সচেতনতার বার্তা হাতে

এমন সচেতনতামূলক কথা লেখা প্ল্যাকার্ড হাতেই পথে দাঁড়ান মোখলেসুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
এমন সচেতনতামূলক কথা লেখা প্ল্যাকার্ড হাতেই পথে দাঁড়ান মোখলেসুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
>

‘যাত্রাপথে সতর্ক হোন, ঈদের আনন্দ যেন বেদনা না হয়’, ‘বাসচালক-মোবাইলে কথা বলা এবং ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকুন’। এমন নানা সচেতনতামূলক প্ল্যাকার্ড হাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় মোখলেসুর রহমানকে। জানা যাক এই তরুণের কথা।

রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে ঈদের ছুটিতে বাড়িমুখী মানুষের ঢল। একের পর এক ছেড়ে যাচ্ছে দূরপাল্লার বাস। বাসের ভেতরে মানুষ, ছাদে মানুষ। কষ্ট-ক্লান্তির মধ্যেও তাঁদের চোখে প্রিয়জনের কাছে ফেরার আনন্দ। মুহূর্তের অসচেতনতায় এই আনন্দ চির বিষাদে পরিণত হতে পারে। তবে কিছুটা সচেতন হলেই এড়ানো যেতে পারে সড়ক দুর্ঘটনা; ছিনতাইকারীর হাত থেকে সর্বস্বান্ত হওয়ার মতো ঘটনা।

এমন সব দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদে থাকতে সচেতনতামূলক কথা প্ল্যাকার্ডে লিখে টার্মিনালের টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন তরুণ। গায়ে লাল-সবুজ টি-শার্ট, মাথায় বাঁধা লাল-সবুজ পতাকা। গলার কাছে টি-শার্টের সঙ্গে ক্লিপ দিয়ে ঝোলানো একটি এবং দুই হাতে দুটি করে চারটি প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা—‘যাত্রাপথে সতর্ক হোন, ঈদের আনন্দ যেন বেদনা না হয়’, ‘বাসচালক—মোবাইলে কথা বলা এবং ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকুন’।

তরুণের নাম মোখলেসুর রহমান। তেজগাঁও কলেজের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। বাড়ি কিশোরগঞ্জে। কথায় কথায় জানা যায়, শুধু গাবতলী বাস টার্মিনালেই নয়, ঈদ বা অন্য কোনো উৎসবের সময়ে কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট লঞ্চঘাটেও এ রকম সচেতনতামূলক প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ান তিনি। মোখলেছুর বলেন, ‘২০১৩ সালে যখন দেশব্যাপী পেট্রলবোমায় আক্রান্ত হচ্ছিল নিরীহ মানুষ। পত্রিকা ও টেলিভিশনে দেখতাম সেই বীভৎস দৃশ্য। একদিন গেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বার্ন ইউনিটে দেখলাম মানুষের অসহনীয় কষ্ট। সেদিন সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে ভাবছিলাম, কী করা যায়! তারপর মনে হলো, শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে আমার বক্তব্য মানুষকে, রাষ্ট্রকে জানানো যায়।’ বিবেকের তাড়নায় নেমে পড়লেন রাস্তায়। 

আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে পথে দাঁড়ান
আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে পথে দাঁড়ান


প্ল্যাকার্ডে প্রতিবাদ
শুরুটা করেছিলেন রিকশা-ভ্যানগাড়ি নিয়ে। ভ্যানের চারপাশে স্লোগানভর্তি প্ল্যাকার্ড, পতাকা-প্ল্যাকার্ড আর শান্তির প্রতীক সাদা পায়রা হাতে মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি। মাইকে বাজছে দেশের গান। জানালেন, গত পাঁচ বছরে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। খাদ্যে ভেজাল, মানব পাচার, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, শিশুশ্রম-শিশুহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা, বিদেশি চ্যানেল বয়কট, ডেইলি স্টার-প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ, জিএসপি পুনর্বহাল, ময়লার ঝুড়ি ব্যবহার, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভাষা বিকৃতি রোধ—এ রকম প্রায় শতাধিক ইস্যু উঠে এসেছে তাঁর প্ল্যাকার্ডে-স্লোগানে। মোখলেসুর রহমান যেন নিঃসঙ্গ প্রতিবাদী।

পড়াশোনা, সংসার এবং একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি—সবকিছু সামলে একা একা লড়ে যাচ্ছেন এই নিঃসঙ্গ প্রতিবাদী। কোনো পৃষ্ঠপোষকতা-প্রণোদনা নয়, নিজের উপার্জিত আয়ের একটি অংশ থেকেই এই নিঃসঙ্গ আন্দোলনের ব্যয় নির্বাহ করে যাচ্ছেন। কেন ঘরে খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন মোখলেসুর। বললেন, ‘আমরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ না তাড়ালে, বনের মোষ এসে তো আমাদের ঘর থেকে তাড়িয়ে দেবে।’

ঢাকা শহরের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্ল্যাকার্ড হাতে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। পুলিশি বাধা, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বাধা কিংবা মানুষের কটূক্তি; কোনো কিছুই হতোদ্যম করতে পারেনি তাঁকে। 

জাদুর পাঠশালা
জাদুর পাঠশালা


জাদুর পাঠশালা
মোখলেসুর মনে করেন, সমৃদ্ধ-সুন্দর দেশ গড়তে মনোযোগ দিতে হবে শিশুদের প্রতি। আজকের শিশুরাই আগামীর নেতৃত্ব দেবে। তাদের সুশিক্ষিত করে তুলতে হবে। যে শিশুটি শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে, তাঁর ভাবনা তাকে নিয়ে নয়। মোখলেসুরের ভাবনা শিক্ষা-সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে। তাই শুধু অসংগতিগুলো তুলে ধরাই নয়, ব্যক্তিপর্যায় থেকে যতটা সম্ভব কাজ শুরু করেন তিনি। ২০১৩ সালে লালমাটিয়ার বস্তির শিশুদের পড়ানোর উদ্যোগ নেন। নির্ধারিত স্থান না থাকায় কখনো ছাদের ওপর, কখনো রাস্তার পাশে খালি পড়ে থাকা পিকআপ ভ্যানে কিংবা কখনো রাস্তার পাশে চলছে তাঁর এই ভাসমান পাঠশালা। শিশুরা আসতে চায় না বলে তিনি কতগুলো জাদু শিখেছেন। পড়ানো শেষে এসব জাদু দেখিয়ে পরবর্তী ক্লাসের জন্য আগ্রহী করে তোলেন। মাঝেমধ্যে শিশুদের জন্য চকলেট-চুইংগাম নিয়ে যান। আয়োজন করেন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার। নিজস্ব তহবিল থেকেই ব্যবস্থা করেন ছোটখাটো পুরস্কারের। 

জরুরি প্রয়োজনে—‘ইমারজেন্সি হেল্প ট্রাস্ট’
জরুরি প্রয়োজনে—‘ইমারজেন্সি হেল্প ট্রাস্ট’

জরুরি প্রয়োজনে—‘ইমারজেন্সি হেল্প ট্রাস্ট’
আড়াই হাজার টাকার একটি ছোট্ট তহবিল আছে মোখলেসুরের। তিনি নাম দিয়েছেন—ইমারজেন্সি হেল্প ট্রাস্ট। অনেকেরই হুটহাট স্বল্প টাকার প্রয়োজন হয়। তাড়াহুড়ো করে এই স্বল্প টাকাটাও অনেক সময় পাওয়া যায় না। এমন ভীষণ প্রয়োজনের জন্য এই তহবিল। বন্ধুবান্ধব-পরিজনদের বলে দেওয়া আছে। প্রয়োজনের সময় ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকার সহায়তা পাওয়া যাবে এখান থেকে। টাকাটা ফেরতযোগ্য। মোখলেসুর বলেন, ‘আমি মূলত জরুরি প্রয়োজনে ধার দেওয়ার জন্যই এই তহবিল গঠন করেছি। আমি কখনোই এই আড়াই হাজার টাকা থেকে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে খরচ করি না।’

অগ্রগতিহীন সুন্দর সমাজের স্বপ্ন নিয়ে নিঃসঙ্গ যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন মোখলেসুর, একদিন তা ছড়িয়ে যাবে দেশের সব তরুণের মধ্যেও। তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন তাঁর পাশে এসে পাশে দাঁড়াবে অনেকে। যূথবদ্ধ প্রচেষ্টায় নির্মিত হবে সুন্দর আগামী।