মতুয়াদের জায়গায় মোদির সভা নিয়ে বিতণ্ডা
কলকাতার আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশ স্থগিত করে বিজেপি এবার ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে দুটি জনসভা করার উদ্যোগ নিয়েছে। একটি সভা হবে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থভূমি ঠাকুরনগরে। এখানে রয়েছে মতুয়া সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় আশ্রম। এখানেই থাকেন মতুয়া সম্প্রদায়ের গুরুমা বীণাপাণি দেবী।
মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটব্যাংকের দিকে তাকিয়ে বিজেপি এবার ঠাকুরনগরে একটি জনসভা করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই সমাবেশ তারা করবে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে নিয়ে। তাদের লক্ষ্য মতুয়াদের ভোটব্যাংক। পাশাপাশি একই দিন আরেকটি সভা করবে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পশহর দুর্গাপুরে। কিন্তু এই দুটি সভাস্থল নিয়ে নতুন করে জটিলতা হয়েছে। কারণ, মোদির সভা করার দিন আগামী ২ ফেব্রুয়ারি। অথচ ওই দিন থেকে মতুয়া সম্প্রদায়ের একাংশ ঠাকুরনগরে আয়োজন করেছে কীর্তন অনুষ্ঠানের। আর দুর্গাপুরের সভার জন্য নির্ধারিত রাজীব গান্ধী মেলা ময়দানেও অন্য একটি অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছে রাজ্য প্রশাসন। এ কারণে এই দুই জায়গায় মোদির সভা করা নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিজেপি ইতিমধ্যে দুর্গাপুরের সভাস্থল পরিবর্তন করে নির্ধারিত করেছে দুর্গাপুরের নেহরু স্টেডিয়ামে।
তবে ঠাকুরনগরে জটিলতা কাটেনি। কারণ, এখানের মতুয়া সম্প্রদায় দুভাগ হয়ে গেছে। একভাগ তৃণমূলের পক্ষে চলে গেছে। অন্য ভাগ বিজেপির পক্ষে। তৃণমূল পক্ষ চাইছে না মোদি এসে মতুয়াদের মধ্যে ভোটের ভাগ বসাক। অন্যদিকে, বিজেপি চাইছে মতুয়াদের ভোটে তারাও ভাগ বসাক। এই নিয়ে শুরু হয়েছে বাগ্বিতণ্ডা।
বিজেপির সমর্থক অংশের নেতা শান্তনু ঠাকুর বলেছেন, ‘আমরা মোদিজিকে নিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরনগরে সভা করব।’ শান্তনু অবশ্য বিদ্রোহী অংশের গড়া সারা ভারত মতুয়া মহাসংঘের সভাপতি। তিনিই আয়োজন করেছেন মোদিকে নিয়ে এই সমাবেশের। বলেছেন, এখানেই মোদিজির সভা হবে। তিনি এর আগে আরও বলেছেন, মোদিজি ঠাকুরনগরে এসে গুরুমাতা বীণাপাণি দেবীর আশীর্বাদ নেবেন। কিন্তু এই ঘোষণার পর উত্তর ২৪ পরগনার তৃণমূলের জেলা সভাপতি ও রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ঘোষণা দেন, ‘প্রণাম গ্রহণ দূরের কথা, বড় মা দেখাই করবেন না প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।’ মন্ত্রীর এই মন্তব্যের পর মুখ খুলেছেন শান্তনু ঠাকুর। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, ‘ঠাকুরনগরের মেলার মাঠ কি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের? ঠাকুরবাড়িও কি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের পৈতৃক সম্পত্তি? উনি এখানে বলার কে?’ এরপর শান্তনু বলেছেন, মোদিজির সভা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।
১৯ জানুয়ারি কলকাতায় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৩ দলকে সঙ্গী করে কলকাতার ঐতিহাসিক ব্রিগেডে এক মহাসমাবেশ করে বিজেপিকে হটানোর ডাক দেওয়ার পরই বিজেপি মোদিকে নিয়ে প্রথমে ব্রিগেডে সমাবেশ করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তৃণমূলকে পাল্টা জবাব দিতে পারবে না বলে সেই ব্রিগেড সমাবেশ স্থগিত করে ঘোষণা দেয় তাদের ব্রিগেড সমাবেশ হবে মার্চ মাসে। সেই তৃণমূলকে টেক্কা দিতে এবার মাঠে নেমে পড়েছে বিজেপিও।
বিজেপির লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটকে নিজেদের দিকে টেনে আনা। তাই মোদিকে নিয়ে এক সমাবেশ করার উদ্যোগ নিয়েছে তারা।
মতুয়া সম্প্রদায় এখনো উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদীয়া, মালদহ, মুর্শিদাবাদসহ এই রাজ্যে আরও কিছু এলাকার ভোটের নির্ণায়ক শক্তি হিসাবে রয়েছে। তাই তাঁদের মন পেতে এবার বিজেপি মতুয়া সম্প্রদায়ের ভারতের প্রধান আশ্রম ঠাকুরনগরে নিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী মোদিকে। সেখানের আশ্রমের কাছে বারুণি মেলা ময়দানে মোদির সমাবেশ করার উদ্যোগ নিয়েছে তারা। শান্তনু ঠাকুর বলেছেন, মতুয়া সম্প্রদায়ের ১০ দফা দাবি তারা তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে। এই দাবির মধ্যে রয়েছে মতুয়া উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদান, ঠাকুরনগরে আয়োজিত বারুণি মেলার দিনটিকে জাতীয় ছুটি ঘোষণা, মতুয়াদের ঠাকুরনগরে আসা-যাওয়ার সময় ট্রেনের ভাড়া ছাড় ইত্যাদি।
মতুয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। মমতারও একটা বিরাট ভোট ব্যাংক রয়েছে এই মতুয়াভক্তদের মধ্যে। সেটা জেনেই মমতা সম্পর্ক রেখেছেন মতুয়াভক্তদের সঙ্গে। সিঙ্গুর আন্দোলনের পর মমতা বারবার এসেছেন ঠাকুরনগরের এই আশ্রমে। আশীর্বাদ নিয়েছেন গুরুমায়ের। আর মমতার আগমনে এই গুরুমায়ের দুই ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর ও মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর পৃথকভাবে সাংসদ ও বিধায়কও হয়েছেন। কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর প্রয়াত হলে তাঁর সেই শূন্য আসনের উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে বনগাঁ কেন্দ্রের সাংসদ হন তাঁরই স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুর। মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর অবশ্য রাজ্যের মন্ত্রীও হয়েছিলেন।
যদিও সেই ঠাকুরনগর আর আজ নেই সেই পুরোনো দিনে। ঠাকুরনগরের মতুয়া সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন সংঘ। ঢুকে পড়েছে ঠাকুরনগরে বিজেপি। বিজেপিও আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ভোটব্যাংকে ভাগ বসানোর জন্য তৈরি হয়েছে। প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪টি রাজ্য বিধানসভার আসনের ৫৭টি আসনের এখনো নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে রয়েছে মতুয়ারা। পাশাপাশি লোকসভার ৪২টি আসনের মধ্যে ১০টি আসনেরও নির্ণায়ক শক্তি এই মতুয়ারা। যদিও মতুয়াদের আদি আশ্রম রয়েছে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দিতে; ভারত ভাগের পর প্রচুর মতুয়াভক্ত পশ্চিমবঙ্গে আসেন। তাঁরাই ১৯৪৭ সালের পর এই ঠাকুরনগরে তৈরি করেন তাঁদের দ্বিতীয় আশ্রম। এই আশ্রম এখন ভারতের কেন্দ্রীয় আশ্রম হিসেবে পরিচিত।