ভারতবর্ষে চা আবিষ্কার, আবির্ভাব ও পানীয়রূপে চায়ের প্রতিষ্ঠালাভের বিষয়টি ইতিহাসের এক অনন্য সামাজিক উপাদান। লোককাহিনি অনুসারে, আকস্মিকভাবেই এই পানীয়টি আবিষ্কার করেছিলেন ২৭৩৭ খ্রিষ্ট–পূর্বাব্দে চীনের সম্রাট শেন নাং। তিনি বিশ্রাম নেওয়ার সময় একটি পাত্রে পানি গরম করা হচ্ছিল তাঁর ব্যবহারের জন্য। নিকটস্থ একটা গাছ থেকে হাওয়ায় উড়ে কিছু পাতা এসে ওই ফুটন্ত পানিতে পড়তে দেখেন তিনি। পানির রং তৎক্ষণাৎ বাদামি রূপ ধারণ করে। উষ্ণ পানির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি তার কিছুটা পান করে বেশ চনমনে বোধ করেন। সেই থেকে চা পানের রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে গোটা চীনে। আর সেখান থেকে পুরো বিশ্বে।
১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। এই চায়ের বড় ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হয় ব্রিটিশরা। কিন্তু বিনিময়মূল্যটা ছিল সোনা ও রুপায়। ফলে ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়।
১৭২১-১৭৬০ পর্যন্ত চা আমদানীর সর্বমোট পরিমাণ
সাল | পরিমাণ (পাউন্ড) | গ্রোথ রেট (%) | আর্থিক মূল্য (পাউন্ডে) |
১৭২১-৩০ | ৮৮৭৯৮৬২ | - | ৬১১৪৪১ |
১৭৩১-৪০ | ১১৬৬৩৯৯৮ | ৩১ | ৬০৭৪৬৯ |
১৭৪১-৫০ | ২০২১৪৪৯৮ | ৭৩ | ১০৫২৩৭৩ |
১৭৫১-৬০ | ৩৭৩৫০০০২ | ৮৫ | ১৬৯২৬৯৮ |
উৎস : দ্যা ট্রেডিং ওয়ার্ল্ড অব এশিয়া এন্ড দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী (১৬৬০-১৭৬০)
ব্যবসায় ঘাটতি মেটাতে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশরা চীনে আফিম রপ্তানি শুরু করে। নেশাগ্রস্ত যুবসমাজ ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য চীনা শাসকেরা ১৮৩৯ সালে আফিম আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অবৈধ উপায়ে এ ব্যবসা অব্যাহত রাখে। অবৈধ আফিম ব্যবসার কারণে চীন ও ব্রিটেনের মধ্যে দুই দফা যুদ্ধ হয়। যা ইতিহাসে ‘অপিয়াম ওয়ার’ নামে পরিচিত।
যুদ্ধের জের ধরে চীনের চায়ের বাজারে নিজেদের কর্তৃত্ব হারায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। গোয়েন্দাগিরির এক মারাত্মক ফন্দি আঁটে তখন ব্রিটিশরা। যা ইতিহাসে ‘ ব্রিটিশ টি রবারি’ নামে খ্যাত। রবার্ট ফরচুন নামে একজন স্কটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানীকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। চীনা পোশাক পরিয়ে তাঁকে বিদেশিদের জন্য নিষিদ্ধ চীনের এমন চা–অঞ্চলে পাঠানো হয়। ফরচুন গভীরভাবে সেখানে চা উৎপাদন পর্যবেক্ষণ করেন এবং যথেষ্ট পরিমাণ চায়ের বীজ নিয়ে ফেরত আসেন। করপোরেট গুপ্তচরবৃত্তির এই ঘটনা নিয়ে সাংবাদিক সারাহ রোজের লেখা ‘ফর অল দ্য টি ইন চায়না: হাও ইংল্যান্ড স্টোল দ্য ওয়ার্ল্ডস ফেবারিট ড্রিংক অ্যান্ড চেঞ্জড হিস্ট্রি’ (২০১০) একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। ফরচুনের কর্মকাণ্ডে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বইটির শুরুতে রোজ লিখেছেন ‘দ্য টাস্ক রিকয়ার্ড এ প্ল্যান্ট হান্টার, এ গার্ডেনার, এ থিফ, এ স্পাই’।
ফরচুন চীন থেকে শুধু বীজ এবং চারাই আনেননি, সঙ্গে করে একদল প্রশিক্ষিত চীনা চা–শ্রমিককেও ভাগিয়ে আনেন। নতুন পানি ও আবহাওয়ায় যৎসামান্য কিছু চারা বাঁচে। যা হোক, চীন থেকে আনা প্রযুক্তি ও জ্ঞান ভারতবর্ষে চা–শিল্পের সূচনা ত্বরান্বিত করে। ব্রিটিশদের এ চা চাষের প্রচেষ্টা কিন্তু ফরচুনের মাধ্যমে শুরু হয়নি। তারও বহু বছর আগ থেকে। কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের পূর্ণ মনোযোগ ছিল তখন চীনের বাজারে। যে কারণে ভারতবর্ষে চা চাষের সম্ভাবনাকে তাঁরা আমলে নেননি। অন্যতম দৃষ্টান্ত কোম্পানির উদ্ভিদতত্ত্ববিদ ড. এন ওয়ালিচ। আসামে পাওয়া চা–গাছকে তিনি বহুকাল স্বীকৃতি দেননি। ১৮৩৪ সালের মার্চ মাসে ‘কাছার’ এর সুপারিনটেন্ডেন্ট ফিসার, টি কমিটির সচিব জিটি গর্ডনকে লিখিতভাবে কাছারে চা–চাষের উপযোগিতা ব্যাখ্যা করেন। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে প্রায় ২০ বছর সময় নষ্ট হয়। ১৮৫৫ সালে কাছারের সুপারিনটেন্ডেন্ট জি ভার্নার, বেঙ্গলের সচিবকে চিঠি মারফত কাছারে চা চাষের অনুকূল বিষয়াদি সম্পর্কে অবহিত করে পুনরায় পত্র প্রেরণ করেন।
আসামে অবশ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তত্ত্বাবধানে পরীক্ষামূলকভাবে চায়ের আবাদ শুরু হয় তারও ১৮ বছর আগে ১৮৩৭ সালে। বাণিজ্যিক চা–বাগান স্থাপনের প্রস্তাব পাঠানোর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৩৯ সালে চা চাষের অনুমতি চেয়ে আবেদন করে লন্ডনের তিনটি ও কলকাতার একটি কোম্পানি। এই স্বতন্ত্র কোম্পানিগুলোকে একত্র করে ‘আসাম কোম্পানি’ নামের একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গঠিত হয়। পাহাড়ের আবহাওয়া চা উৎপাদনের অনুকূল বিবেচনায় সে সময় সিলেট, আসাম, কাছার, ডুয়ার্স ও দার্জিলিংকে চা উৎপাদনের জন্য প্রাধান্য দেওয়া হয়। চট্টগ্রামে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের প্রচেষ্টা নেওয়া হলেও সফলতা আসেনি। চা আবাদে কোম্পানিগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ছিল অবারিত দ্বার ও নানামুখী সুযোগ-সুবিধা।
১৮৫৪ সালে সিলেট অঞ্চলের মাঝে মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চা–বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। উনিশ শতকের শেষ ভাগে ভারতীয় চা-ই ইউরোপে চীনের চাহিদার ভিতকে একেবারে নড়িয়ে দিয়েছিল। নীলকরদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল এতৎঞ্চলের চা-কর, প্ল্যান্টার্স রাজ আর আড়কাঠিরা। দিনাক সোহানি কবিরের লেখা ‘পূর্ববাংলার রেলওয়ের ইতিহাস ১৮৬২-১৯৪৭’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৮৭৯ সালে ব্রিটেন ৩৪ মিলিয়ন পাউন্ড ভারতীয় চা আমদানি করে। একই সময়ে ব্রিটেন ১২৬ মিলিয়ন পাউন্ড চা আমদানি করে চীন থেকে। পরবর্তী এক দশকেই এ চিত্র পাল্টে যায়। ১৮৯০ সালে ব্রিটেন চীন থেকে ৫৭ মিলিয়ন পাউন্ড চা আমদানি করে। একই সময়ে ব্রিটেন ১০১ মিলিয়ন পাউন্ড চা আমদানি করে ভারত থেকে। পরবর্তী সময়ে ১৯১৫ সালে ১৮২ মিলিয়ন পাউন্ড ভারত থেকে কিন্তু মাত্র ১২ দশমিক ৭ মিলিয়ন পাউন্ড চীন থেকে আমদানি করে।
পানীয়রূপে চা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস পর্যালোচনায় সর্বাগ্রে আলোচিত হয় বাংলাদেশের বিক্রমপুরের কৃতী সন্তান অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের কথা। ১০৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বত ভ্রমণে গিয়ে তিনি চা পান করেছিলেন। শরৎচন্দ্র দাস রচিত ‘ইন্ডিয়ানস পণ্ডিতস ইন দ্য ল্যান্ড অব স্নো’ (১৮৯৩) গ্রন্থে দেখা যায়, তিব্বতের রাজার প্রতিনিধিকে পানীয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে অতীশ দীপঙ্করকে বলা হয়, ‘ইট ইজ কোল্ড চা (টি)। দ্য মঙ্ক অব তিব্বত অলসো ড্রিংক ইট।’ ১৭৯৩ সালে আপজন প্রকাশিত ইংরেজি-বাংলা অভিধানে ‘চা’ শব্দটির দেখা মেলে, আছে ‘চা-পানি’ শব্দটিও। এ ছাড়া ১৭৯৭ সালে প্রকাশিত জন মিলারের ‘শিক্ষাগুরু’ বইতে জনৈক সাহেবের দেওয়ান এবং চাকরের মধ্যকার সংলাপেও সাহেবের চা-পানের অভ্যাসের পরিচয় মেলে। উপমহাদেশে আসার পরও ইংরেজ সাহেবদের চা-পানের অভ্যাস যে বহালতবিয়তে অটুট ছিল, তা বোঝা যায় বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্সের ক্যাপ্টেন জর্জ ফ্রাঙ্কলিন অ্যাটকিনসনের আঁকা ছবি (১৮৬০) থেকে। যার শিরোনাম ‘স্টেশনের কর্নেল সাহেব’। ছবিটি দেখে বোঝা যায়, সাহেবকে চা পরিবেশন করা হচ্ছে। কারণ, কর্নেল সাহেবের বর্ণনার এক স্থানে লেখা, ‘মিসেস ক্যাপসিকাম (কর্নেলের স্ত্রী), আফটার হার মর্নিংস ড্রাইভ, হেজ ভ্যানিসড টু দ্য ইনহারমোস্ট রিসেস অব হার সিক্রেট চ্যাম্বার, টু কোর্ট রিপোজ অ্যান্ড সিপ টি আফটার দ্য ট্যারিফিক এক্সারশন।’ এ ছাড়া বইটিতে আরও চারবার চা পান ও টি-পার্টির বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
কালের পরিক্রমায় শৌখিন চা-পায়ী থেকে এ দেশের মানুষ এখন চায়ের নেশায় বুঁদ হয়েছে। দুধ চা, ‘র’ চা, লেবু চা, মরিচ চা, মাল্টা চা, তেঁতুল চা, শাহি চা, মসলা চা, মালাই চা, মটকা চাসহ হরেক পদের আরও চা পাওয়া যাবে দেশের আনাচকানাচে। ২০১৮ সালে দেশের ১৬৬টি বাগানে উৎপাদিত ৮ কোটি ২১ লাখ কেজি চাও অভ্যন্তরীণ ভোগের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে।
*হোসাইন মোহাম্মদ জাকি: গবেষক