ইরান চুক্তি বাতিল করলেন ট্রাম্প, এরপর কী হবে?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, ২০১৫ সালে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত ছয় জাতি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের আশু প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা পুনরারোপ করবে। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে পারে।
হোয়াইট হাউসে এক সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে ইরান চুক্তিকে ‘জঘন্য’ বলে বর্ণনা করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, চুক্তিটি গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ। ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ে মিথ্যা বলেছে, এই দাবি করে ট্রাম্প বলেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সন্ত্রাসবাদের সমর্থক এই দেশ বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক মারণাস্ত্র নির্মাণে সক্ষম হবে।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘ ও চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্যান্য দেশ এই চুক্তি বাতিলের বিরোধিতা করে বারবার বলেছে, ইরান চুক্তির শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা দপ্তরগুলোও এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত। মাইক পম্পেও, যিনি বর্তমানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, সিআইএর প্রধান হিসেবে মার্কিন কংগ্রেসের সামনে এক শুনানিতে স্বীকার করেন, ইরান চুক্তির কোনো শর্ত লঙ্ঘন করেনি। চুক্তিটি যাতে বাতিল না করা হয়, ট্রাম্পকে সে কথা বোঝাতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁ ও জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন পর্যন্ত ছুটে আসেন। কিন্তু তাঁদের কথায় কর্ণপাত করেননি ট্রাম্প। এই চুক্তি বাতিল ছিল তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। সব পক্ষের আপত্তি সত্ত্বেও নিজের সমর্থকদের খুশি করতে তিনি চুক্তিটি বাতিল করলেন।
ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে তাঁর নিজ দলের অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করেছেন। স্পিকার পল রায়ান ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে ‘দুঃখজনক’ বলে বর্ণনা করে বলেন, চুক্তিটি বাতিল করার বদলে উচিত ছিল এর সমস্যাগুলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা, যিনি এই চুক্তিটিকে তাঁর সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সাফল্য বলে বিবেচনা করেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেন, এই চুক্তির ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক নজরদারিতে আনা সম্ভব হয়েছিল। এখন যদি ইরান এই কর্মসূচিতে ফিরে যায়, তাহলে করার কিছু থাকবে না।
ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ইরানের প্রতিক্রিয়া কিছুটা মিশ্র। প্রেসিডেন্ট রুহানি পুনরায় পারমাণবিক কর্মসূচিতে ফিরে যাওয়ার হুমকি দিলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ এক টুইটে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া এই চুক্তি ধরে রাখতে তাঁরা উদ্যোগী হবেন। এই ব্যাপারে এই চুক্তির স্বাক্ষরকারী বাকি পাঁচ দেশের সঙ্গে তাঁরা আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাবেন। ইউরোপীয় নেতারাও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াই এই চুক্তি রক্ষা করতে আগ্রহী। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির তিন নেতা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, চুক্তির শর্ত মেনে চলতে তাঁরা অঙ্গীকারবদ্ধ।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করেন, ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ইউরোপীয় দেশগুলো ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক অব্যাহত রাখার চেষ্টা করলে ঝামেলায় পড়বে। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো মার্কিন রাজস্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে তাদের পক্ষে সেই দেশের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ডলারভিত্তিক আর্থিক লেনদেন টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হবে। মার্কিন ও ইউরোপীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রতি হুঁশিয়ারি হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, ইরানের সঙ্গে নতুন কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের অনুমতি দেওয়া হবে না। হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়েছে, বোয়িং ও এয়ারবাস কোম্পানি ইরানকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বিমান সরবরাহের যে চুক্তি করেছিল, তা বাতিল করা হবে। ফরাসি তেল কোম্পানি টোটাল ইরানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি যে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, সেটিও বাতিলের সম্ভাবনা রয়েছে।
ইরান মুখে মুখে ট্রাম্পের ঘোষণায় অবজ্ঞা প্রকাশ করলেও এই সিদ্ধান্ত তার অর্থনীতির জন্য বড় রকমের ধাক্কা। অব্যাহত নিষেধাজ্ঞার ফলে তার অর্থনীতি যে দুর্দশায় পড়েছিল, তা কাটিয়ে ওঠার জন্যই অপমানজনক শর্তে ইরান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট রুহানি এই চুক্তির প্রধান সমর্থক ছিলেন। এখন নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে ইরানের অর্থনীতি যদি ফের মুখ থুবড়ে পড়ে, তাহলে রুহানির পক্ষে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
ট্রাম্পের জন্যও এই সিদ্ধান্ত বিপজ্জনক হতে পারে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একটি পারমাণবিক সমঝোতার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত তাতে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করতে পারে। উত্তর কোরিয়া মনে করতে পারে, ট্রাম্প নির্ভরযোগ্য অংশীদার নন। যুক্তরাষ্ট্রের তিন প্রধান মিত্র ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট, এই প্রশ্নে তাদের সঙ্গেও উত্তেজনা ও মতবিরোধ বৃদ্ধি পেতে পারে। এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে খুশি ইসরায়েল ও তার প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। ইসরায়েলি পর্যবেক্ষকেরা আগে থেকেই সাবধান করে দিয়েছেন, নিজের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনের উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহু ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ লাগানোর পাঁয়তারা করছেন। ইরানের সঙ্গে বৈরিতার কারণে সৌদি আরবও তেমন যুদ্ধে আগ্রহী। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা এক সম্পাদকীয় ভাষ্যে মন্তব্য করেছে, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের চাপে ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে। তেমন কিছু হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই প্রবল রকম অশান্ত হয়ে উঠবে।
আরও পড়ুন: