খারাপের ভিড়ে ভালো খবরও আছে
রাস্তা পার হতে গিয়ে এক শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হয়েছে— খবরটির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন মোহসিন আলম। এই বয়সী একটি সন্তান তাঁরও আছে। নিহত শিক্ষার্থীর জায়গায় নিজের সন্তানের মুখ কল্পনা করে কেঁপে উঠলেন। ইদানিং এই সব খবরের ভার আর নিতে পারছেন না। খুন, ধর্ষণ, দুর্ঘটনা আর দুর্নীতির খবরে কেমন হাঁপ ধরে যায়। নিয়মিত পত্রিকা পড়ার পাশাপাশি তিনি মুঠোফোনে অনলাইনে খবর পড়ে থাকেন। টেলিভিশনেও খবর দেখেন। তবে এখন মাঝে মাঝে ভাবেন, খবরের সঙ্গে থাকাই ছেড়ে দেবেন। অন্যের অপরাধের ঘটনায় মানুষ হিসেবে নিজেকে কেমন নিকৃষ্ট মনে হয়।
অনেক পাঠকের অভিযোগ, নেতিবাচক খবরের ভিড়ে তাঁরা সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখতে ভয় পান। নিজেরই দুশ্চিন্তার শেষ নেই, এর মধ্যে নানান সমস্যার খবর শুনলে মানসিক চাপ আরও বাড়ে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। এর চেয়ে খবর থেকে দূরে থাকাই ভালো।
তবে তাঁদের জন্য বার্তা হচ্ছে, খবর থেকে দূরে থাকলে আপনি কিছু সুখবর জানা থেকেও বঞ্চিত হতে পারেন। অনেক খারাপের ভিড়ে এমন ভালো কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা আপনাকে নৈরাশ্য কাটিয়ে আশাবাদী করে তুলতে পারে। অনেকের সঙ্গে আপনিও সুর মিলিয়ে বলতে পারবেন, ‘জীবন সত্যিই সুন্দর’।
বিভিন্ন সূত্র থেকে এমন কিছু ভালো খবরের তথ্য জানিয়েছে বিউটিফুল নিউজ।
অনাবিল সুখ স্নেহ-ভালোবাসায়
বন্ধুত্ব, হাসি, আনন্দ ও প্রকৃতি আমাদের আনন্দ দেয়। এর জন্য কোনো মূল্য পরিশোধ করতে হয় না। অর্থ দিয়ে অনেক কিছু কেনা যায়, তবে শুধু বস্তুগত এসব জিনিস সুখ আনতে পারে না; এই সুখ আসতে পারে পরিবার, বন্ধু আর রোমাঞ্চকর জীবনযাপন থেকে। ফ্লোয়িং ডেটা ও হ্যাপি ডিবির তথ্য অনুসারে, অর্জন ও স্নেহ-ভালোবাসা থেকে মানুষ সবচেয়ে বেশি সুখ পায়। এ ক্ষেত্রে সমানসংখ্যক (৩৪ শতাংশ) আনন্দ দেয় মানুষকে। এ ছাড়া বন্ধন থেকে ১০ শতাংশ, আনন্দময় মুহূর্ত থেকে ১০ শতাংশ এবং ব্যায়াম, অবসর সময় ও প্রকৃতি থেকে ৩ শতাংশ করে সুখ আসে।
রক্ষা পাচ্ছে কোটি প্রাণ
২০০ বছরের ব্যবধানে কোটি কোটি জীবন এখন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। গ্যাপ মাইন্ডার ও আওয়ার ওয়ার্ল্ড ডেটা ডট অর্গের তথ্যমতে, ১৮২০ সালে প্রায় অর্ধেকসংখ্যক শিশু (৪৩ শতাংশ) পাঁচ বছর বয়সের আগেই মারা যেত। এর ১০০ বছর পর ১৯১৮ সালেও সে হার খুব বেশি কমানো সম্ভব হয়নি। ওই বছর পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার ছিল ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ। আর এখন ২০২০ সাল ছুঁইছুঁই সময়ে এ হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি দেশই শিশুমৃত্যুর হার কমাতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ ওই সময়ের তুলনায় শিশুমৃত্যুর হার কমিয়েছে ৯০ শতাংশ, যা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। উচ্চ আয় আর নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় শিশুমৃত্যুর এ হারের পার্থক্য অনেক কমে এসেছে। শত শত কোটি জীবন এখন বেঁচে যায়। ভালো ওষুধ, পুষ্টি, স্যানিটেশনসহ জীবনযাপনের মান উন্নত হওয়ায় এই বিপুলসংখ্যক প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।
ধূমপান নিষিদ্ধে হাসপাতালে চাপ কমছে
প্রায় ১০০ দেশে প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ। এতে ধূমপায়ীদের অনেকেই অসন্তুষ্ট হলেও অধূমপায়ীরা দারুণ উপকৃত হচ্ছে। ওই সব দেশে হৃদ্রোগ, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট ও অপরিণত শিশু জন্ম দেওয়ার হার কমেছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ রিসার্চের গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধের ফলে ওই সব দেশে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যা কমেছে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ। হৃদ্রোগসংক্রান্ত স্বাস্থ্যব্যয় কমেছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ, হৃদ্রোগসংক্রান্ত জটিলতা কমেছে ১২ শতাংশ, শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসা কমেছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, অপরিণত শিশু জন্মের হার কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নাক-গলাসংক্রান্ত সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যা কমেছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
প্রতিষেধক টিকার জাদু
মানুষের স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির কথা বলতে গেলে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। আর সেটা হচ্ছে ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক টিকা। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ কোলাবরেটিভ নেটওয়ার্কের তথ্য অনুসারে, স্বাস্থ্যবিষয়ক যা কিছু আবিষ্কার করা হয়েছে, তার মধ্যে ভ্যাকসিন হচ্ছে সবচেয়ে সুলভ মূল্যের। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বিশ্বে হামের প্রাদুর্ভাব কমেছে ৯৩ শতাংশ, ডিপথেরিয়া ৮৯ শতাংশ এবং ধনুষ্টংকার ৮৯ শতাংশ। ভ্যাকসিন দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য রোগে মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে ১৯ লাখ।
বৈপ্লবিক উদ্ভাবন
লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি জানিয়েছে, গ্রীবাসংক্রান্ত (সার্ভিক্যাল) ক্যানসারের নতুন একটি পরীক্ষা উদ্ভাবিত হয়েছে, যাতে রোগটি শতভাগ নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব। ১৫ হাজার নারীর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে এই ফল পাওয়া গেছে। বৈপ্লবিক স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে আগেভাগেই এ ক্যানসার নির্ণয় করা সম্ভব হবে। আর এর জন্য খুব বেশি ব্যয়ও করতে হবে না।
এ ছাড়া ক্যানসারের চিকিৎসাব্যবস্থাও দিন দিন উন্নতি করছে। চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতির কারণে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ক্যানসারে আক্রান্ত ৩৩ লাখ রোগীর জীবন কিছুটা দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হয়েছে। একটু বেশি সময় বেঁচে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন তাঁরা।
মশারির জুড়ি নেই
ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর মতো মশাবাহিত রোগ কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা আমাদের দেশের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাই সাক্ষ্য দিচ্ছে। বছর শেষেও দেশে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর খবর এসেছে। আর আফ্রিকায় ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি ভয়াবহ। পাবমেড জানিয়েছে, সাধারণ এক মশারি পারে ৫০ লাখ মানুষকে ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচাতে। দাম মাত্র দুই ডলার। টেকে তিন বছর। অথচ এই মশারি রক্ষা করতে পারে জীবন।
দারিদ্র্য কমেছে
বিশ্বে চরম দারিদ্র্যও আগের তুলনায় কমে এসেছে। এটি এক অসাধারণ অর্জন। তুলনামূলক ভালো স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবনযাপন কোটি কোটি চরম দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে টেনে তুলেছে। এখন ১০ জনের ১ জন দিনে ১ দশমিক ৯ ডলারের (১৬১.১৪ টাকা) কম ব্যয়ে জীবন কাটায়। কিন্তু ৫০ বছর আগে এ চিত্র ছিল আরও ভয়াবহ। ওই সময় প্রতি ২ জনের ১ জন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করত।
সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে
রাজনীতিতে দেশে দেশে বৈষম্যের শিকার নারী। রাজনৈতিক দলগুলোয় নারীর অংশগ্রহণ একদিকে কম, অন্যদিকে নানান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যেসব নারী নির্বাচনে লড়াই করতে নামেন, তাঁরাও দল থেকে সমর্থন পান না সেভাবে। দলের শীর্ষ পর্যায়ের কমিটির পদ থেকে নারীরা যেভাবে বঞ্চিত হন, একইভাবে বঞ্চিত হন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতেও। এরপরও আশার কথা, দেশে দেশে সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলক বাড়ছে। পশ্চিমের মার্কিন কংগ্রেস আর এই দিকের ভারতের পার্লামেন্টে নারীর সংখ্যা রেকর্ডসংখ্যক বেড়েছে। কিছু কিছু দেশে এ অর্জন দুর্দান্ত। রুয়ান্ডা, কিউবা ও বলিভিয়ার পার্লামেন্টে ৫০ শতাংশের বেশি নারী; যদিও হাইতি ও কাতারের পার্লামেন্টে কোনো নারী সদস্য নেই। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন মিলিয়ে নারী প্রতিনিধিত্ব ২০ দশমিক ৭ শতাংশ।
গত কয়েক দশকের চিত্র তুলে ধরে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, ১৯৯০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে নারীর অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ১৩ শতাংশ। এক দশক পর ২০০০ সালে এ হার সামান্য বেড়ে হয় ১৪ শতাংশ। ২০১০ সালে এ হার আরেকটু বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ শতাংশে। আর ২০১৮ সালে পার্লামেন্টে নারী প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ২৪ শতাংশ।
সেখানে হাতি হত্যা শূন্যে নেমেছে
পশুপ্রেমীদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি ভালো খবর। মালির স্থানীয় সম্প্রদায় হাতিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তবে শিকারিদের কারণে ২০১৬ সালে সেখানে হাতি প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে ছিল। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, হাতির দাঁতের রমরমা ব্যবসার কারণে শিকারিরা হাতি শিকার করত। হাতি রক্ষায় সেখানে হাতি শিকারবিরোধী ব্রিগেড গঠন করার পর হাতি হত্যার ঘটনা শূন্যে নেমে এসেছে।
পশুর লোম–বাণিজ্য নিষিদ্ধ
পশুর লোম থেকে তৈরি পোশাক একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখন সেই জনপ্রিয়তা ক্রমেই ভাটার দিকে। পিপল ফর দ্য ইথিক্যাল ট্রিটমেন্ট অব অ্যানিমেলস (পেটা) জানিয়েছে, এটা সম্ভব হয়েছে সচেতন মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। কিছু দেশ পশুর লোম ব্যবসার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করেছে। যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০ বছর ধরে এ বাণিজ্য নিষিদ্ধ। পশুর লোমের ৫০ শতাংশই আসে ইউরোপ থেকে। তবে আশার কথা, ইউরোপে পশুর লোম–বাণিজ্যের নিষিদ্ধ তালিকা বড় হচ্ছে।
এসব তথ্য হচ্ছে অনেক অনেক ভালো খবরের ভিড় থেকে তুলে আনা ছোট্ট অংশ। পৃথিবী জুড়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ভালো খবর তৈরি হচ্ছে। ওই সব আশা জাগানিয়া খবরে আপনি মানুষ হিসেবে শুধু গর্বই বোধ করবেন না, অনুপ্রাণিতও হবেন। সেসব খবর জীবনকে অর্থবহ করতে নতুন পরিকল্পনার দিকে আপনাকে ঠেলে দেবে। স্বপ্ন বুনতে সহায়ক হবে।