বিপিন রাওয়াতে কেন ভরসা বিজেপির?
সরল দৃষ্টিতে দেখলেও ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের বিষয়গুলো ধরা পড়বে। বিজেপিশাসিত কেন্দ্রীয় সরকার দেশজুড়ে নাগরিক সংশোধন আইন প্রয়োগ করতে চাইছে। এ নিয়ে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে চলছে আন্দোলন। কঠোর অবস্থানে বিজেপিশাসিত সরকার। বিরোধীরা বলছে, দেশটির অর্থনীতি গুঁড়িয়ে গেছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ছে। বিজেপির দাবি, তারা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। দিচ্ছে নানা প্রতিশ্রুতি। এরই মধ্যে আবার তাদের ভাবতে হচ্ছে প্রতিরক্ষা নিয়ে। তাই সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের একটি দাবির মুখে ব্যাপক পরিবর্তন আনল বিজেপিশাসিত সরকার। নিয়োগ হলো নতুন প্রতিরক্ষা প্রধানের। ভারতের প্রথম প্রতিরক্ষাপ্রধান হিসেবে (চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ) হিসেবে নিয়োগ পেলেন জেনারেল বিপিন রাওয়াত।
সেনাপ্রধানের দায়িত্ব থেকে অবসরের এক দিন আগে নতুন এই দায়িত্ব কেন পেলেন বিপিন রাওয়াত? কেন তাঁর ওপর এত ভরসা বিজেপির?
সোমবার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণার পর থেকেই এ প্রশ্নগুলো আরও বেশি করে উঠছে। বিপিন রাওয়াতের সাম্প্রতিক বেশ কিছু বিতর্কিত উক্তি ও কর্মকাণ্ডকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি বিরোধীরা। বছর দুয়েক আগে মেজর জেনারেল লিতুল গগৈকে চিফ অব আর্মি স্টাফের প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন তিনি। সেই গগৈই এক কাশ্মীরি যুবক নিজের জিপের সামনে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই কাজ গগৈ করেছিলেন পাথরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে। এই কাজের জেরে মানবাধিকারকর্মী থেকে রাজনৈতিক নেতা সবারই সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি।
সেনাকর্মীদের হুঁশিয়ারি দেওয়া নিয়ে বিতর্ক সেনাকর্মীদের প্রতিবন্ধক নিয়ে মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন জেনারেল রাওয়াত। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের বিক্ষোভের মুখে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের আচরণবিধি নিয়ে মন্তব্য করে তাদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন জেনারেল রাওয়াত। ২০১৬ সালে দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে টপকে তাঁর নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এনডিটিভি অনলাইনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, তিন বছরের জন্য জেনারেল বিপিন রাওয়াতের হাতে প্রতিরক্ষার বড় দায়িত্ব দিয়েছে বিজেপির সরকার। সেনাবাহিনী, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানেরা তাঁকে রিপোর্ট করবেন। জেনারেল রাওয়াত আগে থেকেই অবশ্য চিফ অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন। চলতি বছরের আগস্টে নতুন পদ সৃষ্টির ঘোষণা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর ঘোষণার পর দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই পদে নিয়োগের ব্যাপারে তৎপরতা শুরু করে।
২৪ ডিসেম্বর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ পদের যোগ্যতা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এতে বলা হয়, সামরিক বাহিনীর চার তারকা মানের কর্মকর্তাকে প্রতিরক্ষাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। তখন থেকেই জল্পনা ছিল, ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতই দেশের প্রথম প্রতিরক্ষাপ্রধান হতে যাচ্ছেন। চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ হিসেবে সুরক্ষার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবেন রাওয়াত। জেনারেল রাওয়াত ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেনাপ্রধান হওয়ার আগে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে এলওসি, চীনের সঙ্গে এবং উত্তর-পূর্বে এলএসিসহ অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অপারেশনাল দায়িত্ব পরিচালনা করেছিলেন।
সেনার তিন বাহিনীর শীর্ষ পদাধিকারীদের অবসরের বয়স ৬২ বছর। সে ক্ষেত্রে নতুন এই পদে অবসরের বয়স বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬৫ বছর। অর্থাৎ সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর এই পদে দায়িত্ব নিলে আরও তিন বছর চাকরির মেয়াদ বেড়ে যাবে। সরকারকে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে সব পরামর্শ দেবে ‘চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ’।
কী কারণে এ পদ সৃষ্টি করে রাওয়াতকে রেখে দিতে হলো?
এ প্রশ্নের উত্তর ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলেই মিলতে পারে। বিপিন রাওয়াত ও মোদির রসায়নটা একটু বিশ্লেষণ করা যাক। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় চোখে পড়ার মতো। একটি হচ্ছে বিপিনের মোদি ভক্তি। বিপিন বরাবরই মোদির সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেছেন। ফলে মোদির আস্থাভাজন হয়ে উঠতে তাঁর দেরি হয়নি।
সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে নাগরিক সংশোধন আইন নিয়ে বিপিনের মন্তব্যকে তুলে ধরা যায়। বিতর্কিত এ আইন ঘিরে অনেকেই সমালোচনা করলেও মোদির সুরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের সমালোচনায় সরব হন বিপিন রাওয়াত। দিল্লির এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, নেতৃত্ব হলো সবাইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যারা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে, তারা নেতা নয়। তিনি বলেন, নেতার অভাব হয় না। কিন্তু সবাই সঠিক নেতা হয়ে ওঠেন না। কারণ, অনুসারীদের সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় নেতাকেই। সেটাই সঠিক নেতৃত্ব। মানুষকে ভুল দিকে নিয়ে গেলে সেটা সঠিক ভাবে নেতৃত্ব দেওয়া হয় না। আমরা দেখছি, প্রচুর মানুষকে ভুল পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। এটাকে নেতৃত্ব দেওয়া বলে না।
সেনাপ্রধানের এই মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে কংগ্রেস। তাদের মতে, একজন সেনাপ্রধান হয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সপক্ষে মন্তব্য করা অনুচিত। সারা দেশে সিএএবিরোধী আন্দোলনে ৩১ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই উত্তর প্রদেশের। কংগ্রেসের দাবি সেনাপ্রধান সেই বিষয়ে কোনো কথা খরচা না করে রাজনৈতিক মন্তব্য করছেন। তাঁর পদটা রাজনীতির ঊর্ধ্বে। তবে নিজের অবস্থান নিয়েও বিপিনের ব্যাখ্যা রয়েছে। তিনি বলেছেন, মানবাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে যথেষ্ট সম্মান করে ভারতীয় সেনাবাহিনী।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত এক আলোচনা সভায় রাওয়াত বলেন, শৃঙ্খলাপরায়ণ বাহিনী হিসেবে বিশ্বের মধ্যে ভারতীয় সেনার অনেক সুনাম রয়েছে। মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নেও ভারতীয় সেনার সুনাম এবং দক্ষতা রয়েছে। নিজের দেশের নাগরিক ছাড়াও যুদ্ধবন্দীদের প্রতি ভারতীয় সেনা অতীতেও মানবিক ব্যবহার করেছে। তাদের মানবাধিকার রক্ষা করেছে। মানবাধিকার রক্ষায় ভারতীয় সেনা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। জেনেভা কনভেনশন মেনেই ভারতীয় সেনা শত্রুপক্ষের সেনা ও যুদ্ধবন্দিদের মানবাধিকার রক্ষা নিশ্চিত করে থাকে। সে জন্যই রাষ্ট্রসংঘের শান্তিবাহিনীতে ভারতীয় সেনার এত কদর।
বিপিনের নতুন পদে যাওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে, প্রতিরক্ষা বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি। সেনার তিন বাহিনীর সমন্বয় বাড়ানো এবং তিন বাহিনীর পরামর্শদাতা নিয়োগের দাবি উঠছিল সেনা ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত নানা মহল থেকে। অবশেষে তাঁকে নিয়োগে সেই দাবি একদিকে যেমন পূরণ হলো তেমনি পাকিস্তান ও চীন নীতিতে ভারতের বর্তমান অবস্থান ধরে রাখা সহজ হবে বিজেপির জন্য। পাকিস্তান বিরুদ্ধে আগ্রাসন নিয়ে বরাবরই বলেছেন রাওয়াত। জম্মু ও কাশ্মীরের উধমপুরে নর্দান কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে পরিদর্শনে গিয়ে ভারতীয় সেনার প্রতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন তিনি। বলেন, শত্রুপক্ষকে দমন করতে সর্বদা অ্যালার্টে থাকতে হবে সেনাকে। বিজেপি সরকারে আসার পর থেকেই দেশে ধর্মীয় বিভাজনের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। সম্প্রতি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জির বিরোধিতায় দেশব্যাপী যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে তাতেও ধর্মীয় অস্থিরতা চোখে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে আলোচনা করতে গিয়ে ভারতীয় সেনা চূড়ান্ত ধর্মনিরপেক্ষ বলে জানান সেনাপ্রধান। মানবতা ও ভদ্রতাকে পাথেয় করেই তাঁরা এগিয়ে চলেছে বলে দাবি করেন।
মঙ্গলবার সেনাপ্রধান হিসেবে বিদায় সংবর্ধনা নিয়েছেন জেনারেল বিপিন রাওয়াত। তিনিই প্রথম চারতারা-ওয়ালা ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা হলেন। এ উপলক্ষে তিনি বলেন, নতুন পদ পাওয়ার পর এবার নতুনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। এত দিন সেনাপ্রধান হিসেবে অনেক দায়িত্ব সামলাতে হয়েছে। এখন নতুন পদ পাওয়ার পর ভবিষ্যতের জন্য নতুনভাবে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
ডিপার্টমেন্ট অব মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সের প্রধান হিসেবে সার্ভিস চিফের সমান বেতন পাবেন রাওয়াত। ভারতের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম বলেছে, জেনারেল বিপিন রাওয়াতকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও মালদ্বীপ। এর অর্থ, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতঘেঁষা দেশগুলোতে বিপিনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা ও সম্পর্কের বিষয়টিকে আরও কিছুদিন কাজে লাগাতে চাইছে মোদি সরকার।