আঙিনায় ঔষধি গাছ

আদাগাছ
আদাগাছ

করোনাকালে একটু কাশি-গলাব্যথা হলেই ভয় লাগে। আগেও এসব হতো, তখন করোনাভাইরাসের ভয় ছিল না। এ জন্য দুশ্চিন্তাও এসব নিয়ে এখনকার মতো হতো না। এক সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো একটু গলাব্যথা করছে, সঙ্গে হালকা কাশিও। গলাটা খুশ খুশ করছে। রোজ সকালে পুদিনাপাতা পিষে রস বের করে দুই চা-চামচ রসের সঙ্গে ৮-১০ ফোঁটা মধু মিশিয়ে খালি পেটে কয়েক দিন খেতেই সমস্যাটা চলে গেল। মন থেকে করোনার আশঙ্কাও কেটে গেল। এ রকম অনেক ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আমাদের গাছবন্ধুরা আমাদের ভালো রাখতে পারে। কত সহজেই এই পুদিনাপাতা মিলতে পারে। ঘরবাড়ির আঙিনায় বা টবে পুদিনাগাছকে একটু ঠাঁই করে দিলে কাশি-গলাব্যথার মতো এ রকম অনেক সমস্যা থেকে আমাদের সে ভালো রাখতে পারে।

দীর্ঘদিন অসুখে ভোগার পর সাধারণত কোনো কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। বিশেষ করে জ্বরের পরে। পেটে গ্যাস জমলেও এটা হয়। এই অরুচি দূর করতে পারে পুদিনাপাতা। পুদিনাপাতার শরবত বানিয়ে খেলে এই অরুচি ভাব চলে যায়। শরবত বানাতে হলে এক কাপ হালকা গরম পানিতে ২ চা-চামচ পুদিনাপাতার রস, সামান্য লবণ ও গোলমরিচের গুঁড়া এবং ৮-১০ ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে রোজ সকাল-বিকেল কয়েক দিন খেলে এই অরুচি ভাব চলে যায়। বদহজম বা পেট ফাঁপা থাকলে সেটাও কেটে যায়। শরীরের কোথাও হঠাৎ চুলকায়, অ্যালার্জির জন্য এটা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চুলকানো জায়গায় পুদিনাপাতার রস মেখে দিলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি গিঁটব্যথা থাকলে সেখানে পুদিনাপাতা বেটে মলমের মতো করে প্রলেপ দিয়ে রাখলে সেটা কমে যায়।

শিউলি
শিউলি

কাশির কথা যখন উঠলই, তখন শিউলির কথা আসবে না কেন? কাশি সারানো অনেক সময় বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কাশি হলে দুই চা-চামচ শিউলিপাতার রসের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা মধু বা আদার রস মিশিয়ে খেলে কাশিটা সেরে যায়। শিউলিপাতা বাটার সময় তার সঙ্গে ১-২টি গোলমরিচ দিয়ে বাটলে তাতে আরও ভালো কাজ হয়। জ্বর হলেও শিউলিপাতা কাজে লাগে অনেক সময়। ৬-৭টি শিউলিপাতা এক টুকরা আদার সঙ্গে বেটে বা ছেঁচে রস করে এক কাপ পানির সঙ্গে মিশিয়ে শরবতের মতো খেলে জ্বরে উপকার পাওয়া যায়।

এ ছাড়া শিউলিপাতা, নিমপাতা, তুলসীপাতা ও গোলমরিচ আধা লিটার পানিতে জ্বাল দিয়ে আধা কাপ হলে তা নামিয়ে ঠান্ডা হলে ছেঁকে সেই পানি খেলে জ্বর কমে যায়। এত সব ঝামেলা করতে না চাইলে এসবের টাটকা পাতার রস মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলেও পুরোনো জ্বর ভালো হয়ে যায়।

তুলসীগাছকে বলা হয় ভেষজ গাছের রানি বা কুইন অব হার্ব। অনেক রকমের তুলসী আমাদের দেশে আছে—বাবুইতুলসী, রামতুলসী, কৃষ্ণতুলসী, কর্পূরতুলসী, বনতুলসী ইত্যাদি। সব তুলসীগাছেরই আমাদের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখার অদ্ভুত এক প্রাকৃতিক শক্তি রয়েছে। তবে কৃষ্ণতুলসীর যেন একটু বেশি। কৃষ্ণতুলসীগাছের পাতা ও ডালপালার রং একটু কালচে বেগুনি। সবুজ ডাল-পাতার তুলসীটার নাম রামতুলসী বা তুলসী, শ্রীতুলসীও কেউ কেউ বলেন। নামে কী যায় আসে? দরকার তুলসীর কাছ থেকে উপকার নেওয়া। সর্দি-কাশি হলে গ্রামে অনেকে তুলসীপাতার রস মধু দিয়ে খেয়ে উপকার পায়। সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে এলে শুকনা তুলসীপাতা গুঁড়া করে কাপড়ে পুঁটলি বেঁধে নাকের কাছে এনে টানলে সমস্যাটা চলে যায়। গলাব্যথা হলে তুলসীপাতা পানিতে সেদ্ধ করে ছেঁকে চায়ের মতো পান করলে গলাব্যথা কমে। গরম–গরম তুলসীর পানি দিয়ে গরগরা বা গার্গল করলেও গলাব্যথায় বেশ উপকার পাওয়া যায়।

তুলসি
তুলসি

হঠাৎ পিঁপড়ে-বিছে কামড়ালে বা মৌমাছি হুল ফোটালে যন্ত্রণা হয়। যন্ত্রণায় জায়গাটায় তুলসীপাতার রস মেখে দিলে দ্রুত সেটা চলে যায়। তুলসীপাতা শিশুদের সর্দি-কাশিতেও উপকারী। তুলসীপাতার আরেক ক্ষমতা রয়েছে—তুলসীপাতা মুখের ভেতরে দাঁতের ক্ষত ও মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ৯৯ শতাংশ ধ্বংস করতে পারে, দাঁতের ক্ষয় কমায়। শুকনা তুলসীপাতার গুঁড়া দিয়ে রোজ সকালে দাঁত মাজলে এ ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়। শুকনা গুঁড়া সামান্য শর্ষের তেলে মিশিয়ে টুথপেস্টের মতো ব্রাশ দিয়ে বেশ কিছুদিন দাঁত মাজলে পাইওরিয়া সেরে হয়ে যায়।

পুদিনাপাতার শরবত
পুদিনাপাতার শরবত

স্বাস্থ্য ভালো রাখার আর একটি গাছ হলো আদা। সর্দি,–কাশি, জ্বর, বদহজম, অজীর্ণ, দাঁতে ও মুখে সংক্রমণ, বসন্ত ইত্যাদি শত রকমের অসুখ-বিসুখ সারাতে পারে আদা। ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি হলে আদার মতো উপকারী বন্ধু এ জগতে আর কেউ নেই। এক টুকরা আদা কুচি কুচি করে কেটে পানিতে সেদ্ধ করে সেই পানিতে চা বানিয়ে পান করলে দারুণ উপকার পাওয়া যায়। এর সঙ্গে একটু মধু আর লেবুর রস মিশিয়ে খেতে পারলে তো আর কথাই নেই। এমনকি কাশি চলতে থাকলে শুধু আদা চিবিয়ে খেলেও উপকার মেলে।

এ রকম প্রায় ৫০০ রকমের গাছপালা আমাদের দেশে রয়েছে, যেগুলো আমাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারে। এসব গাছপালা কিন্তু আমাদের হাতের কাছে সব সময় থাকলে উপকার পেতে সুবিধা হয়। পুদিনা, তুলসী, আদা, শিউলি, পাথরকুচি, থানকুনি ইত্যাদি গাছ বাড়িতে রাখতে পারি। বাজার থেকে কিনে আনা পুদিনাপাতা গাছের একটু শক্ত ডালের টুকরা একটি টবের মাটিতে গিঁটসহ পুঁতে দিলে দেখবেন কয়েক দিনের মধ্যেই তা বেঁচে গেছে। মাস দুয়েকের মধ্যে দেখবেন সেসব গাছ বেড়ে টব ভরে ফেলেছে। ছায়া বা আধো ছায়া জায়গা হলেও অসুবিধে নেই, টবের মাটিটা শুধু ভেজা ভেজা রাখতে হবে। বাড়ির আঙিনা, ছাদের বাগানে বা ব্যালকনিতে টবে পুদিনা, আদা, তুলসী—এসব গাছ সহজেই জন্মে।

লেখক: কৃষিবিদ