শত শত যাত্রী বাঁচাতে প্রাণ দিলেন তিনি
ভূমিকম্প টের পেয়ে জীবন বাঁচাতে এয়ারপোর্টে তাঁর সহকর্মীরা সব ছুটে বেরিয়ে গেলেন। এমন সময় রানওয়েতে নামছিল একটি উড়োজাহাজ। শত শত যাত্রীর প্রাণ বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চাইলেন না তিনি। উড়োজাহাজটিকে নিরাপদে অবতরণের ব্যবস্থা করে বের হতে চাইলেন ভবন থেকে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যাত্রীদের প্রাণ বাঁচালেও নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না। তিনি ২১ বছরের তরুণ অ্যান্টোনিয়াস গুনাওয়ান আগুং। তিনি পালু এয়ারপোর্টে এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
গত শুক্রবার ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের পালু শহরে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের পর সুনামির ফলে সৃষ্ট প্রায় ১০ ফুট উঁচু ঢেউ পালু শহরকে ভাসিয়ে দেয়। মৃত মানুষের সংখ্যা ৮৩২–এ পৌঁছেছে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভূমিধসে শহরের প্রধান সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। লোকজন খোলা স্থানে অবস্থান করছে।
আগুংয়ের মৃত্যুর খবর অস্ট্রেলিয়ার এবিসির বরাত দিয়ে বিবিসি অনলাইন প্রকাশ করেছে। খবরে জানানো হয়, ভূমিকম্পের সময় কন্ট্রোল টাওয়ারে একমাত্র আগুংই দায়িত্ব পালনের জন্য নিজের প্রাণ বিপন্ন করে থেকে গিয়েছিলেন। ভূমিকম্পের শুরুর সময় বাটিক এয়ার ফ্লাইট ৬৩২১ রানওয়েতে ছিল। তবে ওই সময় তাঁর সহকর্মীরা দৌড়ে সবাই টাওয়ার থেকে বেরিয়ে যান। তিনি উড়োজাহাজটির নিরাপদ অবতরণ নিশ্চিত করার জন্য থেকে গিয়েছিলেন। টাওয়ারটি ধসে পড়তে পারে ভেবে তিনি টাওয়ারের পাঁচতলা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েন এবং গুরুতর আহত হন। পরে হাসপাতালে তিনি মারা যান।
এয়ার নেভিগেশন ইন্দোনেশিয়ার মুখপাত্র ইয়োহানেস সিরেইত বলেন, অ্যান্টোনিয়াস গুনাওয়ান আগুং শত শত যাত্রীর প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।
টুইটারে এয়ার নেভিগেশনের ভেরিভায়েড পেজে আগুংয়ের বীরত্বের কথা তুলে ধরে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। তাঁর মরদেহকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছে। আগুংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর সহকর্মীরা টুইটারে তাঁর ছবি প্রকাশ করেছেন।
পালুতে ভূমিকম্প ও সুনামিতে মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৮৩২–এ পৌঁছেছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ৫০০। এখনো অনেকে নিখোঁজ রয়েছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও অনেকে আটকা পড়ে আছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই মৃত ব্যক্তির সঠিক সংখ্যা নিয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
দুর্যোগবিষয়ক সংস্থার এক মুখপাত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, ভূমিকম্প ও সুনামিতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় হতাহত ব্যক্তির সঠিক সংখ্যা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। সুনামির পর উপকূলে অনেক মৃতদেহ দেখা গেছে। তাদের সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। এতসংখ্যক প্রাণহানি ভূমিকম্পে, নাকি ভূমিকম্প-পরবর্তী সুনামির কারণে হয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা বলছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। এই ঘটনায় তাৎক্ষণিক সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তা তুলে নেওয়া হয়। এ কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে ইন্দোনেশিয়ার আবহাওয়া সংস্থা।
ঘটনার সময় সৈকতে একটি উৎসবের জন্য নাচের শিল্পীরাসহ লোকজন জড়ো হয়েছিলেন। ১০ ফুট উঁচু সুনামি তাঁদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
ভূমিকম্পের পর থেকে পালুর বাসিন্দারা খোলা আকাশের নিচে রাত-দিন কাটাচ্ছে। রাজধানী জাকার্তা থেকে উড়োজাহাজে করে পালুতে সাহায্য পাঠানো হচ্ছে। পালু এয়ারপোর্টের রানওয়ের যে অংশটি অক্ষত রয়েছে, সেটুকু ব্যবহার করা হচ্ছে সাহায্য পাঠানোর কাজে। সামরিক উড়োজাহাজে করে আহত অনেককে চিকিৎসার জন্য বহন করা হয়েছে। শহরের হাসপাতালগুলোর বাইরে খোলা জায়গায় তাঁবু গেড়ে অনেককে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ভূমিকম্পের সময় পালু কারাগারের দেয়াল ধসে পড়লে ৫৬০ বন্দীর অর্ধেকের বেশি পালিয়ে গেছেন। কারারক্ষী আধি ইয়ান রিকোহ বলেছেন, পালিয়ে যাওয়া কয়েদিদের থামানো নিরাপত্তাকর্মীদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। সবাই আতঙ্কে ছুটছিলেন।
গত মাসে ইন্দোনেশিয়ার লমবক দ্বীপে সিরিজ ভূমিকম্প হয়। এর মধ্যে ৫ আগস্টের ভূমিকম্পে দেশটিতে ৪৬০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়। ভূমিকম্পপ্রবণ দেশটিতে ২০০৪ সালে ভূমিকম্পের পর ভয়াবহ সুনামি আঘাত হানে। এতে লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটে।