আর্মেনীয় গণহত্যার ১০০ বছর
আজ ২৪ এপ্রিল, সারা বিশ্বের আর্মেনীয় জনগোষ্ঠী তাঁদের স্বজনদের গণহত্যার শতবর্ষপূর্তি পালন করবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান তুর্কিদের হাতে বহু আর্মেনীয় নিহত হয়। আর্মেনীয়রা একে গণহত্যা আখ্যায়িত করলেও তুরস্ক এ ব্যাপারে বরাবর তীব্র আপত্তি জানিয়ে আসছে। আর্মেনীয় ‘গণহত্যা’র বিস্তারিত তুলে ধরা হলো
কয়েক শতাব্দীর পারস্য ও বাইজানটাইনের শাসনের পরে ১৯ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ রুশ ও তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যে বাস করছিল আর্মেনীয়রা। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের ধারণা অনুযায়ী, অটোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে ১৭ থেকে ২৩ লাখ আর্মেনীয় বাস করত। ১৯ শতকের শেষের দিকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে অটোমান কর্তৃপক্ষ আনুগত্যের প্রশ্নে আর্মেনীয়দের সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, অটোমান শাসক সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের রাজত্বকালে এক থেকে তিন লাখ আর্মেনীয়কে হত্যা করা হয়। ১৯০৫ সালে আর্মেনীয়রা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদকে হত্যার চেষ্টা করে। তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান।
১৯১৪ সালে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের পক্ষ নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয় তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্য। যুদ্ধ চলাকালে অটোমান কর্তৃপক্ষ আর্মেনীয়দের ‘ঘরের শত্রু’ বলে প্রচারণা চালাতে থাকে। ১৯১৫ সালের ২৪ এপ্রিল অটোমান সরকারের শত্রু বলে সন্দেহে আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের কয়েক শ নেতা ও বুদ্ধিজীবীকে কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বন্দী করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁদের বেশির ভাগকেই হত্যা ও নির্বাসিত করা হয়। আর্মেনীয়রা এই ২৪ এপ্রিল দিনটিকেই গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দুটি আইনের মাধ্যমে আর্মেনীয়দের নির্বাসিত ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তখন হাজার হাজার আর্মেনীয়কে মরুভূমির দিকে (বর্তমান সিরিয়ায়) পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে যারা বেঁচে যায়, তাদের ২৫টি বন্দিশিবিরে নেওয়া হয়। তখনকার বিদেশি কূটনীতিক ও গোয়েন্দা সংস্থার মতে, আগুনে পোড়ানো, পানিতে ডোবানো, বিষপ্রয়োগ এবং টাইফয়েড সংক্রমিত করাসহ বিভিন্ন নৃশংস পদ্ধতিতে আর্মেনীয়দের হত্যা করা হয়। ১৯১৮ সালের ৩০ অক্টোবর অটোমান সাম্রাজ্য মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে নির্বাসিত আর্মেনীয়দের তাদের বাড়িতে ফিরে আসার ব্যবস্থা রাখা হয়।
১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কনস্টান্টিনোপলের সামরিক আদালত আর্মেনীয়দের হত্যাসহ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অটোমান সাম্রাজ্যের কয়েক শীর্ষ কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন। আদালত তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেন। তবে যাঁরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের বিচার করা যায়নি।
আর্মেনীয়রা বলে থাকে, ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে তাদের ১৫ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। আর্মেনীয়রা দীর্ঘদিন থেকে ওই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য চাপ দিয়ে আসছে। আর্মেনিয়ার বৈদেশিক নীতির মূল লক্ষ্যই এটা। তবে কিছু বিশ্লেষকের মতে, এটি তুরস্কের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় এবং সম্ভাব্য ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের অধিকার লাভের বড় কৌশলেরই অংশ।
অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি রাষ্ট্র তুরস্ক আর্মেনীয়দের হত্যা ও নির্বাসনকে উভয় পক্ষের জন্য রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের ফল হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। আঙ্কারার দাবি, আর্মেনীয়রা যখন রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে অটোমান সরকারের বিরুদ্ধে তৎপর হয়, তখন গৃহযুদ্ধে তিন থেকে পাঁচ লাখ আর্মেনীয় ও একইসংখ্যক তুর্কি মারা যায়।
২০০০ সালে নোবেল বিজয়ী, ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানীসহ ১২৬ জন বিশেষজ্ঞ এক বিবৃতিতে বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আর্মেনীয় গণহত্যা একটি অকাট্য ঐতিহাসিক ঘটনা। ২০০৫ সালে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কাছে এক খোলা চিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স বলেছিল, তথ্য-প্রমাণে এটা প্রমাণিত যে অটোমান সরকার ‘তাদের আর্মেনীয় নাগরিকদের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা’ চালায়।
রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গত বছর প্রথমবারের মতো এ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এটা আর্মেনিয়া ও তুরস্কের অভিন্ন ব্যথা। তবে আর্মেনিয়া এটি নাকচ করে দিয়েছে।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের গণহত্যাবিষয়ক কনভেনশনে গণহত্যার সংজ্ঞায় বলা হয়, কোনো জাতি, নৃগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে পুরোপুরি বা আংশিক নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়, তা-ই গণহত্যা।