রামমন্দির অনুচ্চারিত অযোধ্যার নির্বাচনে
সাধু-সন্ন্যাসীদের মধ্যেও যে ভেদাভেদ রয়েছে, জাতপাতের বেড়া আছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অযোধ্যাকে পাশ কাটিয়ে চলে না গেলে বোঝা যেত না। আর লোকসভা নির্বাচন চলাকালে সেই জাতপাতের ভেদাভেদ উঁকি মারতে শুরু করেছে। শুরু হয়ে গেছে পইতাধারী ও কণ্ঠিধারী সাধুসন্তদের আকচা-আকচি।
বিষয়টা খুলে বলা যাক। পইতাধারী সাধুরা ব্রাহ্মণ। বাবরি মসজিদের জায়গায় আলিশান রামমন্দির তৈরি করা তাঁদের বহুদিনের দাবি ও স্বপ্ন। আবার, যে বিশাল হনুমানগড়ি মন্দির রয়েছে, যার প্রধান সেবক ভবনাথ দাস, তিনি কণ্ঠিধারী। কণ্ঠিধারী সাধুরা ব্রাহ্মণ নন। রামমন্দির গড়ে তুলতে তাঁরাও সমান আগ্রহী। তবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, জবরদস্তি নয়। পইতাধারীরা ঘোর বিজেপির সমর্থক। কণ্ঠিধারীদের বেশির ভাগই সমর্থন করেন সমাজবাদী পার্টিকে।
এই দুই ধরনের সন্ন্যাসীই এবার প্রধানমন্ত্রীর ওপর বেশ রুষ্ট। কারণ পাঁচটা বছর কেটে গেল, মোদি একবারের জন্যও রামলালার দর্শন করলেন না। নির্বাচনের আগে এবার অযোধ্যাতেই ঢুকলেন না মোদি। শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মায়াবাজারে জনসভা করলেন ফৈজাবাদ ও আম্বেদকরনগর আসনের প্রার্থীদের নিয়ে। আর গত বুধবার সেখানে মিনিট দশেকের ভাষণে একবারও মন্দির প্রসঙ্গ উচ্চারণ করেননি মোদি। শুধু ভাষণ শেষ করেন ‘জয় শ্রীরাম’ বলে। পইতাধারী ও কণ্ঠিধারীরা বলাবলি করছেন, রামলালাকে এভাবে অশ্রদ্ধা করা মোটেই ভালো নয়।
সাধুসন্তরা দিনরাত মন্দির মন্দির করে কাটলেও অযোধ্যা ও ফৈজাবাদের মানুষজনের মধ্যে মন্দির নিয়ে এবার বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। লোকসভা ও বিধানসভার ভোটে এর আগে মন্দির এভাবে কখনো উপেক্ষিত হয়নি। ভোট হচ্ছে অথচ মন্দির রাজনীতি ইস্যু হচ্ছে না, অযোধ্যা-ফৈজাবাদে গত ৪০ বছর তা দেখা যায়নি। এই নির্লিপ্ততার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বিজয় শঙ্কর পান্ডে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ হওয়ার পরদিন মধ্যরাতে লক্ষ্ণৌ থেকে উড়িয়ে এনে আইএএস অফিসার বিজয় শঙ্কর পান্ডেকে ফৈজাবাদের জেলা শাসক করা হয়েছিল। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বিজয় শঙ্কর এই আসনের এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী।
বিজয় শঙ্করের ব্যাখ্যা, রাজনীতিটা মানুষ ধরে ফেলেছে। অযোধ্যা মন্দিরের শহর, হিন্দুদের পুণ্যভূমি। এই যে এত মন্দির, পূজার এত উপচার, এত জাঁকজমক, এসবের প্রতিটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হিন্দুদের পাশাপাশি স্থানীয় মুসলমানদেরও জীবন ও জীবিকা। অশান্তি তাঁরা কেউই তাই চান না। মানুষ বুঝেছে, মন্দির তৈরি হলে মানুষের ভিড় আরও বাড়বে। ভিড় যত বাড়বে, তত তীব্র হবে সমস্যা।
ক্ষমতায় এসে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ফৈজাবাদ জেলার নাম বদলে দিয়েছেন। নতুন নাম অযোধ্যা। তবে নির্বাচন কমিশন কেন্দ্র হিসেবে এখনো ফৈজাবাদকেই মান্যতা দিয়ে চলেছে। এই লোকসভা আসনের অধীন ৫ বিধানসভার একটি অযোধ্যা। বিজেপির উত্থানের সঙ্গে অযোধ্যা সম্পর্কযুক্ত। কাজেই ফৈজাবাদ আসন জয় শাসক দলের কাছে প্রতীকীও। গতবারের জয়ী বিজেপির লাল্লু সিংকে এবার মোকাবিলা করতে হচ্ছে এসপি-বিএসপি জোট প্রার্থী আনন্দ সেন যাদবের। গতবার এই দুই দলের প্রাপ্ত ভোট বিজেপির চেয়ে প্রায় দেড় লাখ কম ছিল। দুই প্রার্থী এবার চেয়ে রয়েছেন কংগ্রেসের নির্মল ক্ষেত্রীর দিকে। দুবারের সাংসদ নির্মলই এবার ঠিক করে দেবেন বিজেপি না জোট, জয়ী কে হবে।
জেলা আদালতের উকিল ত্রিযুগ নারায়ণ তিওয়ারি বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘নির্মল ক্ষেত্রী ব্রাহ্মণ। সজ্জন, কর্মঠ এবং জনপ্রিয়। তাঁর বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ নেই। গতবার ওই হাওয়াতেও তিনি দেড় লাখ ভোট পেয়েছিলেন। এই কেন্দ্রের মোট ১৮ লাখ ভোটারের মধ্যে ব্রাহ্মণ ৩ লাখ। অব্রাহ্মণ উচ্চবর্ণ ভোট সাড়ে ৩ লাখ। মুসলমান ৩ লাখ। বাকি তফসিল জাতি, অনগ্রসর এবং অন্যরা। জনপ্রিয়তার কারণে ব্রাহ্মণ ও অন্য উচ্চবর্ণের ভোট নির্মল বেশি পেলে বিজেপির ক্ষতি। আবার মুসলমান ভোট বেশি পেলে জোটের ক্ষতি।’ ত্রিযুগ নারায়ণ বললেন, ‘নির্মলকে নিয়ে বিজেপি ও জোট দুই দলই তাই টেনশনে।’
দুশ্চিন্তার আরও একটা কারণ বিজয় শঙ্কর পান্ডে। তিনিও ব্রাহ্মণ। বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পর অযোধ্যা বা ফৈজাবাদে যে দাঙ্গা হয়েছিল, বিজয় শঙ্কর তার মোকাবিলা করেছিলেন। মুসলমানদের পুনর্বাসনের কাজ নিজ হাতে করিয়েছিলেন। মুসলমান মহলে আজও তাই তিনি জনপ্রিয়। এক বছর ধরে কেন্দ্রের প্রতিটি গ্রামে তিনি গেছেন। এক বছর ধরে প্রচার করছেন ‘সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত’ রাজনীতির। কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোট তিনিও যদি পান, কে জানে কার কপালে শিকে ছিঁড়বে, কার কপাল পুড়বে। সে যাই হোক, কী আশ্চর্য, এই প্রথম রামচন্দ্রের জন্মভূমি অযোধ্যা-ফৈজাবাদের ভোটে রামমন্দিরই অনুচ্চারিত!