বরিস-করবিন বিতর্কেও বিভাজনের প্রতিফলন
যুক্তরাজ্যে ১২ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রধান দুই দলের নেতাদের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় শুক্রবার স্থানীয় সময় রাতে। বিবিসি আয়োজিত এই বিতর্কে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন কেউ কাউকে ধরাশায়ী করতে পারেননি। একইভাবে কেউ বড় তৃপ্তি নিয়েও বিতর্ক শেষ করতে পারেননি।
এদিকে ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ) প্রশ্নে গণভোটে যে ব্যবধান দেখা গিয়েছিল, এই বিতর্কে বিজয়ীর প্রশ্নেও সেই একই ব্যবধান দেখা গেছে। বিতর্কের পরপরই স্কাই টেলিভিশনের পক্ষে ইউগভ নামের জনমত জরিপকারী সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫২ শতাংশ দর্শক-শ্রোতা মনে করেন, বিতর্কে বরিস বিজয়ী হয়েছেন। আর ৪৮ শতাংশের চোখে করবিন বিজয়ী। এই ফলাফলকে ব্রেক্সিটকেন্দ্রিক বিভাজনের স্মারক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কারণ, বরিসের বক্তব্য ও যুক্তিগুলোর পুরোটারই ভিত্তি ছিল একটি মাত্র বিষয়ে—‘গেট ব্রেক্সিট ডান (ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন)’।
করবিন ব্রেক্সিট বাতিলের কথা কখনোই বলেননি। কিন্তু বিভক্ত জাতিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে তাঁর নিরপেক্ষতা এবং দ্বিতীয় গণভোটের প্রস্তাবকে ব্রেক্সিট বিলম্বিত করা বলেই মনে করেন অনেকে।
বিতর্কে বরিস প্রধানত জোর দিয়েছেন তাঁর সম্পাদিত চুক্তি অনুমোদনের জন্য পার্লামেন্টে তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজনের দিকে। চুক্তিটি অনুমোদনের পর ২০২০ সালের মধ্যেই তিনি বিচ্ছেদের পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবেন বলে তাঁর দাবি। নির্বাচনে তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার মানে হবে, তাঁর ভাষায়, বিশৃঙ্খলা ও নতুন দীর্ঘসূত্রতা। তাঁর মতে, এই দীর্ঘসূত্রতার কারণ নতুন করে চুক্তির দর-কষাকষি এবং দ্বিতীয় আরেকটি গণভোটের আয়োজন। লেবার পার্টি স্কটিশ জাতীয়তাবাদীদের ওপর নির্ভরশীল হলে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিতীয় আরেকটি গণভোটের জন্য করবিনকে ছাড় দিতে হবে, যা আরও সময়ক্ষেপণ এবং বিশৃঙ্খলার কারণ হবে।
পুরো নির্বাচনী প্রচারে এবং বিতর্কে বরিসের বক্তব্যে কনজারভেটিভ পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার ওপরই বিশেষভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার পথে প্রতিবন্ধক যেমন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো, তেমনই বাধা তৈরির চেষ্টা করেছেন সাবেক কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর। দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে জন মেজরের এ আহ্বান নজিরবিহীন। শুক্রবারের বিতর্কের কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি কনজারভেটিভ পার্টি থেকে বরিস কর্তৃক বহিষ্কৃত জনা বিশেক এমপির মধ্যে যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের নির্বাচিত করার আহ্বান জানান। পাশাপাশি কোনো দল যাতে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, সে জন্যও সবাইকে কৌশলী হতে বলেন। বরিস যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পান, তা নিশ্চিত করতে সাবেক লেবার প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও পরে একই ধরনের কৌশলী হওয়ার আহ্বান জানান।
ব্রেক্সিট প্রশ্নে করবিন শুক্রবার সকালে এক সরকারি নথির গোপন তথ্য তুলে ধরে চমক সৃষ্টির চেষ্টা করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে বরিসের সম্পাদিত চুক্তিতে উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের বাকি অংশের মধ্যে সব ধরনের পণ্য চলাচলে শুল্ক যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, সরকার এই তথ্য গোপন করেছে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে উত্তর আয়ারল্যান্ডকে যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বরিস অবশ্য সরকারি নথির যথার্থতা অস্বীকার করেননি, বরং ব্যক্তিগত আক্রমণের পথ বেছে নিয়ে বলেছেন, করবিন আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সঙ্গে বন্ধুত্বের সময়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে উত্তর আয়ারল্যান্ডের ইউনিয়নের কথা ভাবেননি। বিতর্কে উত্থাপিত এই তথ্যে স্পষ্ট হয়েছে যে বরিস উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির সমর্থন পাবেন না, যা তাঁর পূর্বসূরি থেরেসা মে পেয়েছিলেন। ফলে আগামী পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নটি তাঁর জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রইল।
বরিস যখন ১২ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে ব্রেক্সিট নির্বাচন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন, তখন লেবার পার্টিসহ বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনকে একটি ইস্যুর বাইরে যুক্তরাজ্যের আগামী পাঁচ বছরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সুযোগ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তাই করবিন বিতর্কে কৃচ্ছ্রনীতির অবসানের বিষয়েই জোর দিয়েছেন। দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আইনশৃঙ্খলার দৈন্যদশার জন্য গত এক দশকের কৃচ্ছ্রনীতিকে বারবার দায়ী করেছেন তিনি। বরিস এসব বিষয়ে তাঁর বিনিয়োগ পরিকল্পনার কথা বললেও তাঁর হিসাবের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যেসব প্রশ্ন ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে, সেগুলো দূর করতে সক্ষম হননি।
বরিসের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নটি পুরো নির্বাচনী প্রচারে বারবার ফিরে এসেছে। বিতর্কের পর যে জরিপে তাঁকে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, সেই একই জরিপে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে তিনি পেয়েছেন ৩৮ শতাংশের সমর্থন। কিন্তু করবিনের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতার হার ৪৮ শতাংশ। বিতর্কে শেষ প্রশ্নটি ছিল বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। উভয় নেতার কাছে প্রশ্ন ছিল, রাজনীতিকেরা মিথ্যা বললে তাঁর কি শাস্তি হওয়া উচিত? বরিস নাটকীয়তার সঙ্গে বলেছেন, পার্লামেন্টের অধিবেশন কক্ষে তাঁদের হাঁটু গেড়ে বসিয়ে প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত। এর আগের বিতর্কে বরিস ‘সত্য কথা খুবই গুরুত্বর্পূণ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে মিলনায়তনে অট্টহাসির রোল পড়েছিল। এবার অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি। তবে করবিন যখন বাসের গায়ে মিথ্যা স্লোগান লেখার কথা স্মরণ করিয়ে দেন, তখন দর্শকেরা ব্যাপক করতালি দিয়েছেন।
নির্বাচনপূর্ব এই শেষ বিতর্কে জনমত কতটা প্রভাবিত হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে দুটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এক, জনমত জরিপে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে ব্রেক্সিট সমর্থকদের অবস্থান সংহত হয়েছে। ব্রেক্সিট পার্টির সহায়তা এ ক্ষেত্রে ভালোই ভূমিকা রেখেছে। তবে তাদের ভোট আর বাড়ানোর তেমন সুযোগ নেই, বরং জন মেজরের মতো আর কোনো প্রভাবশালী নেতা যদি একই ধরনের সমালোচনা করেন, তাহলে বরিসের ঝুঁকি বাড়বে। বিপরীতে, ব্রেক্সিট নাকি কৃচ্ছ্রসাধনের অবসান—এই দুই প্রশ্নে যাঁরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই, বিশেষ করে লেবার পার্টির সমর্থকেরা করবিনের নেতৃত্বকেই গ্রহণ করছেন। তবে যাঁরা ব্রেক্সিট বাতিল করতে চান বা ইউরোপে থেকে যেতে চান, তাঁদের ভোটের বিভাজন, বিশেষ করে লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের কারণে লেবার এখনো কিছুটা ঝুঁকিতে রয়েছে। দ্বিতীয় গণভোটের বাস্তবসম্মত সম্ভাবনার জন্য তাঁরা লেবারের পক্ষে ভোট দেবেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। অর্থাৎ লেবারের এখনো নতুন অনেকের মন জয় করার সুযোগ আছে।
সবচেয়ে বড় কথা, বরিসের প্রয়োজন সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু করবিনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া জরুরি নয়। কেননা তাঁকে স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি এবং গ্রিন পার্টি সমর্থন দিতে যে প্রস্তুত, সে কথা মোটামুটি সবারই জানা।
ইনসার্ট:
বরিস ৫২ আর করবিন ৪৮ শতাংশের চোখে বিজয়ী। এই ফল ব্রেক্সিটকেন্দ্রিক বিভাজনের স্মারক।