আমেরিকা-উত্তেজনা ফিরিয়ে নিয়ে এল 'উন্মাদ রাষ্ট্রনায়ক' তত্ত্ব
ইরান ও আমেরিকার মধ্যকার প্রাথমিক উত্তেজনার পর্যায়টি এখন অনেকটাই প্রশমিত বলা যায়। আক্ষরিক অর্থে না হলেও মোটাদাগে যে যুদ্ধ-যুদ্ধ উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল তার রাশ দুই পক্ষই টেনে ধরেছে। ইরান ইরাকে থাকা মার্কিন কিছু স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমরবিদ কাশেম সোলাইমানি হত্যার প্রতীকী প্রতিশোধ নিয়ে সরাসরি বলে দিয়েছে যে, ‘যুদ্ধ চাই না’। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী হামলায় ৮০ জন আমেরিকান নিহত হয়েছেন।
কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলে দিয়েছেন, কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। একই সঙ্গে তিনি এও বলে দিয়েছেন যে, সব ঠিকঠাকই আছে। নতুন কোনো আস্ফালন তিনি করেননি। তবে নতুন করে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে পিছপাও হননি।
এই পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে যে, ইরান ও আমেরিকার মধ্যকার উত্তেজনা খুব শিগগিরই সরাসরি যুদ্ধের মতো কোনো দিকে যাচ্ছে না। তবে বিভিন্ন ফ্রন্টে চলমান ছায়াযুদ্ধ যে চলবে, তা এক রকম নিশ্চিত। সত্যি কথা হচ্ছে, বৈরী এ দু পক্ষেরই নিজেদের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর মতো আর্থিক সংগতি নেই। একই সঙ্গে দু পক্ষের আন্তর্জাতিক মিত্রদের কেউই এই মুহূর্তে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা দেখছে না। যুদ্ধ যুদ্ধ একটা উন্মাদনা তারা উভয়েই জিইয়ে রাখবে অবশ্য।
ইরাকের দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালানোর পর দেওয়া বক্তব্যে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, ‘আমরা যুদ্ধ বা উত্তেজনা বাড়াতে চাই না। তবে যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করব।’ অর্থাৎ ইরান তার আগের নীতিই অক্ষুণ্ন রাখবে, আর তা হলো প্রতিরোধ। এদিকে মার্কিন অবস্থানটি বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের শুরুর দিকে কিংবা তারও আগে। ২০১৫ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উদ্যোগে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি চুক্তি হওয়ার পরপরই এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন তখনকার আবাসন ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিতে উৎসুক ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারকালেও তিনি এ সমালোচনা অব্যাহত রাখেন। আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসে শুরুতে একটি ‘আরও ভালো’ চুক্তির দোহাই দিয়ে এই চুক্তি থেকে সরে আসার কথা বলেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ও নানা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের বারবার সতর্কবার্তা সত্ত্বেও ট্রাম্প ঠিকই তাঁর অভীষ্টে পৌঁছেছিলেন ২০১৮ সালে। তারপর থেকেই নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয় দু দেশের মধ্যে, যার চূড়ান্ত পর্যায় কিছুদিন আগেই বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে।
সোলাইমানি হত্যা ও এর পরবর্তী ঘটনাপরম্পরা বিশ্ববাসীকে আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়ে শঙ্কিত করে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত একটি আপাত প্রশমন হলেও উত্তেজনা কাটেনি। এর কারণ অনেকাংশেই ট্রাম্প। ইরানের পদক্ষেপ অনুমেয় হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প তো শুরু থেকেই অনুমানের ঊর্ধ্বে এক ব্যক্তি। এ কারণে তাঁর মেয়াদকালের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হলো, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টির কেন্দ্রে আমেরিকায় থাকা। আলোচিত ও সমালোচিত হওয়াই যেন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। যে কারণে সোলাইমানি হত্যার পর উত্তুঙ্গ উত্তেজনাকর মুহূর্তে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনায় হামলা চালানোর হুমকি দেন, তখন আর অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। যা থাকে, তা হলো দীর্ঘশ্বাস।
কোনো রাষ্ট্রনেতা কখনোই যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে এমন কোনো হামলার হুমকি প্রকাশ্যে দিতে পারেন না। কিন্তু ট্রাম্প দিতে পারেন। আর দিতে পারেন বলেই কয়েক দশক পর আমেরিকার রাজনৈতিক মঞ্চে আবার ফিরে আসে ‘ম্যাডম্যান থিওরি’। এই তত্ত্বের শুরুটি হয়েছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সময়ে। তিনি নিজেই তাঁর অননুমেয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে কথা বলেছেন ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালে। নিক্সন তাঁর এই ভাবমূর্তিকে নিজের শক্তি হিসেবে দেখেছিলেন, যেমনটা দেখছেন ট্রাম্প।
রিচার্ড নিক্সন পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির ভাষাও বুঝতেন। এ নিয়ে পড়াশোনা করতেন। যদিও তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উগ্র বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি ইত্যাদির কোনো তোয়াক্কা করেন না। পড়াশোনায়ও তাঁর অনাগ্রহ বিপুল। এ নিয়ে তাঁর মেয়াদের শুরুর দিকে নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যেখানে তাঁকে একজন টিভির সামনে ঘুন হয়ে বসে থাকা পাঁড় দর্শক হিসেবে বর্ণনা করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় তাঁর ঘুমিয়ে পড়ার ঘটনাও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। হোয়াইট হাউসের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদকে মিউজিক্যাল চেয়ার বানিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, সমালোচনা শুনতে তিনি একেবারেই আগ্রহী নন।
নিজেকে ‘গ্রেট ডিলমেকার’ দাবি করা ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পরিসরে কোনো চুক্তি সম্পন্ন করতে পারেননি। বরং বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নিয়েছেন তিনি সফলভাবে। মুশকিল হচ্ছে এ সব ক্ষেত্রেই আমেরিকার স্বার্থের চেয়ে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন নিজের ইচ্ছাকে। আর এই ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি বেশি আস্থা রেখেছেন ‘হুমকি দেওয়ার’ কৌশলে। এটা অবশ্য অবধারিতই ছিল। কারণ, একজন আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে ভূমি দখল থেকে শুরু করে ব্যবসার প্রতিটি পর্যায়ে তাঁকে এ কৌশল নিয়েই এগোতে হয়েছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অন্তত এখনকার সময়ে ‘হুমকি’ খুব একটা কার্যকর কৌশল নয়। এ নিয়ে খোদ আমেরিকার রাজনীতিকেরাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনায় ব্যস্ত। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে ম্যাডম্যান থিওরিজাত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী একজন উন্মাদ রাষ্ট্রনায়কের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে, কূটনৈতিক পন্থা এড়িয়ে যেকোনো সমস্যার সামরিক সমাধান খোঁজা। এই প্রবণতা পুরোদস্তুর ছিল রিচার্ড নিক্সনের মধ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে মার্কিন অর্থনীতি, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চলা স্নায়ু যুদ্ধসহ বিদ্যমান নানা প্রেক্ষাপটে নিক্সন নিজের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে পারলেও মন্দা কাটিয়ে ওঠা, কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে ক্লান্ত আমেরিকার বাস্তবতায় ট্রাম্পের হতে সে যুক্তি নেই। কিন্তু তিনি যুক্তি মানলে তো। তাঁর প্রিয় শব্দমালায় তো রয়েছে ‘পাওয়ারফুল’, ‘সাকসেসফুল’ ‘বিগ’, ‘গ্রেট’ ইত্যাদি অতিশায়িত শব্দ। আর অস্থিতিশীল ও অননুমেয় চরিত্র হিসেবে নিজেকে তো তিনি ক্ষমতায় আসার অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। ফলে তাঁকে ঘিরে নিক্সন আমলের ‘ম্যাডম্যান থিওরির’ ফিরে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। না হলে লাখো কোটি ডলার ব্যয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়ার যে মার্কিন প্রকল্প, তা দুমড়ে দেওয়ার মতো এমন ঝুঁকিপূর্ণ খেলায় তিনি মাততে পারতেন না।
আশার কথা এই যে, ইরানের পক্ষ থেকে এখনো এমন পাগলামি দেখা যায়নি। একজন উন্মাদ রাষ্ট্রনেতার পদক্ষেপের পাল্টা হিসেবে তেমন কোনো পাগলামিকে প্রশ্রয় না দেওয়াই ভালো হবে তাদের। বিশ্ব আরেকটি যুদ্ধ নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। যুদ্ধবাদী কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উসকানিতে না ভুলে ইরানের উচিত হবে নিজেদের অনুসৃত প্রতিরোধ নীতিতেই ফিরে যাওয়া। সৌদি আরব ও ইসরায়েল জোটের উপস্থিতি এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারে নিজের অভিলাষের যুগল বাস্তবতায় ইরানের সামনে এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক ও সামরিক মেরুদণ্ড বিবেচনায় ইরান এ সত্যটি বুঝেছে বলেই মনে হচ্ছে। আমেরিকার কথা অবশ্য বলা যাচ্ছে না, অন্তত যতক্ষণ এর ক্ষমতায় ‘অঘটনপটিয়সী’ ডোনাল্ড ট্রাম্প রয়েছেন।