সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে ২০১১ সাল থেকে। আর গত চার বছর ধরে দেশটিতে ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) নির্মূল করতে সরাসরি কাজ করছে আমেরিকা। কিন্তু হঠাৎ করেই যুদ্ধ ময়দান থেকে নিজের সেনাদের ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ভাষ্য, যথেষ্ট হয়েছে। আইএসকে পরাজিত করা গেছে। এবার সেনাদের ফিরিয়ে আনতে হবে।
প্রেসিডেন্টের নির্দেশ মতো সিরিয়ায় অবস্থানরত প্রায় ২ হাজার মার্কিন সেনাকে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আমেরিকায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে। অনেক আলোচনা-সমালোচনা, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ, পেন্টাগনে ওলট-পালট, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বার্তা ইত্যাদির পর ১১ জানুয়ারি থেকে এই সেনা প্রত্যাহারের কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউএস টুডে। এ দিন সিরিয়ায় যুদ্ধরত মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল শন রায়ান জানান, ‘সিরিয়া থেকে স্বেচ্ছায় সরে আসার কাজ শুরু করেছে মার্কিন বাহিনী।’ গত ১৯ ডিসেম্বর সেনা প্রত্যাহারের এই আচমকা ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের সব মিত্রকে বিস্মিত করেছিল। বিশেষত সিরিয়ার কুর্দিরা শঙ্কার মুখে পড়েছে। আমেরিকার এই সরে দাঁড়ানো আইএসকে পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেবে। একই সঙ্গে এই প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে সিরিয়ার জ্বালানি তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চলের পূর্ণ কর্তৃত্ব তুলে দেবে ইরান, রাশিয়া ও বাশার সরকারের হাতে।
সিরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাঁড়ানোর অর্থই হচ্ছে সেখানে রাশিয়ার ভিত শক্ত হওয়ার সুযোগ। ২০১৫ সালে বাশার আল-আসাদ সরকারের সমর্থনে সিরিয়ায় সরাসরি জড়িয়ে পড়ে রুশরা। মস্কোর সহায়তায় আট বছর দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছান বাশার। এমনকি বাশারকে অপছন্দ করেন উপসাগরীয় অঞ্চলের এমন স্বৈরশাসকেরাও সিরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বহাল করে এ জয়ের স্বীকৃতি দিয়েছে।
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়ায় বর্তমানে অনেকগুলো পক্ষ ক্রিয়াশীল থাকলেও সেখানে একচ্ছত্র যদি কেউ এই মুহূর্তে থেকে থাকে, তবে তা রাশিয়া। সিরিয়ায় ইরান, তুরস্ক ও ইসরায়েল সক্রিয় ভূমিকায় রয়েছে। সেনা প্রত্যাহার মাত্র শুরু হওয়ায় আমেরিকাকেও সক্রিয় অবস্থাতেই গণ্য করতে হয়। কিন্তু এসব কিছু সত্ত্বেও সিরিয়ায় রাশিয়া চাইলে এই সব পক্ষকে হটিয়ে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার ক্ষমতা রাখে। তবে এই অবস্থানকে দীর্ঘস্থায়ী করে পুরো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হলে রাশিয়াকে এই ভয়াবহ যুদ্ধের পর দীর্ঘস্থায়ী শান্তির দিশা দিতে হবে।
এখন পর্যন্ত এই দায়িত্ববোধের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে মস্কো। বরং উল্টোটাই করছে তারা। বিভক্ত সিরিয়াকে এক করার উদ্যোগ নেওয়ার বদলে রাশিয়া আসাদকে আরও বিচ্ছিন্নতা তৈরিতে সহায়তা করছে। বিরোধী পক্ষকে বোমার আঘাতে উড়িয়ে দিতে কিংবা বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার—সবকিছুতেই এই সহায়তা অক্ষুণ্ন রয়েছে।
ইকোনমিস্ট বলছে, সিরিয়ায় আসাদ সরকার বিদ্রোহীদের দমনে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়ার সব ধরনের কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে লক্ষ্য করা হচ্ছে। সুন্নিদের মধ্যেই বাশার-বিরোধী অংশ বেশি। এ কারণে সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোয় নির্বিচার সরকারি হামলা চালানো হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া সুন্নিদের ফেলে যাওয়া ঘর-বাড়ি ও সম্পদ দখলে শিয়া, খ্রিষ্টান ও আলাওয়িত সম্প্রদায়ের লোকেদের সরাসরি সহায়তা করছে আসাদ সরকার। ফলে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে পড়েছে সিরিয়ায়। একই সঙ্গে যুদ্ধ সমাপ্তের কথা বললেও বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া ৬০ লাখ উদ্বাস্তু সিরীয়দের ফিরে আসার ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। লেবানন থেকে সিরিয়ায় ফিরে আসতে চাওয়া প্রায় হাজারখানেক সিরীয়কে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এসব সত্ত্বেও রাশিয়া বলছে, সিরিয়ার স্থিতিশীলতার স্বার্থেই বাশারের ‘বজ্র আঁটুনি’ প্রয়োজন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সিরিয়ায় রাশিয়া যে নীতি অনুসরণ করছে, তা এক মস্ত ভুল। কারণ এই পীড়নের নীতি বাশার সরকারকে টিকিয়ে দিলেও সিরিয়ার পুনর্গঠনকে কঠিন করে তুলেছে। এই নীতির কারণে ক্ষুব্ধ সুন্নিরা আশ্রয় নিচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীলদের ডেরায়। অসাম্য, দুর্নীতি ও বিভাজনের নীতিই ছিল আদতে বিদ্রোহের মূলে, যা একই সঙ্গে জঙ্গিদের পরিপুষ্ট করেছে। ফলে এমন একটি নীতি অনুসরণকারী সরকারের অধীনে দীর্ঘদিন থাকলে সিরিয়া কখনোই সত্যিকার অর্থে নিরাপদ হবে না। কিন্তু রুশনীতি সে রকম কোনো সম্ভাবনার কথা বলছে না।
অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে গড়ে তোলাই নিরাপদ সিরিয়ার পূর্বশর্ত উল্লেখ করে ইকোনমিস্ট বলছে, এখন পর্যন্ত যে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে লাভবান হবেন প্রেসিডেন্ট আসাদ ও তাঁর দলের লোকেরাই। অথচ সম্পদ ও ক্ষমতার বণ্টন আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত। এই দুইয়ের বিকেন্দ্রীকরণই একমাত্র নিপীড়িত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করতে পারে। শুধু সুন্নি নয়, সব সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জনের জন্যই এটি প্রয়োজন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আসাদ এসব কিছুর ধার ধারছেন না। অনেকটা প্রতিশোধপরায়ণের মতো তিনি যেন তাঁর হৃত এলাকা পুনরুদ্ধারে নেমেছেন।
এ অবস্থায় রাশিয়ার উচিত হবে প্রেসিডেন্ট আসাদের রাশ টেনে ধরা। এটা সম্ভবও। কারণ আসাদ বাহিনীর শক্তির মূলে রয়েছে রাশিয়ার শক্তিশালী বিমানবাহিনী। একই সঙ্গে নতুন কোনো সংঘাত যেন শুরু না হয়, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উত্তরাঞ্চলে কুর্দিদের নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই জরুরি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার কারণে কুর্দিদের নিরাপত্তা পুরোপুরি আসাদ সরকারের ওপর নির্ভর করছে। উত্তরাঞ্চলের একটি অংশ বর্তমানে তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যারা কুর্দিদের ‘সন্ত্রাসী’ মনে করে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়াকে অবশ্যই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে হবে। দক্ষিণে ইরানকে নিরস্ত করতেও তার ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে এই অংশে ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের নতুন করে সংঘাত শুরু হতে পারে।
কুর্দিদের বিষয়ে তুরস্ক যে নরম হবে না তা মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রথম খবরের সময়ই বোঝা গেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, কর্নেল শন রায়ান মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কথা জানালে তুরস্ক জানিয়েছে যে, এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আলাপ হয়নি। আর ৬ জানুয়ারি কুর্দি নিরাপত্তার বিষয়টিকে সেনা প্রত্যাহারের অন্যতম শর্ত বলার পর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের উদ্দেশে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছিলেন, ‘তাঁর বার্তা গেলাটা সম্ভব নয়।’ ফলে এই আশু সংঘাত নিয়ে রাশিয়ার গুরুত্ব সহকারে ভাবার কোনো বিকল্প নেই।
অনেকগুলো বড় শক্তি যে ময়দানে লড়াই করছে, তার নাম সিরিয়া। তাই যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের যুদ্ধ বেধে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই মুহূর্তে সিরিয়ার ভাগ্যবিধাতা হিসেবে হাজির হয়েছেন। তাঁর এই আসন অটল থাকবে যদি শান্তি আসে এবং তা স্থায়ী হয়। আসাদ সরকার যত রূঢ় হবে এই শান্তি তত সুদূর হবে। অর্জিত হলেও মিলিয়ে যাবে। তাই আসাদ সরকারের রাশ টেনে ধরাটাই সিরিয়ায় রুশ বিজয় স্থায়ী করার একমাত্র পন্থা।