যার নাম নিতে নেই, করতে হবে তার চিকিৎসা
নারী দিবস উপলক্ষে নিঃসংকোচে পা ছড়িয়ে বসা এক মেয়ের ছবি প্ল্যাকার্ডে এঁকেছিলেন পাকিস্তানের দুই নারী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটি ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই মন্তব্য করেন, এটা নারী দিবস, অনৈতিক চরিত্রের কারও দিবস নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বোনের উপস্থিতি অসম্মানজনক মনে হওয়ায় ভাইয়ের হাতে ‘অনার কিলিংয়ের’ শিকার হন দেশটির এক মডেল। বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে স্বামীর হাতে প্রাণ খোয়াতে হয়েছিল পশতু গায়িকা গাজালা জাভেদকে। পাকিস্তানে নারীদের অবস্থান কোথায়, তা প্রমাণ করতে এমন অজস্র উদাহরণ দেওয়া যাবে।
এমন একটি নারীবিদ্বেষী সমাজে নারীরা ‘স্তন’ শব্দটি উচ্চারণও করতে পারবেন না, সেটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়।
অথচ বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে জানা গেছে, স্তন ক্যানসারের হারের দিক থেকে এশিয়ায় সবচেয়ে দুরবস্থা পাকিস্তানের। স্তন ক্যানসার নিরাময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে তা শনাক্ত করা খুব জরুরি। কিন্তু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ‘ভদ্রতার সংস্কৃতি’ মেনে নারীদের অনেকেই চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসছেন না।
আগা খান বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসক হাসনাইন বলেন, ‘প্রাথমিক শনাক্তকরণের ফলে কেবল চিকিৎসা ব্যয়ই কমে না, জীবনও বাঁচে। প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার শনাক্তকরণ সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের সবার কর্তব্য।’ দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে এই অসুখ থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব বলে জানান তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে প্রতিবছর ১৭ হাজারেরও বেশি নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যদিও দেশটির দাতব্য সংস্থা এবং চিকিৎসকদের দাবি, প্রকৃত সংখ্যাটি ৪০ হাজারের কাছাকাছি হবে। তাঁরা বলছেন, দেশটিতে প্রতি ৯ জন নারীর একজন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। তবে সংস্কৃতি ও সামাজিক বিধিনিষেধ নারীদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়া খুব কঠিন করে তোলে।
স্তন ক্যানসার-সংক্রান্ত দাতব্য সংস্থা পিংক রিবন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা ওমর আফতাব বলেন, স্তন ক্যানসার নারীদের যৌনতার সঙ্গে জড়িত। তাই পাকিস্তানে এটি ট্যাবু হয়ে উঠেছে। অসুখ নয়, একে বরং যৌনতা হিসেবে দেখা হয়।
স্তন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে জিতে যাওয়া নারীরা জানিয়েছেন, নিঃসঙ্গ এক সফর পার করতে হয়েছে তাঁদের।
পরিবারের কথা ভেবে পিছিয়ে যান নারীরা
প্রাথমিক শিক্ষক সিলভাত জাফরের বয়স তখন বিশের ঘরে। হঠাৎ করেই টের পেলেন, স্তনে ছোট চাকার মতো কিছু একটা হাতে বাঁধছে। সিদ্ধান্ত নিলেন, পরিবারের কাছ থেকে বিষয়টি গোপন রাখবেন। সপরিবারে ছুটি কাটাতে ডিজনি ওয়াল্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। তাঁর কথা, ‘আমাদের সমাজে মেয়েরা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে চুপ থাকে। এ বিষয়ে আপনি কোনো কথা বলতে পারবেন না। আমি “স্তন ক্যানসার” শব্দটাই উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। অথচ আমার মা এই রোগে ভুগে মারা গেলেন। পরিবারের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় আমি চুপ করেই রইলাম।’
বেড়াতে গিয়ে ঢিলেঢালা জামাকাপড় পরে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা চাকাটি লুকিয়ে রাখেন তিনি। তিনি যে ভয়াবহ যন্ত্রণা সহ্য করছেন, প্রকাশ্যে তা বোঝার কোনো উপায়ই নেই।
মাস ছয়েক পরে যখন তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন, তত দিনে তাঁর ক্যানসার তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তৃতীয় পর্যায়ের স্তন ক্যানসারের মানে টিউমারটি অনেক বড় হয়ে গেছে। সারা শরীরে এই অসুখ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। তবে এই পর্যায়ে এসেও তাঁর চিকিৎসা করানো সম্ভব।
সিলভাতের পরিস্থিতি পাকিস্তানের অন্যতম শীর্ষ স্তন সার্জন হুমা মাজিদের খুব পরিচিত। তিনি লাহোরের ইত্তেফাক হাসপাতালে একটি ক্লিনিক পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। সেখানে তিনি কয়েক শ স্তন ক্যানসার-আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করেন। তিনি বলেন, নারীরা পরিবারের কথা চিন্তা করতে গিয়ে নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে খুব একটা সচেতন হওয়ার সময় পান না।
স্তন ক্যানসার নিয়ে আলোচনা করতে ‘লজ্জা’ পাওয়া পাকিস্তানে নারীদের চিকিৎসা না পাওয়ার একটি অন্যতম কারণ। শরীরের গোপন অঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় অনেক নারী ও তাঁদের স্বামী পুরুষ সার্জনের কাছে পরীক্ষা করাতে নারাজ।
তবে স্তন ক্যানসারের পেছনে অন্যান্য কারণের কথাও উল্লেখ করেছেন হুমা। তিনি বলেন, পাকিস্তানের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের স্বাস্থ্য অ্যাজেন্ডায় কমই থাকে। চিকিৎসার জন্য অনেকেই পুরুষ সদস্যদের ওপর নির্ভর করেন। সাধারণত স্তন ক্যানসারের চিকিৎসকেরা বড় শহরগুলোতে বসেন। কাজেই এখানে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থেকেই যায়।
এখানে একটি আর্থিক ব্যাপারও রয়েছে
চিকিৎসার জন্য কোনো নারীকে বড় শহরে যেতে হলে পুরো পরিবার তাঁর সঙ্গে যাবে, এটাই নিয়ম। নারীদের সঙ্গে যেতে পুরুষদের কাজ থেকে ছুটি নিতে হবে। অর্থাৎ, আয় কমে গিয়ে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এটি বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলের দরিদ্র পটভূমির নারীদের ওপর বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অস্ত্রোপচারের পর প্রথমবারের মতো হুমা মাজিদের কাছে চেকআপ করাতে আসেন ২০ বছরের তরুণী সোবিয়া। কয়েক মাস আগে তাঁর স্তন থেকে একটি চাকা অপসারণ করা হয়েছে। গত বছর ক্যানসারে তাঁর বাবা মারা গেছেন। কাজেই পড়াশোনা ছেড়ে বাচ্চাদের শিক্ষকতা করিয়ে সংসারের হাল ধরেন সোবিয়া।
লাহোরের হুমা মাজিদের কাছে চিকিৎসা নিতে আড়াই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে সোবিয়াকে। তার বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়দের কেউ সোবিয়ার এই ক্যানসারের কথাই জানেন না, চিকিৎসা তো দূরের কথা। কেনাকাটা করতে শহরে আসার কথা বলে অপারেশন করিয়েছিলেন তিনি।
সোবিয়া বলেন, ‘এটা ভীষণ স্পর্শকাতর একটা বিষয়। শরীরের ব্যক্তিগত অংশ নিয়ে সবার সামনে কথা বলি কীভাবে? আর আমার বয়সী একটা মেয়ের জন্য ব্যাপারটা বেশ গুরুতর। এই অসুখের কথা কেউ জানলে বিয়ের প্রস্তাব আসাও বন্ধ হয়ে যাবে। স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। একে তো এত বড় অসুখের ধাক্কা, তার ওপর নতুন করে জীবন শুরুর সব আশা শেষ হয়ে যাওয়া। এতগুলো শোক সামলানো খুব কঠিন।’
সিলভাত জাফরের অপারেশনের পর প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি লাহোরের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এখনো বিয়ে করেননি। বিয়ের বাজারে তার দাম কমিয়ে দিয়েছে স্তন ক্যানসার। সিলভাত বলেন, ‘অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু আমার স্তন ক্যানসারের কথা জানতে পেরে পাত্রপক্ষ তৎক্ষণাৎ সটকে পড়ে। এই অসুখের কথা জেনে কেউ আমাকে বউ হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি নয়।’
অক্টোবর মাস ছিল স্তন ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতার মাস। পাকিস্তানে পিংক রিবন ফাউন্ডেশনের মতো দাতব্য সংস্থাগুলো খুব জোরেশোরে প্রচারণা চালাতে ব্যস্ত। তারা লাহোরে পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু মিনার-ই-পাকিস্তান এবং ইসলামাবাদে সরকারি ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ভবন সাজিয়ে প্রচারণা চালায়।
প্রায় ১৫ বছর আগে এই গ্রুপটি গড়ে তোলা হয়েছিল। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে সম্প্রতি ট্যাবু ভেঙে স্তন ক্যানসারের ব্যাপারে প্রকাশ্যে কথা বলতে শুরু করেছে তারা।
দাতব্য প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ প্রচারণা চালিয়েছে কিশোরী বা তরুণীদের লক্ষ্য করে। তারা মেয়েদের প্রাথমিক রোগনির্ণয় এবং নিজেদের পরীক্ষা করে দেখার গুরুত্ব সম্পর্কে শেখাতে সারা দেশে ২০০টিরও বেশি কলেজ ঘুরে দেখছে।
ওমর আফতাব বলেন, ‘অল্প বয়সী মেয়েদের মাধ্যমে আমরা বাড়ির প্রবীণ নারীদের কাছে পৌঁছাতে পারি। সচেতন কোনো মেয়ে বাড়িতে গেলে স্তন ক্যানসার পরীক্ষা করে দেখার ব্যাপারে তার নারী আত্মীয়দের সচেতন করতে পারবে।’
তবে কিশোরী বা তরুণীদের মধ্যে স্তন ক্যানসার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানি দৈনিক ‘ডন’। দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং পাকিস্তানের ক্যানসার-বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে কিশোরীদের অনেককেই স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে দেখা যাচ্ছে। পুষ্টিহীনতা, অল্প বয়সে বিয়েসহ নানা কারণে তাদের শরীরে ক্যানসার কোষ জন্ম নিচ্ছে।
লাহোরে স্তন ক্যানসার চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা চলছে। সম্পূর্ণ নারী কর্মীদের তত্ত্বাবধানে রোগনির্ণয় থেকে চিকিৎসা পর্যন্ত এক ছাদের নিচে যাবতীয় ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের গ্রীষ্মে হাসপাতালটি চালু হওয়ার কথা।
চিকিৎসক, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও রোগীদের সবাই এ বিষয়ে একমত, স্তন ক্যানসারের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা খুব জরুরি।
হুমা মাজিদের মতে, পাকিস্তানের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ছেলেদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, ‘পুরুষদের বুঝতে হবে, এটা কোনো ট্যাবু নয়। বরং মা, স্ত্রী বা মেয়েরা নিয়মিত পরীক্ষা করছে কি না, তার খোঁজ নেওয়া ছেলেদের দায়িত্ব।’
তবে অক্টোবর মাসজুড়ে বড় বড় বুলি শোনা গেলেও, পরিবর্তন আসছে খুব কমই। ওমর আফতাব বলেন, ‘পাকিস্তানিদের মনোজগৎ খুব একটা পাল্টায়নি। ট্যাবুর বিরুদ্ধে বেশি করে আন্দোলন করা জরুরি।’
সোবিয়ার মতো নারীদের জীবনে পরিবর্তন আসতে অনেক সময় লাগবে, এ কথা মেনে নিয়েই এগোতে হবে। সোবিয়া বলেন, ‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। রোগীর পাশে থাকতে হবে, তাকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে। সমালোচনা করে কোনো লাভ হবে না।’
সিলভাত জাফরের প্রত্যাশা, নিজের গল্প শুনিয়ে তিনি অন্য নারীদের চিকিৎসা নিতে উৎসাহী করতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের স্তন ক্যানসারকে রুখে দিতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। উঠে দাঁড়াতে হবে, জিততে হবে।’