পৃষ্ঠপোষকতার প্রত্যাশায় কাঁসাশিল্প
বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে কাঁসা-পিতলের রয়েছে আদি সম্পর্ক। ধারণা করা হয়, প্রাচীন সভ্যতার ব্রোঞ্জ যুগে এসবের প্রচলন শুরু। ১৫৭৬ থেকে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল আমলে উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। শুরুর দিকে এসব ধাতু দিয়ে ঢাল, তলোয়ার, বল্লম, তির-ধনুক ইত্যাদি যুদ্ধসরঞ্জাম তৈরি হতো।
ব্রিটিশ আমলে যুদ্ধসরঞ্জাম ছাপিয়ে তৈরি হতে থাকে নিত্যব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী, যেমন: থালা, গ্লাস, কলস, পূজার ঘণ্টা, গামলা, চামচ, বালতি, হাঁড়িপাতিল, কড়াই, প্রদীপ, বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, সংগীত সাধনার যন্ত্র ইত্যাদি।
ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার তাঁর ‘আ স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল’ (১৮৭৭) গ্রন্থে ঢাকা জেলায় ৪৮৯ জন কাঁসাশিল্পী ও কারিগর ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। ঢাকার ধামরাই, শিমুলিয়া ছাড়াও টাঙ্গাইলের কাগমারী, জামালপুরের ইসলামপুর, বগুড়ার শিববাড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে কারখানা গড়ে উঠেছিল।
১৯৪২ সালে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম শহরে হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে জামালপুরের কাঁসাশিল্পী প্রয়াত জগৎচন্দ্র কর্মকার শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। এ শিল্পের ওপর প্রথম আঘাত আসে ১৯৪৭ সালে। পরের ধাক্কা ১৯৭১। সব গুছিয়ে এরপর ১৯৭৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত উৎপাদন ও বিপণন মোটামুটি ভালো ছিল। ১৯৯০ সাল থেকে অবস্থা পুনরায় খারাপ হতে শুরু করে। স্বাস্থ্যসম্মত কাঁসা-পিতলের জায়গা দখল করে নেয় ফাইবার, স্টেইনলেস স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, সিরামিকের তৈরি বাসনপত্র। বর্তমানে কাঁসাশিল্প অনালোচিত হলেও প্রতিবছরই ধামরাইয়ের কাঁসাপল্লি ঘুরে যান বিভিন্ন দেশের ভাস্কর্যপ্রেমীরা। এ অঞ্চলে কাঁসা-পিতলের ভাস্কর্য নির্মাণের ইতিহাসটা পাল রাজত্বের আমলের। পরবর্তী সময়ে আবার সত্তর দশকে মোশারফ হোসেন ও সাক্ষী গোপাল বণিক মিলে কাঁসা-পিতলের ভাস্কর্য তৈরি শুরু করেন, যা এখনো চলছে। বণিক পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন সুকান্ত বণিক।
সুকান্ত বণিকের কথা
ধামরাই রথখোলা মোড় পেরিয়ে ‘ধামরাই মেটাল ক্র্যাফটস’। এর স্বত্বাধিকারী সুকান্ত বণিকের পুরোনো বাড়িটির নিচতলার প্রায় সব কটি ঘর কাঁসা-পিতলের শিল্পকর্মে ভর্তি। দুই ঘরের মাঝখানে রাখা টেবিলে বিশাল দুটি দাবার বোর্ড। সেটির ওপর সৈন্য, ঘোড়া, রাজা—সবই পিতলের। ২০০ বছর ধরে কাঁসা-পিতলশিল্পের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সম্পৃক্ততা। বংশের পঞ্চম প্রজন্মের প্রতিনিধি তিনি। সুকান্ত আক্ষেপ করে বলেন, একটা সময়ে কাঁসার থালাই ছিল হরেক পদের। হরেক নামের। ব্যবহারবিধিতেও ছিল ভিন্নতা। কোনোটায় হয়তো ২০টি বাটি বসানো থাকত। নতুন জামাইকে খেতে দিত সেসব থালে। এখন সেই থালও নেই, কারিগরও নেই। কারিগরেরা চলে গেছেন বিকল্প জীবিকার সন্ধানে। ২০০৬ সালেও কাঁসাশিল্পী সুকান্তর কারখানায় কাজ করতেন ২২ জন কারিগর। বর্তমানে আছেন মাত্র পাঁচজন।
মন্দা অবস্থায়ও হাল ছাড়েননি সুকান্ত বণিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষে অন্য কোনো পেশায় না গিয়ে ঠিক করেন, পিতৃপুরুষের কাঁসা-পিতলই হবে তাঁর পেশা, নেশা ও ধ্যান। গৃহসজ্জামূলক প্রাচীন শিল্পকর্ম তৈরির দিকে গুরুত্ব দেন তিনি। ২০০১ সালে একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। তখন বিদেশিদের নিজের কাজ দেখানোর সুযোগ পান তিনি। ২০০২ সালে মার্কিন দূতাবাস থেকে কাঁসা-পিতলশিল্প সংরক্ষণের জন্য ১৪ হাজার ৩০০ ডলার অনুদান পান তিনি। সেই টাকায় তৈরি হয় একটি তথ্যচিত্র। ২০০৭ সালে সুইজারল্যান্ডে সেটি প্রদর্শিত হলে সাড়া পড়ে যায়।
সুকান্ত বণিকের ভাষ্যমতে, কাঁসা-পিতলের ব্যবহার উপযোগিতা অসামান্য। এক কেজি কাঁসার থালার দাম প্রায় ২ হাজার ৩০০ টাকা। এটা এককালীন বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করাই শ্রেয়। ত্রিশ-চল্লিশ বছর অবলীলায় ব্যবহার করে বিক্রির সময়ও দাম পাওয়া যায়। ভাঙা কাঁসার দামও প্রায় ৯৫০ টাকা কেজি। সম্পদ হিসেবেও এটি একসময় ব্যবহৃত হতো। শরৎচন্দ্র অথবা রবিঠাকুরের গল্পে অভাবের দিনে মানুষ কাঁসা-পিতলের জিনিস বাজারে বিক্রি করেছে। কাঁসা-পিতল তৈরির বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। কেউ পিটিয়ে কাজ করেন। কেউবা করেন পটারি কাজ। মাটির ছাঁচে করেন। আবার সেন্ড কাস্টিং কাজও আছে। বালুর মধ্যে ঢালাই করা হয়। কেউ লস্ট ওয়ার্ক্সে কাজ করেন। ধামরাইয়ে ছাঁচ তৈরি করে যে ভাস্কর্য তৈরি করা হয়, সেটিকে বলে লস্ট ওয়ার্ক্স পদ্ধতি। যে বিশেষ ভাস্কর্যটি তৈরি করা হবে, তার একটা অবয়ব তৈরি করা হয় মোম দিয়ে। অতঃপর তাতে নানান নকশা ও সূক্ষ্ম কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হয়। মোমের মূর্তির ওপরে চড়িয়ে দেওয়া হয় তিন স্তরের মাটির প্রলেপ। এরপর তা পোড়ানো হয়। মাটির ছাঁচে গলে যাওয়া তামা ঢুকিয়ে তৈরি করা হয় এই ভাস্কর্যগুলো। যেকোনো অবয়ব ফুটিয়ে তোলা সম্ভব এই ভাস্কর্যগুলোয়। এ পদ্ধতিতে প্রতিটি ভাস্কর্যই তাই অনন্য ও অসাধারণ। হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষার জন্য হলেও পদ্ধতিগুলো লিপিবদ্ধ হওয়া দরকার। এ কাজের জন্য তাই একটা জাদুঘর গড়ে তোলা প্রয়োজন। আগামী বছর নাগাদ নিজ বাড়িতেই কাঁসা-পিতলশিল্পের একটা জাদুঘর তৈরির স্বপ্ন দেখছেন সুকান্ত বণিক, যেখানে স্থান পাবে ঐতিহ্যের গৌরব।
এগিয়ে এসেছে এসডিআই
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘এসডিআই’ ধামরাইয়ের কাঁসাশিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক সামছুল হকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁরা এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পাশে আছেন। সর্বনিম্ন ৭০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ পর্যন্ত ঋণের ব্যবস্থা করেছেন। সাহা মেটাল, রাশেদা মেটালসহ আরও অনেকে তাঁদের কাছ থেকে পুঁজির জোগান পেয়েছেন। তাঁর অভিমত হলো, শুধু পুঁজির জোগানই এই শিল্প এগিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়; ক্রেতাদের রুচির বিষয়টিও এখানে জরুরি। ঐতিহ্য ধরে রাখায় ক্রেতার আগ্রহ কাঁসাশিল্পের প্রসারে ভূমিকা রাখবে।
অনেক শ্রম ও সময়ের বিনিময়ে কাঁসা-পিতলের সামগ্রীগুলো তৈরি হয়। দক্ষতার সংশ্লেষ থাকা সত্ত্বেও এই শিল্পের মজুরি বেশ কম। তাই কাঁসার দক্ষ কারিগর হয়ে যান ধান কাটার শ্রমিক বা রিকশাওয়ালা। অথচ বিশ্বব্যাপী ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতলের সামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা। বিশেষত, বিভিন্ন আকৃতির ও চরিত্রের মূর্তি বিদেশি ক্রেতাদের কাছে অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত।
ভারতসহ বিভিন্ন দূতাবাসে তাদের নিজস্ব পণ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার সুযোগ থাকলেও আমাদের দূতাবাসগুলো এ ব্যাপারে উদাসীন। অবশ্য সরকার শুধু এখাতে ভর্তুকি দিলেই চলবে না, জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। কাঁসা-পিতলের ব্যবহার বাড়াতে হবে। তবেই বাঁচবে এ শিল্প। ক্রেতার সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে এবং উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করা গেলে ধামরাইয়ের কাঁসাশিল্প হতে পারে বিশ্বমানের একটি ব্র্যান্ড। বিশ্ব তখন জানতে পারবে আমাদের মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার কথা।
*লেখক: হোসাইন মোহাম্মদ জাকি