সবুজ চোখের কলজের টুকরোটা
সবুজ চোখ, সোনালি চুল—কী যে সুন্দর এক শিশু! নাম আদম। নাড়িছেঁড়া এই ধনের প্রথম কান্না শুনেই মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ফেলেন মা জোভান। অন্য ছেলেমেয়ের চেয়ে এ বাচ্চাটি একেবারেই আলাদা। এ যেন নিকষ আঁধারে হীরকছটা। কিন্তু সমাজ-পরিবার উপেক্ষা করেও এই কলজের টুকরোকে ধরে রাখতে পারেননি জোভান। বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই ইয়াজিদি মায়ের সন্তানের মায়া ত্যাগ করার মর্মন্তুদ কাহিনি।
স্বামী কাদেরকে নিয়ে ইরাকের খুব সুন্দর একটি গ্রামে সংসার পেতেছিলেন জোভান। সন্ধ্যা নামতেই বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে দুকাপ চা নিয়ে ছাদে বসতেন দুজন। তারা ভরা স্বচ্ছ আকাশের পানে তাকিয়ে স্বর্ণালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতেন। সেসব দিনের কথা মনে করে জোভান বলেন, জীবন এর চেয়ে রঙিন, এর চেয়ে সুন্দর হতেই পারে না।
কিন্তু ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে আচমকা এক ঝড় এসে বাকি জীবনের জন্য পাল্টে দেয় তাদের স্বপ্নের গতিপথ।
বন্দী জীবনের সূচনা
সে বছর আগস্টের এক দুপুরে কালো পতাকাবাহী দুটি গাড়ি আসে জোভানদের গ্রামে। ঠিক কী হচ্ছে বুঝতে না পারলেও বিপদের আঁচ পেয়েছিলেন জোভান-কাদের দম্পতি। কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারলেন, নির্মম জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) লোকজনের পা পড়েছে ছবির মতো সুন্দর গ্রামটিতে। দলের কয়েকজন সদস্যকে চিনতে পারলেন কাদের, তাদের গ্রামের লোকেরাও তাহলে আইএসে যোগ দিয়েছে! পরিচিত লোকজন এসে জানাল, আইএস–কে সাহায্য করলে কাদের বা তাঁর পরিবারের কারও কোনো ক্ষতি হবে না।
গ্রামের আরও ২০টি পরিবারের সঙ্গে কাদেরের পরিবারকেও নিয়ে যাওয়া হলো ইরাকের উত্তরাঞ্চলের সিঞ্জার উপত্যকায়। সে সময় কাদের বা জোভান ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি—সিরিয়া আর ইরাকজুড়ে আইএস যে সুদূরপ্রসারী বিধ্বংসী পরিকল্পনা নিয়েছে, অজান্তেই বাচ্চাদের নিয়ে তার অংশ হয়ে গেলেন এই দম্পতি।
আইএস এসেছে—এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল গোটা উপত্যকায়। আশপাশের গ্রামবাসী যে যার মতো পালিয়ে যেতে উদ্যত হলো। আইএসের পক্ষ থেকে কাদেরকে পাঠানো হলো গ্রামবাসীকে বোঝাতে। কাদের বলেন, ‘নেতার আদেশ মেনে সবার ঘরে ঘরে গিয়ে বললাম, ওরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করল না।’ ওই উপত্যকায় কাদেরের আপন ভাইও থাকতেন। কাদের ঘরে ফিরতে চান শুনে তিনি এককথায় জানিয়ে দিলেন, এমন আত্মঘাতী কাজ তিনি ভাইকে করতে দেবেন না।
কাদের-জোভান দুজনই ইয়াজিদি জনগোষ্ঠীর সদস্য। আইএস জঙ্গিদের উত্থানে যেসব গোষ্ঠীর ওপর প্রভাব পড়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ইয়াজিদি নামের একটি জনগোষ্ঠী। এদের কমবেশি ৫০ হাজার সদস্য আটকা পড়ে উত্তর-পশ্চিম ইরাকের পাহাড়ি এলাকায়। সেখানকার তাপমাত্রা অনায়াসে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। নেই পর্যাপ্ত পানি বা খাবার। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, সে সময় ইরাকে প্রায় চার লাখ ইয়াজিদি বাস করত। তাদের মধ্যে হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলা হয়। প্রায় সাড়ে ছয় হাজার নারী ও কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়। জোরপূর্বক তাদের যৌনদাসীতে পরিণত করেছে।
অন্য আরও জনা পঞ্চাশেক নারী ও শিশুর সঙ্গে তিন সন্তানসহ জোভানকেও একটি ট্রাকে তুলে নেয় আইএস সদস্যরা। সিরিয়ার রাক্কা এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। নিজেদের বাঁচানোর কোনো সুযোগই পাননি জোভানরা। এ ঘটনার চার বছরের মধ্যে কাদেরের সঙ্গে আর দেখা হয়নি তাঁর।
সিরিয়ার দিনগুলো
দ্রুতই জোভান টের পেলেন, দাসী হিসেবে বিক্রি করতে রাক্কার এক বাজারে নিয়ে আসা হয়েছে তাঁদের।
প্রায় দেড় হাজার নারী ও শিশুর সঙ্গে তিনতলা একটি বাড়িতে রাখা হয় তাঁদের। আশপাশের গ্রামের অনেক পরিচিত মুখের দেখা পান জোভান। তিনি বলেন, ‘একে অপরকে আশ্বাস দিচ্ছিলাম, দ্রুত আমাদের কষ্টের দিন শেষ হয়ে যাবে।’
মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। তিউনিসিয়ার নাগরিক, উচ্চপদস্থ এক আইএস কমান্ডার আবু মুজাহির আল তিউনিসিকে বিয়ে করার জন্য বেছে নেওয়া হয় জোভানকে। জোভান ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেই তাদের বিয়েতে আর কোনো বাধা থাকে না। এ খবর পেয়ে টানা কয়েক দিন কান্নাকাটি করেন তিনি। কিন্তু তিন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে মেনে নেন এ সিদ্ধান্ত। ভাগ্য লিখন মনে করে ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করেন মুজাহিরকে। বিয়ের পর বেশ কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করলেও মুজাহির টের পেয়ে তাঁকে ঘরে আটকে রাখেন।
অপহৃত নারী-শিশুদের দুর্দশার শেষ ছিল না। বাচ্চাদের বেশির ভাগকেই মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। ছেলেদের নিয়ে যাওয়া হয় সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, মেয়েরা বিক্রি হয়ে যায় দাসী হিসেবে। সেদিক থেকে ভাগ্যবান জোভান তিন সন্তানকে নিয়ে মুজাহিরের সঙ্গে রাক্কার একটি বাড়িতে ওঠেন। মুজাহিরের ব্যাপারে কথা বলতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল জোভানের। তবে বিয়ের সময় জোভানকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাচ্চাদের দেখাশোনা করতেন তিনি। অপারেশন না থাকলে মাঝেমধ্যে বাড়ির পাশের পার্কেও নিয়ে যেতেন তাঁদের।
বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় শরীরের ভেতর নতুন একটি প্রাণের অস্তিত্ব টের পেলেন জোভান। কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। আইএস জঙ্গিদের তৎপরতা তখন খুব বেশি। আজ সিরিয়া, কাল ইরাক, তো পরশু ইয়েমেন চষে ফেলছে তারা। যুদ্ধের ময়দানে বসেই মুজাহিরের মনে হলো, সময় যেহেতু দিতে পারছেন না, এর চেয়ে জোভানকে অন্য কারও কাছে বেচে দেওয়াটা লাভজনক হবে। এই চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরে জানতে পারলেন, জোভান অন্তঃসত্ত্বা। সঙ্গে সঙ্গে জোভানকে বিক্রির চিন্তা বাতিল করে দিলেন তিনি।
জোভান তখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এমন সময় খবর এল, যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছেন মুজাহির।
বাচ্চার সব দায়িত্ব তখন জোভানের একার হাতে। রাক্কা শহরে প্রতিদিন চলছে বিমান হামলা। সে সময়ের কথা মনে করে বলেন, ‘আমি জানি বাচ্চাটার বাবা খুনি। কিন্তু বাচ্চাটার তো কোনো দোষ নেই। ও তো আমারই অংশ।’ এরপর যখন আদম পৃথিবীতে আসে, তাকে দেখে বাকি তিন ভাইবোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। বাচ্চাটা যে দেখতে তাদের থেকে একদম আলাদা।
আদম হওয়ার পুরোটা সময় জোভানের পাশে ছিলেন বড় মেয়ে হাওয়া। হাওয়া কেবল তাঁর মেয়েই নয়, সবচেয়ে কাছের বন্ধুও। বেশির ভাগ সময় আদমের দেখভাল করত হাওয়া। শুকনো রুটি আর পানি খেয়েই কোনোমতে দিন কাটত তাদের। কতবার মনে হয়েছে, জীবনীশক্তি এই বুঝি ফুরিয়ে গেল। তবু আদমের ওই সবুজ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদ অনুভব করতেন জোভান।
পলায়ন পর্ব
ইরাকে বসে এসব কিছুই জানতে পারলেন না কাদের। প্রায় ১৪ মাস ধরে পরিবারের সদস্যদের খুঁজে ফিরছেন তিনি। যখনই খবর পেতেন কোনো নারীকে সন্তানসহ মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যেতেন সীমান্তে।
একসময় জোভানদের খোঁজ পেলেন তিনি। ছয় হাজার ডলারের বিনিময়ে প্রতিটি শিশুকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দিল কালোবাজারিরা। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে তিন বাচ্চাকে ফেরত আনেন কাদের। আদমকে সঙ্গে নিয়ে আরও দুই বছরের জন্য রাক্কায় থেকে গেলেন জোভান। কাদের আদমকে গ্রহণ করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল তাঁর মনে। আদমকে নিয়ে অন্যান্য ইয়াজিদি বিধবাদের সঙ্গে আইএস বন্দিশিবিরে ছিলেন জোভান।
ইয়াজিদি ধর্মের নিয়ম খুব কঠিন। কেউ যদি একবার ধর্মান্তরিত হয়, তবে তাঁর ফিরে আসার আর কোনো উপায় নেই। বন্দী নারীদের ক্ষেত্রে অবশ্য এ নিয়ম শিথিলযোগ্য।
কাদের বুঝতে পারেন, আদমের এখন মাকে প্রয়োজন। আদমসহ জোভানকে দেশে স্বাগত জানান কাদের। খুশিমনে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন জোভান। কিন্তু কিছুদিন পরেই সবার মন বদলে যায়। মুসলিম ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তানকে ত্যাগ করার জন্য জোরজবরদস্তি চলে জোভানের সঙ্গে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সাকিনা মুহাম্মদ আলী নামে মসুলের এক এতিমখানার ম্যানেজারের কাছে। আদমকে ওই এতিমখানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। চোখের জলে ছেলেকে বিদায় দিতে বাধ্য হন জোভান। ইয়াজিদিদের কাছে ধর্মের চেয়ে ব্যক্তি কখনোই বড় নয়।
চার বছর পর ঘরে ফিরে ভেঙে পড়লেন জোভান। এক মুহূর্তের জন্য আদমকে ভুলতে পারছেন না তিনি। স্বপ্নেও বারবার দেখা দিচ্ছে বাচ্চাটা। একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা এতিমখানার পথ ধরলেন তিনি। পৌঁছে জানতে পারলেন, আরও চারটি বাচ্চার সঙ্গে কোনো এক ভিনদেশে দত্তক দেওয়া হয়েছে আদমকে। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ায় জোভানকে তালাক দেন কাদের। জোভান তাদের ছেড়ে আদমকে বেছে নেওয়ায় জোভানের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে নারাজ ছিলেন তিনি। হাওয়া ছাড়া বাকি দুই ছেলেও বাবার সঙ্গে একমত ছিল।
শুধু জোভান নন, ইয়াজিদি এমন অসংখ্য নারী সিরিয়াই সন্তানকে ফেলে ইরাকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ১৬ বছরের লায়লাও তাদেরই একজন। সন্তানকে রেখে আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না লায়লার হাতে। একবার বাচ্চার মুখ দেখে মরতে পারবেন—এ আশায় কাটছে জোভান, লায়লাদের প্রতিটি দিন। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আইএসের সঙ্গেই বোধ হয় ভালো ছিলেন। তখন অন্তত সন্তানকে কাছে পাওয়ার জন্য এমন হাহাকার তো করতে হতো না!