দক্ষিণ এশিয়ায় বেশি আক্রান্ত দেশগুলোতে লকডাউন ঢিলেঢালা
বিশ্বে করোনাভাইরাসের মহামারির শুরুর দিকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাদুর্ভাব কম ছিল। কিন্তু এখন এই অঞ্চলে রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়ছে। বাড়ছে মূলত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে। এই দেশগুলোতে লকডাউনে ঢিলেঢালা ভাব। অথচ এই অঞ্চলের শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটানে রোগী অপেক্ষাকৃত কম থাকলেও এসব দেশ আগেভাগে সতর্ক হয়ে এবং জোরালোভাবে বিধিনিষেধ পালন করে পরিস্থিতি সামলে রেখেছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ, মৃত্যুসহ বিভিন্ন তথ্য সার্বক্ষণিক হালনাগাদ করছে ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডট ইনফো। তাদের তথ্যমতে, গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩৪ লাখের বেশি। মৃত্যুর সংখ্যা ২ লাখ ৪৩ হাজার ছাড়িয়েছে। সুস্থ হয়েছেন ১১ লাখের বেশি। এশিয়ায় করোনা রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রায় ৭০ হাজার, মৃত্যু হয়েছে ২ হাজারের কাছাকাছি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরু থেকেই করোনা মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার বিষয়ে তাগিদ দিয়ে আসছে। লকডাউনসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিয়ে অনেক দেশ এরই মধ্যে সফলতার আভাস পেতে শুরু করেছে।
এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ভারতে। সে দেশের গণমাধ্যম এনডিটিভি জানায়, দেশটিতে গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৩৭ হাজারের বেশি রোগী। মারা গেছেন ১ হাজার ২২৩ জন। সুস্থ হওয়ার সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। ভারত সরকার সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে মার্চের শেষ দিকে দেশটি লকডাউন করে, যার মেয়াদ কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ লকডাউনের মেয়াদ ১৭ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে লকডাউনের মধ্যেই অর্থনীতি সচল করতে সবুজ, কমলা ও লাল রঙে এলাকা চিহ্নিত করে কোনো কোনো এলাকায় জনজীবন স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। শর্ত সাপেক্ষে যানবাহন চালু এবং কোনো কোনো এলাকায় শ্রমিকদের কাজে ফেরার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডন-এর অনলাইনের তথ্যমতে, পাকিস্তানে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে সাড়ে ১৮ হাজারের বেশি। মারা গেছেন ৪৩২ জন। সুস্থ হয়েছেন ৪ হাজার ৭০০ জনের বেশি। দেশটিতে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি। করোনা মহামারি হানা দিলেও পাকিস্তান লকডাউন বা জরুরি অবস্থা জারির পথে হাঁটেনি। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের বেশ কয়েক দিন পর বন্ধ করা হয় চীনের সঙ্গে সীমান্তও। ২১ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে আন্তর্জাতিক সব ফ্লাইট। গত মাস থেকে চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোফার্ম-এর তৈরি করোনা প্রতিষেধকের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে পাকিস্তানে।
জঙ্গি তৎপরতা আর তালেবানের উৎপাতে জর্জরিত আফগানিস্তানে করোনা মোকাবিলায় সরকার সে অর্থে কোনো উদ্যোগই নিতে পারেনি। দেশটিতে গতকাল পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ৪৬৯ জন। মৃত্যু হয়েছে ৭২ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৩৩১ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটিতে রোগী কম হওয়ার অন্যতম কারণ পরীক্ষা কম করা। প্রায় পৌনে চার কোটি জনসংখ্যার দেশ আফগানিস্তানে গতকাল পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ১১ হাজার নমুনা।
শ্রীলঙ্কার সংবাদপত্র সিলন টুডের অনলাইনের তথ্যমতে, গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে সংক্রমিত রোগী ছিলেন ৭০২ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৭ জন। সুস্থ হয়েছেন ১৭২ জন। দেশটিতে গত জানুয়ারির শেষ দিকে এক বিদেশি পর্যটকের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। মার্চে কর্তৃপক্ষ দেশজুড়ে ৪৫টি কোয়ারেন্টিন সেন্টার গড়ে তোলে। একই সঙ্গে শুরু হয় রোগী ও সন্দেহভাজন রোগীর সন্ধান। বিদেশি নাগরিকসহ প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষকে কোয়ারেন্টিন করা হয়। ২৫ মার্চের মধ্যে শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষ আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ১৪ হাজার মানুষকে শনাক্ত করে স্বেচ্ছায় আইসোলেশনে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। শুধু তা-ই নয়, রোগীর সংখ্যা ১০০ জন হওয়ার আগেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে কর্তৃপক্ষ। গতকাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় কড়াকড়ি শিথিল করা হয়নি।
মালদ্বীপে গতকাল পর্যন্ত শনাক্ত হয় ৫১৪ জন রোগী। মারা গেছেন একজন। সুস্থ হয়েছেন ১৭ জন। চীনের সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া জানায়, মালদ্বীপে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৭ মার্চ। তবে জানুয়ারিতেই মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করে দেশটির সরকার। ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে পরীক্ষার কিট সংগ্রহ করে। ৭ মার্চ দুজন বিদেশির শরীরে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর জোরেশোরে কোয়ারেন্টিন, পরীক্ষা ও চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয় মালদ্বীপে। আর ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার সংক্রমণকে মহামারি ঘোষণার পরদিনই দেশটিতে ৩০ দিনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
আল–জাজিরা জানায়, চীন, ইতালি, বাংলাদেশ, ইরান, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের মালদ্বীপে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে দেশটির সরকার। শুধু তা–ই নয়, জার্মানি, ফ্রান্স ও দক্ষিণ কোরিয়া হয়ে মালদ্বীপ গমনেচ্ছু ভ্রমণকারীদেরও দেশটিতে প্রবেশ মানা।
নেপালের সরকার করোনা মহামারি আঁচ করে দেশের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল শুরুর দিকেই। আন্তর্জাতিক গন্তব্যে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ চলাচলও বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া কোয়ারেন্টিন, স্ক্রিনিংসহ আরও কিছু পূর্বসতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয় নেপাল। এ ছাড়া জোরদার করা হয় দেশজুড়ে পরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। গতকাল পর্যন্ত নেপালে রোগী ছিলেন ৫৯ জন। তাঁদের মধ্যে ১৬ জন সুস্থ হয়েছেন। এ পর্যন্ত কেউ মারা যাননি।
স্ট্রেইটস টাইমস জানায়, ভুটানও ব্যাপকভাবে পরীক্ষা, কোয়ারেন্টিন ও চিকিৎসা কার্যক্রমের ওপর জোর দিয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর মার্চের শেষ দিকে দেশটির সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভুটানে এ পর্যন্ত আক্রান্ত সাতজন। এর মধ্যে পাঁচজনই সুস্থ হয়েছেন। করোনায় ভুটানে এখনো কারও প্রাণ যায়নি।
বাংলাদেশে দেশজুড়ে দেওয়া হয়েছে সরকারি ছুটি। এখন লকডাউন (অবরুদ্ধ) চলছে ৪৩টি জেলায়। অনেক জেলায় লকডাউন ঢিলেঢালাভাবে চলছে। এরই মধ্যে খুলেছে অনেক পোশাক কারখানা। পর্যায়ক্রমে সীমিত আকারে ট্রেন ও বাস চলাচল শুরুর কথাও ভাবা হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব যথাযথভাবে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও সরকারদলীয় সাংসদ নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত কড়াকড়িভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। একই সঙ্গে এটাও দেখতে হবে যে নিম্ন আয়ের মানুষ যাতে বিপন্ন না হয়।
তবে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দেশে মহামারির প্রথম ঢেউ চলছে। একটু অসতর্ক হলে দ্বিতীয় ঢেউ আরও ভয়াবহ হবে। ইতালি, স্পেনের মতো লাফ দিয়ে সংক্রমণ বাড়তে পারে। তিনি বলেন, শুধু অর্থনৈতিক বিবেচনায় স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করলে হবে না। এতে স্বাস্থ্য আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে জরুরি কাজ চালানো যেতে পারে।