দুই মাস পরে ভোট, প্রথা ভেঙে অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটের বদলে নরেন্দ্র মোদির সরকার তাই প্রায় পূর্ণাঙ্গ বাজেটই পেশ করে দিলেন। আজ শুক্রবার কেন্দ্রীয় যে বাজেট পেশ হলো, তাতে প্রান্তিক কৃষক, অসংগঠিত ক্ষেত্রে দরিদ্র শ্রমিক ও চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের মন জয়ের চেষ্টা হয়েছে গত পাঁচ বছরে ক্রমশই যাঁরা সরকারের ওপর বিশ্বাস ও ভরসা হারিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি অসুস্থ হয়ে এখন আমেরিকায়। তাঁর জায়গায় বাজেট পেশ করেন অর্থ মন্ত্রকের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকেরা সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের বিধানসভা ভোটে। কংগ্রেসের কাছে তিন রাজ্যই হারিয়েছে বিজেপি। এরই মধ্যে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ঘোষণা করেছেন, কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে দরিদ্রদের জন্য ন্যূনতম রোজগার নিশ্চিত করবেন। কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি ও কৃষক-ক্ষোভের মোকাবিলায় বাজেটে তিনি যে প্রস্তাব দিলেন, তাতে বছরে বাড়তি খরচ হবে ৭৫ হাজার কোটি রুপি। প্রস্তাব অনুযায়ী, দুই হেক্টর অর্থাৎ ৫ একরের (১৫ বিঘা) কৃষি জমির মালিকদের ব্যাংক খাতায় বছরে ৬ হাজার রুপি সরকার জমা দেবে। এই রুপি জমা পড়বে দু হাজার করে তিন দফায়। সরকারের দাবি, এতে উপকৃত হবেন দেশের ১২ কোটি প্রান্তিক কৃষিজীবী।
ভারতের শিক্ষিত চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণি চিরকালই জনমত গঠনে প্রধান ভূমিকা নিয়ে থাকে। পাঁচ বছর আগের ভোটে এই শ্রেণিই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদির প্রধান সমর্থক। কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়া, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং কর্মহীন প্রবৃদ্ধির ফলে এই শ্রেণি ক্রমশই সরকারের কট্টর সমালোচক হয়ে উঠেছে। পীযূষ গোয়েল তাঁর বাজেটে এই চাকরিজীবী মধ্যবিত্তদের মন জিততে কর ছাড়ে বিশেষ নজর দিয়েছেন। আয়করের ঊর্ধ্বসীমা যা এত দিন পর্যন্ত ছিল আড়াই লাখ, তা বাড়িয়ে ৫ লাখ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর বাইরে দেড় লাখ রুপি পর্যন্ত বিনিয়োগে কর ছাড় ছিল। ফলে প্রস্তাব কার্যকর হলে চাকরিজীবী মধ্যবিত্তকে সাড়ে ৬ লাখ রুপি রোজগারের ওপর কোনো আয়কর দিতে হবে না। এই বাবদ সরকারের আয় কমবে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি রুপি।
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্যও একটি পেনশন প্রকল্পের কথা ঘোষিত হয়েছে। এই প্রকল্প অনুযায়ী কোনো শ্রমিক, যাঁর মাসিক আয় ১৫ হাজার রুপির কম, ৬০ বছর বয়সের পর অবসর নিলে তিনি মাসে ৩ হাজার রুপি করে পেনশন পাবেন। অস্থায়ী অর্থমন্ত্রীর দাবি, বাজেটে ঘোষিত সব প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে কোষাগার ঘাটতি দাঁড়াবে মোট জাতীয় আয়ের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
কৃষি, শ্রমিক ও চাকরিজীবী মধ্যবিত্তর মন পেতে তৈরি এই বাজেটকে বিরোধীরা ‘পূর্ণাঙ্গ বাজেট’ বলেই অভিহিত করেছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, ভোটের বছর ক্ষমতাসীন দল বরাবরই ‘ভোট অন অ্যাকাউন্ট’ পেশ করে, যাতে দু-তিন মাসের জন্য সরকারি খরচ অব্যাহত থাকে। আর্থিক বছরের বাকি সময়ের জন্য পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করে নব নির্বাচিত সরকার। এ ক্ষেত্রে মোদি-সরকার প্রথা ভেঙে পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করল।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এই বাজেটকে ‘ভোটের বাজেট’ বলে কটাক্ষ করেছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম বলেন, ‘এটা ভোট অন অ্যাকাউন্ট নয়, অ্যাকাউন্ট ফর ভোট।’ কংগ্রেস নেতা শশী থারুরের প্রশ্ন, ‘ঋণ জর্জরিত কৃষক বছরে ৬ হাজার রুপি (মাসে ৫০০) নিয়ে কী করবে, ভেবে পাচ্ছি না।’ বিরোধী অভিমত, এই বিপুল ছাড়ের টাকা কোথা থেকে আসবে, বাজেটে তার কোনো দিশা নেই।
শাসক দল বিজেপি অবশ্যই উৎফুল্ল। ভোটের মুখে এই জনমুখী বাজেট তাদের তুরুপের তাস বলে মনে করা হচ্ছে। চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের আয়করে ছাড়ের প্রস্তাব দেওয়া মাত্র লোকসভায় বিজেপি সদস্যরা প্রায় দুই মিনিট ধরে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ‘মোদি, মোদি’ ধ্বনি দেন। সংসদীয় ভারতের ইতিহাসে আইনসভায় প্রধানমন্ত্রীর নাম করে এমন জয়ধ্বনি কোনো দিন শোনা যায়নি।