সাধ্যের বাইরে উপহার কেনা নয়
উপহার দেওয়া সামাজিকতারই অংশ। যেকোনো উৎসবে, যেকোনো আয়োজনে উপহার কেনা হয়। অনেক সময় নিজের অবস্থান বোঝাতে প্রতিযোগিতায় নেমে যান অনেকেই। সাধ্যের বাইরে গিয়েও কেনেন দামি উপহার, যার চাপ সইতে হয় পরে। উপহারে আন্তরিকতা ও ভালোবাসার প্রকাশটাই আসল।
সুমা আর রাতুলের (ছদ্মনাম) টোনাটুনির সংসার। রাতুলের আয়ে ভালোই চলে যায় দুজনের। তবে এই সুখের সংসারে টানাপোড়েন শুরু হয় সুমার খালাতো বোনের বিয়েকে কেন্দ্র করে। সুমার ইচ্ছে, বোনকে সোনার হার ও দুল কিনে দেওয়ার। না হলে বাপের বাড়িতে তাঁর মান থাকবে না। তিনি নিজেই ভেবে নেন স্বামীর যেমন চাকরিতে অনেক মান-সম্মান, তেমনি বেতনও ঢের বেশি। অথচ রাতুলের সে সংগতি নেই। আবার বউকে বোঝাতেও পারেন না তিনি। শেষে সংসারে শান্তি ধরে রাখতে ধারদেনা করেই উপহার কেনেন। এর জেরে বেশ কিছুদিন হাত চেপে চলতে হয় রাতুলকে।
উপহার এখন যেন নতুন রূপ নিয়েছে। আজকাল অনেক পরিবারেই উপহার হিসেবে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণটা হয় সামর্থ্যের বাইরে। রায়হান রশিদ (ছদ্মনাম) শিক্ষকতা করে বেতন পান হাজার তিরিশেক। কোনোমতে টানাটানি করে তিনজনের সংসার চালান তিনি। বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়। এর মধ্যে ভাইয়ের বিয়েতে তাঁকে দিতে হলো এক লাখ টাকা। জাঁকজমক করে অনুষ্ঠান করতে এই উপহার তাঁর বাবাই দাবি করেন তাঁর কাছে।
মানুষ খুশি হয়ে, ভালোবেসে যদি কাউকে কিছু দেয়, সেটা হয় উপহার। কিন্তু উপহার যখন দায়ে পড়ে দিতে হয়, তখন খুশি উবে যায়, ভর করে রাজ্যের বিরক্তি। মান রক্ষা করতে সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে বাজেট করলে সেই বাড়তি বোঝা তো উপহারদাতাকেই বহন করতে হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, আমন্ত্রণকারী আশা করেন দামি উপহার পাওয়ার। আর এই প্রত্যাশার চাপ পড়ে অতিথির ওপরই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী রাজিন সালেহ বলেন, ‘প্রতি মাসেই কোনো না কোনো অনুষ্ঠান থাকে। উপহারের ওপর নিজের নাম লেখা থাকে আবার অনুষ্ঠানেও আলাদা টেবিল রাখা হয় উপহার নেওয়ার জন্য। অনেক বাড়িতেই অনুষ্ঠান শেষে সবাই মিলে উপহার খোলেন। কার সামর্থ্য কেমন আর কে কী দিল?—এ নিয়ে চলে আলোচনা–সমালোচনা। উপহার কেনার সময় এগুলোই মাথায় ঘুরপাক খায়। বড় অঙ্কের বাজেট ধরেই উপহার কিনি। পরে এর চাপ গিয়ে পড়ে মাসের বাসাভাড়া, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যয়ে। কষ্ট হলেও সামাজিকতা রক্ষা করতে হয়। উপায় কী?’
তবে এর ব্যতিক্রম যে হয় না, তা নয়। অনেকেই অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্রে উপহার না আনার কথা নির্দিষ্ট করে দেন। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, অতিথিকে কেবল আপ্যায়িতই করতে চাই।
দোয়া-আশীর্বাদের বদলে উপহার এখন অনেকটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। অনেকেই হিসাব করেন খরচ কত হলো আর উপহার উঠল কত টাকার। অনেকেই আবার অনুষ্ঠানের খাবারের তালিকা জানিয়ে দেন। যেন বুঝেশুনে উপহার নিয়ে আসেন অতিথি। অনেক পরিবারে তালিকা করে বলে দেওয়া হয় কাকে কী দিতে হবে। সামর্থ্য না থাকলেও আপত্তি করার উপায় থাকে না উপহারদাতার। আবার দামি উপহার দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাই অনুষ্ঠানেই যান না অনেকে। একজন জানালেন, বন্ধুর বোনের বিয়েতে ‘গ্লাস সেট’ উপহার দিয়েছিলেন তিনি। পরে তাঁর এক অনুষ্ঠানে ওই বন্ধু ওই ‘গ্লাস সেট’ নিয়েই হাজির হন। এমনকি উপহারের ওপর লেখা নামটাও ঠিকমতো কাটেননি তিনি। সামাজিক বিকলাঙ্গ পরিস্থিতির কারণে মনের মধ্যে এই জটিল সমীক্ষার তৈরি হয় বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি আর্থিক সংকটে সাংস্কৃতিক অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রেই তারা মননশীল জগৎ নিয়ে ভাবে না। প্রদর্শন করার বিষয়টি পেয়ে বসে। যাঁরা উপহার নিচ্ছেন, যাঁরা দিচ্ছেন, দুই পক্ষের মধ্যেই একটা প্রদর্শন করার মনোভাব দেখা যায়। একটা অসুস্থ সামাজিক পরিমণ্ডলে অসুস্থ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ হয়।
উপহার তখনই কাউকে দেওয়া হয়, যখন ওই সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আত্মার মিল থাকে। দায়ে পড়ে বা বাধ্য হয়ে কিছু দেওয়া হলে তা আর উপহার থাকে না। সবার আগে ঠিক করে নিতে হবে কত টাকার মধ্যে উপহারটি কিনতে চাচ্ছেন। তা কি আপনি আপনার সাধ্যের মধ্যে? এই খুঁটিনাটি বিষয়গুলো উপহার কেনার আগে হিসাব করে বাজেট এবং উপহার দুটিরই সমন্বয় করতে হবে।
মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, সবাই সবার সামর্থ্য বুঝে উপহার দেবেন। কার জন্য কোন ধরনের জিনিস উপযোগী, সেটা ভেবে দেওয়া যায়। নতুন সংসারের জন্য এক রকম, জন্মদিনে এক রকম, শিশুর জন্য এক রকম। তবে পুরো বিষয়টিই থাকবে সহনশীল পর্যায়ে। ভালোবেসে, কারও মঙ্গল চেয়ে যা দেওয়া হয় তা–ই উপহার, এটাই এর সংজ্ঞা। সামাজিক দৈন্য পেছনে ফেলে নিজের আয় বুঝেই উপহার দিতে হয়।