মানুষ আছেন যারা নামের পরোয়া না করে শুধু কমিউনিটির স্বার্থে আড়াল থেকে কাজ করে যান, যাদের আমরা সব সময় মূল্যায়ন করতে পারি না। কিন্তু আমরা যদি এভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি, বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র।
লেখক: সমাজকর্মী ও ব্যবসায়ী