জীবন জোকার হাফিজুলের গল্প

শিশুদের কাছে জোকার মামা নামে পরিচিত। শিশুদের সঙ্গে তার সখ্যও ভালো। প্রিয় জোকার মামাকে দেখে এভাবেই চানাচুর কেনার ছলে হাফিজুল ইসলামের সঙ্গে হাঁটছে শিশু–কিশোরেরা। ছবি: লেখক
শিশুদের কাছে জোকার মামা নামে পরিচিত। শিশুদের সঙ্গে তার সখ্যও ভালো। প্রিয় জোকার মামাকে দেখে এভাবেই চানাচুর কেনার ছলে হাফিজুল ইসলামের সঙ্গে হাঁটছে শিশু–কিশোরেরা। ছবি: লেখক

‘ঢাকায় আসছি আড়াই বছর আগে, স্ত্রীসহ কাজ করতাম হোটেলে। আমি কাস্টমারদের খাবার দিতাম, স্ত্রী কাটাকুটি, থালাবাসন মাজত। ভালোই চলছিল সংসার। হঠাৎ বলা নাই, কওয়া নাই, একদিন হোটেলমালিক দুইজনরে কইলো, কাইল থেইক্যা আর কামে আহনের দরকার নাই। করমু কি অহন? ঘরে মেয়ে-মেয়ের জামাই, ছোট মেয়ে পড়ে। ঘর ভাড়ার টেকা, সংসারের খরচের আন্ধার ছাড়া আর কিছুই দেখি না। কামের লাইগা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। রিকশা চালাইলাম একদিন, রাইতে আমার দম টানতে পারি না, কী কইরা খামু আহন? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, খেয়াল করলাম চানাচুরওয়ালারে, কাছে গিয়া জিগাইলাম কত থাকে? কইলো কোনো দিন ৩০০, কোনো দিন ৫০০ আবার জোকারি কইরা ঘুঙুর বাজাইয়া নাচনা দিয়া বেচলে বেচাকিনা বেশিও হইতে পারে, লসও হয়।’

তপ্ত রোদে পোড়া ক্লান্ত কৃষকের তরতরে ধারালো কাঁচি দিয়ে যেন বুকটা চিরে সব বেদনার কথাগুলো নিমেষেই বলে শেষ করলেন হাফিজুল ইসলাম। চোখ বেয়ে তাঁর টলমল করে গড়িয়ে পড়ছে পানি।

কিছুটা শান্ত হয়ে হাফিজুল ইসলাম বললেন, ‘ছুডুবেলায় ঘেটু গানের দলের লগে যাইতাম, সার্কাস দেখতাম, জোকার দেখতাম, সার্কাসের জোকার কেমন, জোকারের পোশাক কেমন হয়? হায়রে ৫০ বছর বয়সে এই পোশাক পইরা অহন জীবন চালান লাগব। কী করমু, জোকারের পোশাক কিনলাম, ঘুঙুর কিনলাম, দুইটা ভাতের লাইগা ঘরের উপাশ (উপোস) মানুষের লাইগা জোকারের পোশাক পইরা রাস্তায় নামলাম, বাপু চোঙায় ফুঁ দিয়া ডাক দেই চানাচুর-র-র-র...!’

হাফিজুল ইসলাম বলে যান তাঁর জীবনের কথা। বলেন, ‘ঘুঙুরের শব্দে চারপাশ থেইকা মানুষ, পোলাপান চিল্লায় উঠে ওই যে জোকার যায়, জোকার, জোকার, ওই জোকার মামা, চানাচুর দাও..।’

রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের পেছনে সরকারি কর্মকর্তাদের পুরোনো স্টাফ কোয়ার্টার। বেশ নিরিবিলি ফাঁকা জায়গা থাকায় চারপাশে বুনে রাখা হয়েছে লালশাক, কয়েকটা তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে। বেশকিছু আমগাছ আবার নতুন মুকুলের ভারে নুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে দোদুল দুলছে, মরা আম্র মুকুল ঝরছে। তালগাছের ছায়ায় বসে বসে চোখ মুছছেন হাফিজুল মিয়া। বাতাসে দোল খাওয়া কচি লালশাক গাছগুলো যেন এক লাল টকটকে রক্তমাখা বেদনার প্রান্তর হয়ে গেছে তখন।

জীবন আদতে এক ঠাট্টার বাক্স, এ নাগরিক শহরে এমন বেদনাহত জীবন বাস্তবতা নিয়ে বয়ে বেড়ান অনেকেই। কারোটা প্রকাশিত কারোটা অপ্রকাশিত ব্যবধান শুধু এতটুকুই। চানাচুর ভাজা যে কেউ বিক্রি করতে পারে, আপনার সামনে চানাচুরওয়ালা পাশ কেটে গেলে হয়তো ১০ টাকার কিনবেন, নয়তো না, কিন্তু একটা কিম্ভূতকিমাকার মানুষ যদি জোকার সেজে, ঘুঙুরের শব্দের তালে নানা অঙ্গভঙ্গিমায় মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চানাচুর ভাজা বিক্রি করে, হয়তো তখন একটু আনন্দ নেওয়ার জন্য হলেও ১০ টাকার চানাচুর ভাজা আপনি কিনবেন, চানাচুর বানানোর ফাঁকে আবার হাস্যরসেও মাতবেন আপনি তাঁর সঙ্গে। আঙুল দিয়ে ঘুঙুরে একটু খোঁচা দেবেন টুংটাং শব্দের জন্য, হাত থেকে চোঙ্গাটা নিয়ে খুনসুটিতেও মাততে পারেন। সবই ঠিক আছে, শুধু হাফিজুলের মতো জোকারের জীবনে বাহারি রঙের পোশাকের অন্তরালে হৃদয়ের ক্ষতটুকু দেখবেন না কখনোই আপনি।

সকালে কাজে বেরোনোর আগে স্ত্রী আখতারা বেগমের সঙ্গে হাফিজুল ইসলাম। ছবি: লেখক
সকালে কাজে বেরোনোর আগে স্ত্রী আখতারা বেগমের সঙ্গে হাফিজুল ইসলাম। ছবি: লেখক

শুধু দুটো টাকা বেশি বিক্রির জন্য, দুটো ভাতের জন্য, এ শহরে কতটা লজ্জাবোধ, হাসি–ঠাট্টার আর তিক্ত জীবন রস নিয়ে পার করেন প্রতিদিন হাফিজুল, কোটি মানুষের ভিড়েও জীবন খাতায় অপ্রকাশিতই থেকে যায় আজন্মই এমন জীবন গল্পের মুখবন্ধটা।

রাজধানী ঢাকার সাততলা বস্তির ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে স্ত্রী, দুই সন্তান, মেয়ের জামাই নিয়ে থাকেন হাফিজুল ইসলাম। প্রায় আড়াই বছর আগে সিরাজগঞ্জের জয়রামপুর গ্রাম থেকে ঢাকা আসে হাফিজুল ইসলামসহ তাঁর পরিবার। পিতা আলিমউদ্দিনের ছয় সন্তানের মধ্যে ছোট ছেলে হাফিজুল। ঢাকায় এসে স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি হোটেলে কাজ করলেও হোটেলমালিকের ইচ্ছায় কাজ থেকে বাদ পড়েন কোনো নোটিশ ছাড়াই। তারপর থেকেই জীবন ধারণ, জীবিকার তাগিদে বেঁচে থাকার জন্য এ জোকারি করে চানাচুর ভাজা বিক্রির পথ বেছে নেন হাফিজুল ইসলাম তা প্রায় এক বছর।

রাজধানীর মহাখালী, তেজগাঁও এলাকা, বাড্ডা, রামপুরা, মোহাম্মদপুরসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় সকাল থেকে রাত অবধি এ চানাচুর বিক্রি করেন হাফিজুল ইসলাম। সারা দিনে তাঁর রোজগার হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। এ জোকারের পোশাক পরে চানাচুর বিক্রির কারণে পরিবারের স্ত্রীসহ সদস্যদের সঙ্গে তাঁর প্রায়ই ঝগড়া হয়, হয় মনোমালিন্য। বস্তির অনেকেই হাফিজুল ইসলামকে জোকারের পোশাকে বাইরে চানাচুর বিক্রি করতে দেখে বস্তিতে এসে কানাঘুষা করে।

ছোট্ট এক ঘরেই ৫ সদস্যের থাকা–খাওয়া
একদিন ভোরবেলা মহাখালীর সাততলা বস্তি এলাকায় হাফিজুল ইসলামের ঘরে গিয়ে আঁতকে উঠতে হয়। ছোট্ট একটা ঘর, তাতে পাঁচ সদস্যের থাকা–খাওয়া। হাফিজুল গোসল করছেন। স্ত্রী আখতারা তাঁর চানাচুর ভাজার আয়োজনপাতি গুছিয়ে দিচ্ছেন। সকালে খাওয়ার পর চানাচুরের বাক্স আর পেছনে একটা পোঁটলা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।

বস্তি থেকে বেরোলেই মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। পাশেই ছোট্ট এক চিপায় একে একে হাফিজুল পরে নিলেন বিশেষ কায়দায় বানানো জোকারের পোশাকের বাহারি অনুষঙ্গ। পোশাকটা পরেই উচ্চস্বরে ঘুঙুরের তালে চোঙায় দিলেন ডাক, ‘হুররে চানাচুর, গরম–গরম চানাচুর ভাজা...।’ পাশেই হাসপাতাল মাঠে খেলা করছিল একদল শিশু–কিশোর। হাফিজুলের ডাক শুনে দৌড়ে এল, জোকার মামা, জোকার মামা বলে। মুহূর্তে শিশু–কিশোরেরা ঘিরে ধরল হাফিজুলকে, হাফিজুল তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে চানাচুর ভাজা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিশেষ করে শিশুদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এবং পরিচিত মুখ জোকার হাফিজুল ইসলাম।

হাফিজুল বলেন, ‘বাবা, বস্তিতে এই পোশাক পইরা বার হওন যায় না, খুব শরম লাগে। মেয়া বিয়া দিছি তো। আরেক মেয়া মাদ্রাসায় পড়ে। তাই দূরে গিয়া জোকারের পোশাক–আশাক পরি, রাইতে পোশাক খুইলা বস্তিতে ঢুকি। রাস্তায় বস্তির মেলা মানুষের লগে দেহা হইয়া যায়, তারা বস্তিতে টিটকারি করে আমার বউ পোলাপানের লগে, বউ কত রাইত যে এই লইয়া কানছে, হিসাব নাই। কী করমু, দুইডা ভাত তো খাইতে অইব। কপাল এতই খারাপ, সমান বয়সী বন্ধুরাও কয়, কিরে হাফিজ, এই ব্যবসা কবে ধরলি, বাইজি নাচনা কবে শিখলি? কও বাবা, কেমন লাগে?’

হাফিজ আবারও কেঁদে ফেললেন। শিশুগুলো খেলা ফেলে হাফিজুলের পিছু ছাড়ল না অনেকক্ষণ। শিশুদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হাফিজ কখনো হাসতে থাকেন। হাফিজুল বলেন, ‘পোলাপানেরা খুব ভালোবাসে আমারে, আনন্দ পাই খুব অগো লগে থাইকা।’

প্রতিটা মানুষের জীবনে একটা ফেরার গল্প থাকে। ক্লান্ত বুকের মধ্য দিয়ে সে পথটাকে খুঁজে ফেরে মানুষ সারা জীবন। কেউ খুঁজে পায় আবার কেউ খুঁজে পায় না। এ শহর ছেড়ে নিজের গ্রামে ফিরে যেতে চায় সে। খুব বেশি চাওয়া–পাওয়া নেই জীবনের কাছে তাঁর। বাড়িতে তাঁর ভিটে মাটিটুকু অবশিষ্ট আছে, সেই ভিটায় একটা নতুন করে ঘর তুলবেন হাফিজুল ইসলাম। সেই ঘরে থাকবেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা, তাঁর বৃদ্ধ জননী। বাজারে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান থাকবে তাঁর। কোনোমতে দুবেলা ডাল–ভাত খেয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলেই তাঁর চলে যাবে।

চানাচুর বিক্রির সময়, খেলা ফেলে প্রিয় জোকার মামাকে ঘিরে শিশু–কিশোরেরা। ছবি: লেখক
চানাচুর বিক্রির সময়, খেলা ফেলে প্রিয় জোকার মামাকে ঘিরে শিশু–কিশোরেরা। ছবি: লেখক

এই ব্যস্ত নাগরিক শহরে জন্মদায়িনী মায়ের কথা খুব মনে পড়ে হাফিজুলের। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে তাঁর, ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর এই মা শরীরের রক্ত পানি করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। সেই মা এখন গ্রামে থাকেন, দিনমজুর ভাইদের ঘরে ঘরে দিনপাত করে খান। শুধু বাড়ি আসা-যাওয়ার গাড়ি ভাড়া নেই বলেই মায়ের কাছে যেতে পারেন না হাফিজুল ইসলাম। আজকাল মোবাইলে কথা হয় না মায়ের সঙ্গে। যদি মাকে কিছু টাকা দিতে হয়? কোথায় পাব টাকা?

বুকে পাত্তর বাইন্দা সব সহ্য করি
হাফিজুল ইসলামের স্ত্রী আখতারা বেগমের কণ্ঠেও বেদনার আর্তি। তিনি বলেন, ‘আমার কইলজাডা ফাইট্টা যায়। এই বয়সে কেন এমন কইরা চানাচুর বিক্রি করব, আমার খুব খারাপ লাগে, খুব...কী করমু, ঘরে এত গুলাইন মানুষ উপাস থাকব। শেষে বুকটায় পাত্তর বাইন্দা সব সহ্য করি। মেলা দিন ঝগড়া করছি, অহন করি না। খুব মন চায় এই শহর ছাইড়া গেরামে ফিরা যামু...কিন্তু থাকার ঘর নাই, গেরামেই থাকমু আর কই?’

দুই মেয়ের মধ্য ছোট মেয়ে উম্মে হাবিবা পাশের একটি নূরানী মাদ্রাসায় পড়ে। মাদ্রাসা থেকে ফিরে হঠাৎ করেই তার ভাঙা গলার আওয়াজ শোনা গেল, গলা বসে গেছে। মাদ্রাসাপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় নাকি এমন গলা বসে যায়। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়াশোনা করে হাবিবা। মা–বাবার ইচ্ছাতেই কয়েক মাস হলো তা ছেড়ে হাবিবা নূরানি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে। মাদ্রাসায় পড়ানো হয় শুধু আরবি শিক্ষা। মেয়েকে নিয়ে খুব ছোট্ট একটি স্বপ্ন দেখেন তার মা–বাবা, মেয়ে বড় হলে একজন আলেমের কাছে বিয়ে দেবেন মেয়েকে।

মাদ্রায় পড়তে তার কেমন লাগে, এমন প্রশ্নের উত্তরে শিশুকন্যা উম্মে হাবিবা বলে, আমি তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজি পড়ছি, তাই প্রথমে একটু কঠিন মনে হলেও এখন একটু সহজ লাগে আরবি। আমি আব্বা আম্মাকে খুব ভালোবাসি, আমি তাঁদের ইচ্ছাতেই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে রাজি হয়েছি এবং ভালোভাবে পড়াশোনা করতে চাই, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে চাই...।

শূন্য ভিটায় উঠবে কি নতুন টিনের ঘর
এই জনজীবন থেকে, এই জীবন যন্ত্রণা থেকে আদৌ কি মুক্তি মিলবে হাফিজুল ইসলামের। প্রতিদিন যে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঘর থেকে বের হন এই জোকার জীবন সৈনিক চানাচুর বিক্রেতা হাফিজুল ইসলাম, তাঁর কি ফিরে যাওয়া হবে আদৌ? তাঁর শূন্য ভিটায় উঠবে কি একটি নতুন টিনের ঘর? একটা ছোট্ট চায়ের দোকানের স্বপ্ন কি পূরণ হবে তাঁর? একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা কি পূরণ হওয়ার নয় কোনোকালেই, আমরা হয়তো এমন প্রশ্নের উত্তর কেউ জানি না। তবুও খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, জীবনটা বদলে যাক হাফিজুল ইসলামের। সুন্দর অনাগত জীবন হোক তাঁর।

হাফিজুল শেষে বলেন, ‘আমার এহনো বিশ্বাস করতে মন চায় কেউ যদি আমারে একটু সহযোগিতা করে, আমারে একটা গ্রামে ঘর তুইলা দেয়, কত বড়লোক তো এই ঢাহা শহরে থাহে, তারা কি আমারে একটু সহযোগিতা করব না বাপ? যাই, কাইল একটা সাহেবের বিয়াতে জোকারি কইরা চানাচুর বেচার অর্ডার আছে...। মেলা কাম বাকি।’

এই নিষ্ঠুর নাগরিক উন্মাদনার শহরে স্বপ্ন আর ইচ্ছা বেঁচে থাক জীবন জোকার হাফিজুল ইসলামের মতো অনেকের...।