সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর হত্যার বিষয়টি প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছে রিয়াদ। দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, মৃত্যুর আগে বাঁচার জন্য লড়াই করেছিলেন খাসোগি। ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে খাসোগি ঢোকার পর তাঁর অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছিল। সৌদি আরবের স্বীকারোক্তির পরই সেটির অবসান হলো।
সৌদির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে আরও বলা হয়েছে, দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার উপপ্রধান মেজর আহমাদ আল-আসিরি এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৌদি আল-কাহতানিকে সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় বরখাস্ত করা হয়েছে। আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৮ জনকে। গত শুক্রবার এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, জামাল খাসোগি হত্যার ঘটনায় আহমাদ আল-আসিরিকে সরিয়ে দেওয়ার কারণ হলো, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে এ ঘটনা থেকে বাঁচানো। আসিরি গত বছর গোয়েন্দা সংস্থায় দায়িত্ব পালন শুরু করার আগে সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁকে সালমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। গত বছর আসিরিকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে কাজ করায় আসিরি সাংবাদিক হিসেবে বেশ পরিচিত মুখ। ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের মুখপাত্র ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম ‘নিউইয়র্ক টাইমস’–এ গত বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল, খাসোগিকে হত্যার জন্য সৌদির সরকার আসিরিকে অভিযুক্ত করবে। খাসোগিকে হত্যার ঘটনায় সালমানের ওপর যে অভিযোগ উঠবে, তা অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এটি করা হবে।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে আরও বলা হয়েছে, সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা পুনর্গঠন করা হচ্ছে।
ইস্তাম্বুলে আল-জাজিরার প্রতিবেদক এন্ড্রু সিমনস বলেছেন, আসিরি সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। খাসোগির অন্তর্ধানের পর সৌদি রাজপরিবার তাঁর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিল।
২ অক্টোবর খাসোগি নিখোঁজ হন। এরপর তুরস্ক বলেছিল তাঁকে হত্যা করা হয়েছে এবং এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহের ১৫ জনের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তাতে আসিরির নাম ছিল না।
খাসোগির মৃত্যু হাতাহাতি থেকে
ঘটনার ১৭ দিন পর ‘হাতাহাতির একপর্যায়ে খাসোগির মৃত্যু’ হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এর আগপর্যন্ত ঘটনার ব্যাপারে টানা অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল দেশটি।
২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে ব্যক্তিগত কাগজপত্র আনার প্রয়োজনে ঢোকার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন সৌদির খ্যাতনামা সাংবাদিক খাসোগি। শুরু থেকে তুরস্ক দাবি করে আসছে, খাসোগিকে কনস্যুলেট ভবনের ভেতর সৌদি চরেরা হত্যা করেছে। গত বছর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতা গ্রহণের পর রোষানলে পড়েন খাসোগি। তিনি দেশ ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ওয়াশিংটন পোস্ট-এ যুবরাজ মোহাম্মদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে একের পর এক কলাম লেখেন। অভিযোগ উঠেছে, যুবরাজের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ হত্যা সংঘটিত হয়েছে। সৌদি আরবের এ বিবৃতির মধ্য দিয়ে যুবরাজের ‘মধুচন্দ্রিমার’ যবনিকাপাত টানা হলো বলে মনে করছেন অনেকে।
এই প্রথমবার সৌদি আরব স্বীকার করল খাসোগির মৃত্যু হয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রাথমিক প্রমাণের তথ্য তুলে ধরে জানিয়েছে, ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে হাতাহাতির একপর্যায়ে জামাল খাসোগি মারা যান। এতে বলা হয়, গোয়েন্দা উপপ্রধান আহমাদ আল-আসিরি ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের জ্যেষ্ঠ ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৌদ আল-কাহতানিকে এ ঘটনায় বরখাস্ত করা হয়েছে।
সৌদির প্রধান আইন কর্মকর্তা শেখ সৌদ আল-মোজেব এক বিবৃতিতে খাসোগির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে খাসোগির দেহ কোথায় রাখা হয়েছে, এ ব্যাপারে তিনি কোনো তথ্য দেননি।
বিবৃতিতে বলা হয়, কনস্যুলেট ভবনের ভেতর যে লোকগুলোর সঙ্গে খাসোগির দেখা হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে তাঁর মারামারি হয়। একপর্যায়ে খাসোগি মারা যান। বিবৃতিতে খাসোগির আত্মার শান্তি কামনা করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ঘটনার ব্যাপারে আরও তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় ১৮ জন সৌদি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
বরখাস্ত হওয়া সৌদ আল-কাহতানি ছিলেন সৌদি রাজ কোর্টের প্রভাবশালী সদস্য এবং যুবরাজ মোহাম্মদের উপদেষ্টা। টুইটারে তাঁর ১০ লাখেরও বেশি অনুসারী রয়েছে।
সৌদির সুর হঠাৎ কেন পরিবর্তন
সৌদি আরবের হঠাৎ এই সুর পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরে বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, এত দিন অস্বীকৃতি জানানোর পর সৌদি আরব স্বীকার করছে কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে খাসোগির মৃত্যু হয়েছে। তবে তুর্কি সরকারের তদন্তের সঙ্গে এর বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। তুর্কি কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুসারে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে, পরিকল্পিতভাবে খাসোগিকে নির্যাতন, হত্যা ও হত্যার পর করাত দিয়ে দেহ টুকরো টুকরো করা হয়েছে। ১৭ দিন পর সৌদি সংস্করণ আনা হয়েছে সেই ঘটনায়। দাবি করা হচ্ছে, মারামারির ঘটনা থেকে খাসোগির মৃত্যু হয়েছে। সৌদির দাবি, এটা পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। সৌদির এ ব্যাখ্যা ‘তালগোল পাকানো নাটকের’ মতো লাগছে।
সৌদি আরবের এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, যা ঘটেছে, তা ‘অগ্রহণযোগ্য’ কিন্তু সৌদি আরব তাঁদের ‘বড় মিত্র’।
এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, এই গ্রেপ্তারকে গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রথম পদক্ষেপ’ বলা যায়। এত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনায় তিনি সৌদির প্রশংসা করেন। সৌদির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে মার্কিন অর্থনীতিতে সম্ভাব্য কী প্রভাব পড়তে পারত, সে ব্যাপারে কথা বলেন তিনি।
সৌদি ঘোষণার পরপরই হোয়াইট হাউস এক বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়, খাসোগির মৃত্যুর নিশ্চিত খবর পাওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ‘গভীরভাবে মর্মাহত’। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের কাছ থেকে জানতে পেরেছে যে জামাল খাসোগির ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে ব্যাপারে দেশটির তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে এবং সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এই দুঃখজনক ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের বিষয় আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং আনুষঙ্গিক কাজসহ যথাসময়ে স্বচ্ছ ন্যায়বিচারের পরামর্শ দিচ্ছি। খাসোগির মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার খবরে আমরা ব্যথিত এবং তাঁর পরিবার, প্রেমিকা ও বন্ধুদের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’
গোয়েন্দা বিভাগের পুনর্গঠনে সৌদি বাদশাহ সালমান যুবরাজ মোহাম্মদের নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে খাসোগির ঘটনায় সৌদি বাদশাহ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন। তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, সিএনএন