লিটন কোত্থেকে একটা ডাব হাতে মন্টুর কাছে এসে বসে। তারপর ডাবটাকে হাঁ করিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে বলে, ‘নে, এইডা দিয়াই আইজকা রাইতটা পার করতে হইব। সবজি না পচলে আমাগোর কী দুষ?’ মন্টু ওপর-নিচে মাথা নাড়ে। সত্যি তো, এই যে ঠান্ডা বাতাস, গরমের নামগন্ধ নেই, বৃষ্টি নেই, আর সে কারণে সবজির দোকানের আশপাশের বাতাসে তাজা সবজির গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসছে, তা কি তাদের দোষ? দোকানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে দোকানদার দাঁত কেলিয়ে হাসে, উঁচু করা বুড়ো আঙুল নাড়িয়ে বলে, ‘মাল তো পচে নাইক্কা, কী নিবি?’ লিটন তখন এক মুহূর্তে সবজির স্তূপে চোখ বোলায়। দোকানদার গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে সবজিতে আরেক প্রস্থ পানি ছেটায়। লিটন তা–ই দেখে মন্টুর হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলে, ‘দ্যাশটা হালায় বড়ো লুকের ফিরিজ হইয়া গেল নিকি!’ মন্টুও হতাশ হয়। আজ সপ্তাহ দুয়েক ধরে এই অবস্থা। সবজি না পচলে তারা বেচবে কী আর খাবেই–বা কী! এই কাঁচাবাজারে বছরখানেক ধরে এটাই তাদের কাজ; সবজির দোকানের ফেলে দেওয়া সবজি জড়ো করে বাজারে ঢোকার মুখে বসে থাকা, আর নামমাত্র দামে বিক্রি করা। পচা সবজি গুছিয়ে নিতে গিয়ে দোকানদারের চোখের আড়ালে টুক করে একটা–দুটো তাজা সবজি তার মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে পারলে সেদিনটায় আয় ভালো হয়। দোকানদারেরা অবশ্য এমনিতে ওসব দেয় না। ট্রাকে মাল এলে নামানোর সময় একটু হাত লাগানো, দোকানে সবজি সাজাতে সাহায্য করা, এসব তারা নিজের আগ্রহেই করে। আগের দিন মন্টু কয়েকটা ঝুড়ি নামিয়ে দিয়ে টাকা চেয়েছিল দেখে এক সবজিওলা বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়েছে, ‘ক্যান, জিনিস দেই না তগোরে?’ তারপর সামান্য হেসে বলেছে, ‘এট্টু পচলেই তো পাইয়া যাবি। অহন যা দেহি, কাজ করতে দে।’
লিটনের হাতের ডাবের লোভে মন্টু কোনোরকমে উঠে বসে। দুদিন ধরে শরীরটা জ্বর জ্বর। যে ঠান্ডায় সবজি পচে না, সেই ঠান্ডায় মন্টুর শরীরে জ্বর আসে। লিটন অবশ্য রাগ দেখিয়ে বলেছিল, ‘শালার খাওনই নাই, তুই আবার আলগা কাপড় কিনবি কইত্তে? ফুটানি বাদ দে, শীত সইহ্য কর।’ মন্টুর তখন একটু লজ্জা করছিল; জ্বর আসাটা উচিত হয়নি। বাজারের মাঝখানের ডাবওলাকে মাঝেমধ্যে দুই-তিন টাকা ধরিয়ে দিলে শাঁস খাওয়ার জন্য তিন-চারটা ডাবের খোল পাওয়া যায়। কোনোদিন ফাটালে দেখা যায় একটার মধ্যে শাঁস নেই। মন্টুর তখন কান্না পায়। আর লিটন রাগের চোটে সেটাকে এমন জোরে ছুঁড়ে মারে, যেন ওই ডাবটাই তার সমস্ত দুর্ভাগ্যের কারণ। সপ্তাহখানেক ধরে ডাবওলাকে টাকা দেওয়া হয়নি, অথচ আজকের ডাবটা কোথা থেকে এল—মন্টুর জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে না। খোসার কাটা অংশ দিয়ে সে মোটা শাঁস চেঁছে নেয়। এত মোটা শাঁস থাকলে একটা ডাবেই দুজনের হয়ে যায়।
রাতের বাজার কবরের মতো শান্ত। দেখলে কে বলবে, ভোর হলে এখানে কেমন হুলুস্থুল শুরু হয়! বাজারের শেষ মাথায় সরকারি অফিসের লম্বা বারান্দা। সেখানকার দুই পিলারের মাঝখানে চওড়া একটা নীল পলিথিন ঝুলিয়ে দিলেই হলো। তারপর এক দিকের দেয়াল ঘেঁষে চ্যালাকাঠের মতো দুটো শরীর খোবড়ানো মেঝের ওপর পড়ে থাকে। শীতে জড়সড় হলে প্যাঁচানো হাত-পায়ের মধ্যে কোনটা কার, চট করে ধরা যায় না। গেল বর্ষায় বাজারের মাঝখানে প্যাতপেতে কাদার মধ্যে লুকিয়ে থাকা কাচের টুকরো লিটনের পায়ের পাতায় সোজাসুজি ঢুকে গিয়েছিল। রক্ত দেখে মন্টু চিৎকার করেছিল, কিন্তু হাত দিতে সাহস পায়নি। লিটন দাঁতে দাঁত চেপে তিন কোনা সবুজ কাচটা নিজেই টেনে বের করে এনেছিল। দিন দুয়েক পর বাজারের ডাক্তারের কাছে গেলেও চিকিৎসা কী হলো, কে জানে, সেই থেকে সে খুঁড়িয়ে হাঁটে। খোঁড়া পাটা মাঝেমধ্যে টনটন করে, তখন সেটা মন্টুর গায়ের ওপর চড়িয়ে দিলে আরাম লাগে। রাতে গায়ে পা ওঠালে মন্টু ঘুম ঘুম গলায় বলে, ‘ভাই, ক্যান জানি মার কথা মনে পড়তেছে।’ লিটন ধমকায়, ‘চুপ শালা। কোন মার কথা কস?’
‘মা তো মাইনষের একটাই থাকে!’
‘তরে কইছে। আমার আছিল তিনডা। বাপে তিনডা বিয়া করল না? দুই নম্বর বউয়ের ঘর থেইকা ট্যাকা চুরি করছিলাম বইলা বাপে দিল বাড়ি থেইকা বাইর কইরা।’
‘আরে ধুর, আমি কই আসল মার কথা।’
‘ওই মার কথা কস নিকি যে এক বুইড়া ব্যাডার লগে ভাগছিল?’
‘ভাগবই তো, বাপে খুব পিডাইত।’
‘আর তরে?’
‘আমারে আরও পিডাইত । একদিন ঘাড়ের মইদ্দে বিলাইয়ের লাহান ধইরা...’
কথার মাঝখানে মন্টুর গলা ঘুমে জড়িয়ে আসে; কোনোরকমে লিটনের গলার ওপর হাতটা উঠিয়ে দেয়। কানের কাছে মন্টুর ফোঁসফোঁস নিশ্বাস লিটনের ভালো লাগে না। পরদিন শুক্রবার ভোরবেলা মাছের চালানে হাত লাগিয়ে যদি দুইটা পয়সা কামানো যায়, সেই আশায় লিটন তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চেয়েছিল। তবু কে জানে, কেন মন্টুকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে ইচ্ছা করে না। শুধু হালকা কুয়াশার ঘোলাটে হাত তাদের গায়ের ছেঁড়াফাঁড়া কাঁথাটাকে ধাক্কা দিতে থাকে। মন্টুসহ লিটন দেয়ালের দিকে আরও খানিকটা সেঁটে যায়।
ভোরে কাঁথায় টান পড়তেই মন্টুর ঘুম ভাঙে। তাকে ধড়ফড় করে উঠে বসতে দেখে লিটন বলে, ‘তুই ঘুমা, নাইলে জ্বর বাড়ব।’ মন্টু তার কথায় কান দেয় না। কাঁথা আর পলিথিন গুটিয়ে রেখে পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। বলে, ‘জ্বর নাই, ভাই।’ তার কপালে হাত রাখার ভঙ্গি করে লিটন হাসে, বলে, ‘এইডা ঠিক, আমরার জ্বর অ্যামনেই আহে, অ্যামনেই ভালা হয়।’ মন্টুও হাসে। তারপর দ্রুত হেঁটে এগিয়ে যাওয়া লিটনকে ধরে ফেলে। বাজারে আজ ট্রাকের পরে ট্রাক। মুহূর্তে পুরো জায়গাটা লোকে লোকারণ্য আর মাছের ট্রাক থেকে চুঁইয়ে পড়া পানিতে শুকনো ধুলার মন নরম হয়ে কাদা। ঝাঁকা ধরতে ধরতে লিটন আর মন্টুর গা ভিজে সার। কয়েকটা বরফের চাক ধরার পর মন্টুর হাতে ঝিঁঝি ধরে যায়। কাশতে কাশতে সে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ট্রাক থেকে একটা মাছ নামতে দেখে তাকে এগিয়ে আসতে হয়, লিটনের কনুই ধরে বলে, ‘এইডা কী ভাই!’
‘মাছই । তয় তর থেইকাও লাম্বা।’
মুহূর্তে আরও অনেক মানুষ এগিয়ে আসে। এমনটা তো সচরাচর দেখা যায় না! মানুষেরা বলাবলি করতে থাকে, কত কেজি হতে পারে, দামই–বা কেমন হবে। কেউ আন্দাজ করতে পারে, কেউ বলে, ‘আল্লায় জানে কত!’ ভিড়ের মাঝখান থেকে ফেরেশতার মতো চেহারার এক বাচ্চার হাত ধরে আসেন একজন। কাছে আসতেই মাছের গায়ে ছেটানো পানিতে তাদের গায়ে কাদা মাখে। বাচ্চাটা জুতার দিকে তাকিয়ে মনমরা হয়ে যায়। বাবা বলেন, ‘তোমাকে আগেই বলেছিলাম, জুতোর দরকার নেই, স্যান্ডেল পরে আসো।’ বাবার কথায় সে চুপসে যায়। লিটন আর মন্টু পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দেখে। বাবা হাসেন, ‘অসুবিধা নেই, দাগ না উঠলে এই জুতোটা আর পোরো না।’ বড় মাছটা ততক্ষণে গর্বিত বিক্রেতা সোজা করে রেখেছে। বাবা ছেলেকে মাছের পাশে দাঁড় করান, ‘তোমার চেয়েও লম্বা, দেখেছ?’ ছেলে জুতার আফসোস ভুলে মাছের দিকে তাকিয়ে হাসে, বলে, ‘এটাই নেব। এটাই।’ বাবা মানা করতে পারেন না। দামদর করতে করতে গিয়ে দাঁড়ায় চৌত্রিশ হাজার টাকা। লিটন দাঁত খুঁটতে খুঁটতে খোঁড়া পাটাকে একটু আরাম দেওয়ার জন্য মন্টুর গলা জড়িয়ে দাঁড়ায়, ফিসফিস করে বলে, ‘চৌত্রিশ হাজার ট্যাকা কত ট্যাকা হইবার পারে রে?’ মন্টু যেন লিটনের কথা শুনতেই পায় না, বাবা-ছেলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। বাবা ছেলেকে বলেন, ‘বাসায় নিয়ে গেলে এই মাছ কেউ কাটতে পারবে না। ইস্ এত্ত বড় মাছটা তোমার মা দেখল না!’ শেষে ছেলেকে মাছের পাশে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কাদায় মাখামাখি জুতো নিয়ে ছেলের তখন লজ্জার শেষ নেই। মন্টুর হঠাৎ চেতনা ফিরে আসে, ছুটে গিয়ে কোত্থেকে কলাপাতার ছেঁড়া অংশ এনে জুতার কাদাটা মুছে দেয়। ছেলেটা যেন জানতই, মোছার জন্য পা বাড়িয়ে দেয়। ছবি তোলা হলে ‘তুমি কে’ দিয়ে শুরু করে সে, যেন মন্টুর সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করে। লিটন বিরক্ত হয়, কনুই দিয়ে গুঁতো দেয় মন্টুকে। না পেরে কানে কানে বলে, ‘ওই, তুই থামলি? এগো লগে এত কতা কিয়ের?’ ছেলেটা লিটনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কী বললে ওকে? আচ্ছা, তুমি কি আমাদের চেয়ে বড়?’
‘হ, বহুত বড় । ওই মন্টুও তোমার চাইতে বড়। ঠিকমতো খাওন পাইলে...’
ছেলেটা চিন্তায় পড়ে যায়। মন্টুর দিকে এগিয়ে নিজের আর মন্টুর কাঁধ মাপতে থাকে; খানিক আগে যেমন মাপছিল মাছটার সঙ্গে। মাছটা ততক্ষণে রক্তারক্তি করে ছোট ছোট টুকরো হয়ে গেছে। একে একে অনেকগুলো ব্যাগ গাড়িতে ওঠে। লিটন অবাক হয়ে দেখে, ছেলেটার বাবার হাতের টাকা গোনা শেষই হয় না, গুনতে গুনতে যেন সকালটা দুপুর হয়ে যায়। আর তখন হয় এক অদ্ভুত ব্যাপার, ছেলেটা জেদ ধরে বসে, মন্টুকে না নিয়ে সে বাড়ি যাবে না। তাকে কিছুতে গাড়িতে ওঠানো যায় না। বাবার অবস্থা দেখে মনে হয় ছেলেকে কষে চড় লাগাতে পারলে ভালো লাগত, কিন্তু গালে আলতো করে হাত রেখে বলেন, ‘ওদের বাড়ি তো এখানে, বাবু, ওরা আমাদের সঙ্গে গিয়ে কী করবে?’ জেদি ছেলে চিৎকার করে বলে, ‘না... তুমি জানো না, ওদের বাড়ি নেই। ওই যে ও বলেছে।’ ছেলেটা আঙুল উঠিয়ে মন্টুকে দেখায়। রংজ্বলা হাফ প্যান্ট আর ঘাড়ের কাছে খানিকটা ফাটা শার্ট গায়ে নিজেরই ছেলের সমবয়সী নির্লিপ্ত ছেলেটির দিকে অস্বস্তি নিয়ে তাকান তিনি। ঘাড়ে হাত রেখে পাশে দাঁড়িয়ে কাত হয়ে দাঁড়ানো সামান্য বড় আরেকজন। কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটছে আর বাজারে ঘিরে থাকা লোকদের মাঝখানে তার বিপদে পড়ার মজা তারিয়ে উপভোগ করছে। বাবা-ছেলের জেদাজেদি চলতে থাকে, দর্শকের জটলা সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকে, মন্টুকে তিনি সঙ্গে নেবেন কি না।
একসময় জেদি ছেলেটি কান্না জুড়ে দেয়, মাছের দোকানের আশপাশে উন্মাদের মতো ছোটে। এ যেন কোনো খেলনার জন্য বায়না। দামি জুতা-জামা আরেক প্রস্থ কাদায় মাখামাখি হয়। নাটকের শেষ দৃশ্যে ছেঁড়াফাঁড়া কাপড় পরা ছোট ছেলেটার কাছে এসে ভদ্রলোক বিরক্তিভরা গলায় বলেন, ‘ওই, যা গাড়িতে ওঠ।’ চারদিকের দর্শক তালি বাজায়। কান্না থামিয়ে জেদি ছেলে ছুটে আসে, ‘তুমি ওকে তুই করে বলছ কেন? আগে থেকে চিনতে?’ পেছন থেকে ফাটা শার্টটা লিটন টেনে ধরলে আরেকটু ফেটে যায়, তাতেও মন্টুর কৌতূহল দমে না। লিটনের হাত টেনে ধরে সে গাড়ির কাছে যায়। দ্রুত উঠে গেলে লাফিয়ে গাড়িতে ওঠে ছেলেটা। ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে লিটনও ওঠে দ্রুত। ভদ্রলোকের ছেলের কান্না থামে। মাঝখানে বসে দুজনের দুই ময়লা হাঁটুর ওপর হাত রাখে সে। ভাবলেশহীন ড্রাইভারের পাশে ভদ্রলোক নাক কুঁচকে বসে থাকেন। গাড়ির বুটে মাছের টুকরো থেকে গন্ধটা আসছে, নাকি এদের গা থেকে, বোঝার উপায় নেই। না চাইলেও লিটনকে যেতে হয়, কে জানে রাস্তায় যদি এরা মন্টুকে কোথাও নামিয়ে দেয়, সে কি আর রাস্তা চিনে বাজারে ফিরতে পারবে! ওদিকে ভোর থেকে মালে হাত লাগানোর বখশিশটা না নিয়ে হুট করে চলে আসাতে আফসোস লাগে, ফিরে এলে দোকানদার কি আর দেবে? বাকির নাম ফাঁকি।
বাড়িটা কত উঁচু—লিটন আর মন্টু গাড়ির ভেতর থেকে ঠাওর করতে পারে না। গাড়ি যখন ভেতরে এসে থামে, মনে হয় পুরো পৃথিবীটাই যেন ঠান্ডা ছাদ দিয়ে ঢাকা। চোখ ছানাবড়া হলেও লিটনের মেজাজ খারাপ। মন্টুর কারণে দিনটাই নষ্ট। ছেলেটা তাদের হাত ধরে টানে। লিটন তার সঙ্গে পেরে ওঠে না। একে একে সব দেখতে হয়, ‘এই আমার ঘর, এ হলো আমাদের জিম, ওদিকটায় দেখো পার্ক, ওখানে পরে আমরা খেলতে যাব, কেমন?’ ঘরের সবকিছু এত স্থির, এত ঝকঝকে যে লিটন আর মন্টু গা বাঁচিয়ে চলে। কে জানে কিসে ধাক্কা লাগে। পৃথিবীতে এত পরিষ্কার জায়গাও থাকে যে নিজেদের শরীরটা জড়সড় করে রাখতে হয়! কোথায় দাঁড়াবে, ভেবে পায় না তারা। ওদিকে ছেলেটা হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে দেয়, ‘এখানে আমি ঘুমাই।’ তার বাবা কাপড় বদলে ফিরে আসেন, সঙ্গে মা-ও। ঘরে ঢুকেই ছিটকে বেরিয়ে যান তিনি। ঘরের বাইরে তাদের আলাপ ঘরে বসেই শোনা যায়।
‘আশ্চর্য, এদেরকে তুলে নিয়ে এসেছ! তোমার বুদ্ধি দেখলে অবাক লাগে। ছেলে বলল আর দুটো রাস্তার ছেলেকে খালি পায়ে... মানা করতে পারোনি?’
‘তুমি তো আরিয়ানের জেদ জানো। বাজারের মধ্যে একটা হইচই বাঁধিয়ে ফেলল, তারপর...’
‘সামান্য জেদ ম্যানেজ করতে পারলে না? আগেই বলেছিলাম, ও এখনো দিন-দুনিয়ার কিছু বোঝে না, ওকে এসব জায়গায় নেওয়ার দরকার নেই, নাহ্, ওকে উনি মাছের বাজার দেখাবেন! এখন হলো!’
‘কী আর, ওদেরকে কিছু কাপড়চোপড় থাকে তো দাও, পরে ড্রাইভার গিয়ে নামিয়ে দিয়ে আসবে। ছেলেটা এত জেদ করল, আমি মানা করতে পারলাম না,’ কাঁচুমাচু মুখে ভদ্রলোক কথাগুলো বলতে বলতেই স্ত্রীর সামনে ফোন মেলে ধরেন, ‘এই দেখো, কী সাংঘাতিক বড় ছিল মাছটা, তুমি দেখলে...’ মহিলা ফোনের দিকে তাকান না। আগের চেয়েও বেশি বিরক্তি নিয়ে বলেন, ‘রাতে এতগুলো মেহমান আসবে, সেসব করব, নাকি এদের জন্য এখন কাপড় খুঁজতে যাব? যত্তসব!’ তাদের কথার মাঝখানে ছেলে বেরিয়ে আসে, ‘মা, আমার নতুন বন্ধুদের দেখেছ? ওরা এখন থেকে আমার সঙ্গে থাকবে।’ মা ছেলের গালে হাত বুলিয়ে আদর করেন। ছেলে নাচতে নাচতে চলে যায়। বাবা বলেন, ‘কই, তুমিও তো মানা করতে পারলে না?’
‘শোনো, কিছু খাবার আর কাপড় দিচ্ছি, ড্রাইভারকে বোলো খাওয়ার পরে ওদের ছেড়ে আসতে। না হলে পরে ব্যাপারটা আরও কঠিন হবে।’
‘থাক না হয় এখানেই ওরা, বাচ্চাটা যখন চায়...’
‘মানে? ইউ মিন চাইল্ড লেবার! মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার। কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে বিদায় কোরো বলে দিলাম।’
লিটন মেঝেতে বসে দাঁত খোঁটে। মন্টুর আনন্দের শেষ নেই। ছেলেটা যা দেখায়, সে তা-ই মুগ্ধ হয়ে দেখে। ফাঁকে কখনো ছুটে এসে লিটনকেও দেখিয়ে যায়, বলে, ‘মাইনষের এত্ত জিনিস থাকে, ভাই!’ তার গায়ে ঝকঝকে শার্ট-প্যান্ট দেখে লিটন বলে, ‘তরে তো আর ছ্যারা লাগে না রে, বড়লুকের পোলার লাগান লাগে।’ মন্টু হাসে, ‘তোমারেও তো, ভাই।’ তারপর প্যান্টের পেছনে গুজে রাখা খেলনা পিস্তল লিটনের দিকে তাক করে বলে, ‘আমি রেব, আমি রেব, করোসফায়ার কইরা দিমু।’ লিটন হেসে বলে, ‘এইহানে কী দ্যাখতে আইছিলি তুই?’
‘এই বাড়িটা । আর দ্যাখতে চাইছিলাম, এইরাম পোলার মায়ে কেমুন অয়।’
‘হইছে দেখা?’
মন্টু উত্তর দেয় না।
‘নে, অহন চল।’
‘কই যামু?’
‘ক্যান, বাজার?’
‘হ্যায় যে কয় এইহানে থাকতে?’
‘না রে, পাগলা, এইটা তো আমগো বাড়ি না। আমগো বাড়ি হইল গিয়া বাজার।’
মন্টু অবিশ্বাস্য কিছু শোনার মতো করে তাকিয়ে থাকে। লিটন বলতে থাকে, ‘শোন, আমরা না গ্যালে হ্যারা আমগো নিয়া বাজারের মাইনষের সামনে ছাইড়া দিয়া আসব। আমগো একটা মান-সম্মান আছে না, কী কস?’
‘তা ঠিক, ভাই, মাইনষে ভাবব, বাড়িত রাখব না দেইখা ছাইড়া দিয়া গেল।’
‘হ। পোলাটা খাইয়া ঘুমাইছে। অহনই চল। গিয়া হগ্গলরে কমু, দাওয়াত খাইয়া আইলাম।’
পিস্তলটা মন্টুর হাত থেকে নামে না। লিটন জোর করে নামায়। বের হতে হবে খালি হাতে, না হলে বিপদ আছে, কিছু একটা যেন তাকে আগেভাগেই তা জানিয়ে দেয়। রাস্তায় নেমে বড় নিশ্বাস নেয় তারা। ‘হাঁইটা যাইতে মনে কয় রাইত নাইমা পড়ব,’ লিটন বলে। ‘তাতে কি, ভাই, ল্যাংড়া পা লইয়া তো আর উইড়া যাইতে পারবা না।’ লিটন মন্টুর মাথার পেছনে ছোট্ট ধাক্কা দেয়। তারপর রাস্তার চায়ের দোকান থেকে পানি চেয়ে খায়। আজকে কেন যেন তার চা খেতে মন চায়। ভোরে মাছের চালানে হাত লাগানোর টাকাটা আনলে এখন চা খাওয়া যেত। সারা দিন পর এই ভালো জামাকাপড় পরে দোকানদারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কি আর সকালের টাকা পাওয়া যাবে? ভাবতেই অনিশ্চয়তা মনটা দখল করে ফেলে। তবে টাকা না পেলে কী, পেটে মোটেও খিদে নেই। খিদে না থাকাটা যেন কেমন, মনে হয়, খোঁড়া পায়ে হাঁটলেও হাঁটার কোনো কষ্ট নেই। বড়লোকেরা এত খাবার খেলে তারপর আবার কখন খায়? ভাবতে গিয়ে লিটন নিজের মনে হাসে। খানিক পরে মন্টু ক্লান্ত হয়ে পড়ে, বলে, ‘বড়লুকের পাড়া বহুত দূর। আমার ক্যান জানি আবার জ্বর জ্বর লাগতেছে, ভাই।’
‘চইলা আসছি, আরেট্টু কষ্ট কর । চল, আইজ রাইতে তোরে পুরা কাঁথাটাই ভাঁজ কইরা দিয়া দিমুনে।’
দুজন দুজনের ঘাড়ে হাত রাখে; কে কার ওপর ভর করে হাঁটে, ধরা যায় না।