পড়লে, জানলে ভালো লেখা সম্ভব

প্রথম আলো কার্যালয়ে শর্মিলা বসুঠাকুর। ছবি: কবির হোসেন
প্রথম আলো কার্যালয়ে শর্মিলা বসুঠাকুর। ছবি: কবির হোসেন
>

একটি রান্নার প্রতিযোগিতার বিচারক হয়ে ঢাকায় এসেছেন কলকাতাভিত্তিক ম্যাগাজিন সানন্দারসদ্য সাবেক সম্পাদক শর্মিলা বসুঠাকুর। ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয় ঘুরতে আসেন ২০ এপ্রিল। সে সময় তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের ফ্যাশন, মানুষ—এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের কথা উঠে আসে অধুনার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৌহিদা শিরোপা

মাত্র ১৫ দিন আগে তিনি তাঁর ১৫ বছরের চেনা পরিবেশ সানন্দারসম্পাদকের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। অবসরের পরপরই ঢাকায় এসেছেন—একদিকে কাজ, অন্যদিকে বিক্রমপুরের মালখানগরের পৈতৃক বাড়ি দেখার ইচ্ছা। ‘এর আগেও ঢাকায় এসেছি। অনেক বন্ধুবান্ধব আছে আমার এখানে। একটা রান্নার প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে এসেছি। কাজ তো হচ্ছেই, একটার পর একটা নেমতন্ন চলছে।’ প্রথম আলোরকার্যালয়ে শর্মিলা বসুঠাকুর বলেন তাঁর ঢাকায় আসার কারণ।

পৈতৃক বসতভিটায় গিয়ে তিনি আপ্লুত হয়েছেন। যে পুকুরে তাঁর বাবা গোসল করতেন, সেটা দেখে ফেসবুকে আবেগঘন একটি স্ট্যাটাসও লেখেন। আগেও ঢাকায় এসেছেন, তবে এবারই প্রথম পয়লা বৈশাখ কাটানোর সুযোগ হয়। অনেকবার ভেবেছেন পয়লা বৈশাখে আসবেন, কিন্তু সময় মেলেনি। এবার যখন মিলল, তাই হাতছাড়া করলেন না। ভোরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান দেখেছেন, দুপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে পান্তাভাত, ভর্তা, ইলিশের জম্পেশ খাওয়াদাওয়া চলেছে। সবই তিনি খুব উপভোগ করেছেন।

‘সানন্দা’, স্টাইল ও সাংবাদিকতা

কীভাবে এতগুলো বছর কেটেছে তাঁর ওখানে, বুঝতেই পারেননি। চোখের পলকে যেন কেটে গেল। পুরো আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসটাই খুব সুন্দর মনে হয় তাঁর কাছে। সেখানে একটি তলায় সানন্দার দল কাজ করে। ‘আপাতভাবে আমাকে অনেকে রাগী মনে করেন, কাজের সময়ে অনেক সময় রাগও করেছি। কিন্তু আমাদের টিমওয়ার্কটা খুব ভালো ছিল। অনেকের কাছে খুব ক্লিশে শোনাতে পারে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা একটা পরিবার ছিলাম। কাজের বাইরেও প্রত্যেকের পারিবারিক সুখে–দুঃখে একে অন্যের পাশে থাকি। সানন্দারসফলতার মূলে মনে হয় এটাও একটা কারণ। সবাই মিলে আলোচনা করে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে আমরা কী চাইছি, সেটা খুব ভালোভাবে আদায় করা যায়,’ বলেন শর্মিলা।

১৫ বছর আগে জ্যেষ্ঠ পদে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, তার আগে লেখালেখি করতেন সেখানে। শর্মিলা বসুঠাকুর নিজে একজন শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী, সে কারণে নাচ–গান, মিউজিকের পর্যালোচনা লিখতেন। একসময় কলেজে অধ্যাপনার চাকরিটা বাদ দিয়ে পুরোদস্তুর এই চ্যালেঞ্জিং পেশা বেছে নিলেন। ফিচার লেখার কাজটা তাঁর আগে থেকেই ভালো লাগত।

ভালো লিখতে হলে কোন গুণ থাকতে হবে, আপনি কী মনে করেন? উত্তরে শর্মিলা বসুঠাকুর বলেন, ভাষার দখল,লেখার মুনশিয়ানা ও প্রচুর পড়ার অভ্যাস বেশি জরুরি। পড়ার কোনো বিকল্প নেই। অনেক পড়লে, জানলে ভালো লেখা সম্ভব। নানা ধরনের লেখা পড়তে পড়তে নিজের লেখার একটা ঋদ্ধ প্রেক্ষিত তৈির হয়। লেখার মুনশিয়ানা থাকলে বহু চরিত্র, বিষয়ও নতুন হয়ে উঠতে পারে। ধরুন, সবাই তো দার্জিলিং যায়, একই বিষয় প্রতিবছর, প্রতি মৌসুমে দিতে হয়, তখন প্রতিবার আলাদা করবেন কীভাবে। তখন একমাত্র লেখা ও দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা করতে পারে। তখন লেখার ইন্ট্রো (সূচনা) ও শিরোনাম যদি অন্য রকম দেওয়া যায়, ভেতরটা যদি মুচমুচে হয়—সবাই তো পড়বেই। অনেকেই আজকাল বলে, বড় লেখা কেউ পড়তে চায় না। সেটা হয়তো কিছু ক্ষেত্রে সত্য, কিন্তু আপনি যদি ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে পারেন, তাহলে অবশ্যই পড়বে, পড়ে। আমার অভিজ্ঞতা তেমনই বলে।

যে সময়টায় তিনি এই সানন্দায়এসেছিলেন, সেই ২০ বছর আগে তাঁর স্বামী হঠাৎ মারা যান। একমাত্র মেয়েকে একা বড় করা আর নিজেকে এগিয়ে নেওয়া—দুটোই কঠিন ছিল তাঁর কাছে। অনেকে বলেছিলেন, সাংবাদিকতার কাজে দিনরাত নেই, কলেজের নিশ্চিন্ত চাকরি, এই সময় মেয়েকে দেওয়া উচিত। তিনি শুধু নিজের মনের কথা শুনেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল, আরও বেশি কাজে যুক্ত হলে মানসিক চাপ কমবে।

হয়েছেও তা–ই। একটি প্রশ্ন আপনার কাছে—এখন তো ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের যুগ, যেকোনো তারকা বা দেশ–বিদেশের ফ্যাশন–স্টাইলের খবর দ্রুত সবাই মুঠোফোনে দেখতে পায়। এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে নিয়েছেন?

সানন্দা ম্যাগাজিন
সানন্দা ম্যাগাজিন

‘খুব ভালো প্রশ্ন। সত্যিকারভাবে এটা একটা চ্যালেঞ্জ, ইতিবাচকভাবে দেখলে এটা কিন্তু কাজেও লাগছে। সব নামীদামি, দেশি–বিদেশি ডিজাইনার, তারকারা কে কী পরছেন, কী ডিজাইন হচ্ছে, তৎক্ষণাৎ দেখে আমরা নিজেদের আইডিয়া সমৃদ্ধ করতে পারছি। চ্যালেঞ্জ হলো, নতুন কী দেব? আগে বলেছিলাম, প্রতিবেদনের আইডিয়ায় অভিনবত্ব, উপস্থাপনে নিখুঁত নৈপুণ্য আর লেখার মুনশিয়ানা এখানে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগাতে হবে।’

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তিনি প্রথম আলোরমঙ্গলবারের ক্রোড়পত্র নকশা ও বুধবারের অধুনা উল্টেপাল্টে দেখলেন। তাঁর কাছে ভালো লেগেছে জানালেন। বললেন, ভালো করার চ্যালেঞ্জ আসলে প্রতিদিনের। একবার ভালো করে থেমে গেলে হবে না।

ঢাকায় যাঁর বাসায় উঠেছেন, তিনি আফরোজা নাজনীন, নকশার রান্নাবিদ, তাঁর সুবাদে নকশার সঙ্গে তিনি আগেই পরিচিত।

দর্শন, ভ্রমণ এবং...

লেখাপড়ায় তিনি বরাবরই খুব ভালো। দর্শনশাস্ত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন শর্মিলা বসুঠাকুর। বিএ, এমএতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, পুরো অনুষদে প্রথম। এটা শুনে তাঁর কাছে একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না। অনেকের ধারণা থাকে, যাঁরা লাইফস্টাইল নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা মনে হয় সারাক্ষণ সাজগোজ করেন, তাঁদের অত মেধা থাকে না। কিন্তু আপনি তো লেখাপড়ায় স্কলার, জ্ঞানী—কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সানন্দায়কাজ করতে এলেন, আপনাকে কখনো এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে? বেশ একচোট হেসে নিলেন। বললেন, ‘এ তো সত্য কথা বলেছ। খুবই ভালো প্রশ্ন। বহুবার মুখোমুখি হয়েছি এমন কথার, বিশেষ করে শুরুর দিকে। এটা আসলে একটা ভ্রান্ত ধারণা, সুপারফিশিয়াল ভাবনা। সব কাজেই মেধা, বুদ্ধি, দক্ষতা আর পরিশ্রম লাগে। তা ছাড়া শিল্প, সাহিত্য, রান্না, সাজপোশাক, বেড়ানো, স্বাস্থ্য—সব নিয়েই তো একটা গোটা জীবন। কাজের মাধ্যমে তার সঙ্গে জুড়ে থাকাতে কোনো মালিন্য নেই। বরং লেখাপড়ায় ভালো হলে, ভেতরে জ্ঞান থাকলে কাজটা আরও সুনিপুণভাবে করা যায়।’

তিনি ঘুরতে খুব ভালোবাসেন। আর সেই ভালো লাগা থেকেই অন্যদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার বিশেষ পরিকল্পনা। নিজের একটা ট্রাভেল এজেন্সির মতো আছে। এখন সেটা নিয়ে ভাববেন। ভালো রাঁধেন, খেতে ভালোবাসেন। তাই বাড়িতে ইতালিয়ান পপ–আপ রেস্তোরাঁ করেছেন। আগে থেকে বুক করে আসলে নানা রকম খাবার চেখে দেখার সুযোগ রয়েছে এখানে। এত দিন নিজের পোশাক নিজেই নকশা করতেন। সেই বুটিকটাও আরও বড় পরিসরে করবেন, তেমনই পরিকল্পনা। আর লেখালেখি তো চলবেই। অবসর নিলেও অবসর আর মিলল কই!