এক দিনেই পাল্টে গেল রাজধানীর চেহারা! যেদিকে চোখ যায়, হলুদ, সবুজ, লালে ছেয়ে গেছে চারপাশ। ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে কাটছে মাস, তারই মধ্যে হরতালবিহীন এই শুক্রবারে শহরের সবাই যেন বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। বসন্ত উৎসব জানিয়ে দিল, শত ভয়-আতঙ্ককে হারিয়ে মানুষ আর প্রকৃতি গাইতে পারে জীবনের জয়গান।
বসন্ত ঋতুরাজ হলেও সাহিত্যে বেশি কালি খরচ হয়েছে সম্ভবত বর্ষা নিয়ে। তবে তার পরেই বসন্ত। বসন্ত নিয়ে শুধু এক কবিগুরুর কবিতা বলুন, গান বলুন—কোনো অভাব নেই। পয়লা ফাল্গুনের ‘আহা, আজি এ বসন্তে’ অনেকটা পয়লা বৈশাখের ‘এসো হে বৈশাখ’-এর মতো। গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বসন্ত উৎসবে বেশির ভাগ সময়জুড়ে ছিলেন তিনি। আর বসন্ত নিয়ে নজরুলের রচনাও কম নয়। বকুলতলায় ছিলেন তিনিও। মাঝে ছিল শাস্ত্রীয় সংগীত, পল্লি ও আধুনিক গান।
উৎসবের সূচনালগ্ন ছিল শাস্ত্রীয় সংগীতের। সকাল সাতটার কিছু পরে অনুষ্ঠান শুরু হয় বসন্তের রাগ বাহার দিয়ে। সারেঙ্গিতে বাদনের পর প্রিয়াংকা গোপ একই রাগে গাইলেন, ‘বরন বরন ফুল খিলে, আয়ে বসন্ত বাহার’। বসন্তের ওপর একটি বন্দিশও তারপর পরিবেশিত হলো সমবেত কণ্ঠে।
বন্দিশ শেষ হতেই মাদল নিয়ে হাজির এক সাঁওতাল যুবক। দর্শকদের বসার জায়গার মধ্যেই ততক্ষণে নাচ শুরু হয়ে গেছে, ‘ওরে গৃহবাসী খোল, দ্বার খোল, লাগল যে দোল’। এরপর সুরের ধারা পরিবেশন করল ‘ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান’, সালমা আকবর গাইলেন ‘ওগো দখিন হাওয়া, ও পথিক হাওয়া’। পরিবেশিত হলো ‘ওগো কিশোর, আজি তোমার দ্বারে’, ‘দখিন হাওয়া, জাগো জাগো’, ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি’, ‘তোমার আনন্দ ওই এল দ্বারে’, ‘নব বসন্তের দানের ডালি এনেছি তোদেরি দ্বারে’, ‘আজি দখিন দুয়ার খোলা’ গানগুলোর সঙ্গে পরিবেশিত হয় নাচ।
বসন্ত উৎসব বকুলতলা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো চারুকলায়।
অনেকক্ষণ রবীন্দ্রনাথের পর নজরুলের গান নিয়ে মঞ্চে প্রথম এলেন শিল্পী ফেরদৌস আরার গানের দল সুর সপ্তক। পরিবেশিত হলো ‘আজকে দোলে দখিন দোলা’, ‘ফুল ফাগুনে এলো মৌসুম’। সুজিত মোস্তফা গাইলেন ‘দোলা লাগিল দখিনার বনে বনে’। আবৃত্তি করা হয় নজরুলের ‘বাসন্তী’ কবিতাটি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ কবিতাটিও আবৃত্তি করা হয়।
দিনব্যাপী বসন্ত উৎসব ছিল তিনটি পর্বে বিভক্ত। উৎসবের প্রথম পর্ব শেষ হয় বসন্ত শোভাযাত্রা দিয়ে। ফুল, আবির, জরি ছড়িয়ে গাওয়া হয় সত্যজিৎ রায়ের লেখা গান, ‘আহা, কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’।
বাহাদুর শাহ পার্কে
ইট-সুরকির বৃদ্ধ দালানগুলো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। সেখানে ভর করছে জীর্ণতা। তার ওপর শীতের শুষ্কতায় যেন পুরোনো শহরটা আরও ম্লান হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বসন্তের আগমন বদলে দিল পুরান ঢাকার রূপ। পুরোনো রাস্তার মোড়গুলোতেও গতকাল বসন্তের রঙিন আমেজ ভর করেছিল। বসন্ত উৎসব বদলে দিয়েছিল পুরান ঢাকাকে।
পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে বিকেল পাঁচটা থেকে বসেছিল বসন্ত উৎসব। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ সেখানে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো এই আয়োজন করে। ঢাকার আরও তিনটি স্থানের মতো এখানেও উৎসবটি জমে ওঠে এর প্রথম পরিবেশনা থেকে। সমীর বাউল যখন ‘ধন্য ধন্য বলি’ দিয়ে একতারায় প্রথম আঙুল ছোঁয়ালেন, পার্কে হঠাৎ জমে ওঠা ভিড় মুহূর্তেই উচ্ছ্বসিত করতালিতে উৎসবকে করে তুলল পরিপূর্ণ। কোনো আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন না এই উৎসবে। যারা ছিল সবাই যেন বসন্ত বাতাসের তোড়ে শহরের এ প্রান্তে ছুটে এসেছে। সমীর বাউল এরপর গাইলেন ‘কানার হাটবাজার’। ভিড় বেড়ে গেল আরও।
শহরের অন্য বসন্ত উৎসবের চেয়ে বাহাদুর শাহ পার্কের উৎসবটির পার্থক্য হলো এখানকার দর্শক। গান রবীন্দ্রনাথের হোক কিংবা শাহ আবদুল করিমের ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’—প্রতিটি পরিবেশনায় দর্শকের উচ্ছ্বাস একেবারেই অকৃত্রিম আর বাঁধভাঙা। তাই বাসচালক হাবিব যখন কাজের ফাঁকে পাওয়া একটু অবসরে এসে উৎসবে শামিল হলেন, তখন বসন্ত ছুঁয়ে যায় তাঁকেও। হাসিমুখে তিনি বললেন, ‘ট্রিপ শ্যাষ কইরা আইলাম। এইখানে গান হইল তাই শুনতে পারলাম।’ হাবিবের কথাতেই বোঝা গেল, কেন শহরের এ অংশেও উৎসবটির প্রয়োজন।
গানের পর ছিল দলীয় নৃত্য। সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘স্পন্দন’-এর শিশুশিল্পীরা পরিবেশন করে এ নাচ। সন্ধ্যা নামার পর তাদের নাচ দিয়ে ফাল্গুনের প্রথম সূর্যাস্তকে উদ্যাপন করা হয়। সন্ধ্যা যত গাঢ় হতে থাকে, উৎসবে বাড়তে থাকে দর্শক।
চট্টগ্রামে ভয়কে জয় করে বসন্তবরণ
ঢোলের বোল, বেহালার সুর, নৃত্য, গান, আবৃত্তি আর কথামালায় ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করেছে চট্টগ্রাম। বাসন্তী রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল চট্টলার পথঘাট, অলিগলি আর উৎসবস্থল। সকল ভয় জয় করে বাসন্তী রঙের পোশাক পরিহিত নর-নারীরা হাতে হাত ধরে নেচে-গেয়ে বসন্ত উৎসবকে আনন্দময় করে তোলেন।
নগরের ডিসি হিলে বোধন আবৃত্তি পরিষদ এবং চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে প্রমা আবৃত্তি সংগঠন এই পৃথক বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে। দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানমালার শুরু হয় নয়টা থেকে। উৎসব উপলক্ষে বিকেলে একটি বর্ণিল শোভাযাত্রাও বের করে বোধন।
সুরের ঝরনাধারার ফাঁকে ফাঁকে ছিল কথামালা। বসন্তকে স্বাগত জানিয়ে ডিসি হিলে বক্তব্য দেন জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন। ভারতীয় হাইকমিশনের সহকারী হাইকমিশনার সোমনাথ হালদার, খুলশী ক্লাবের সভাপতি নিয়াজ মোরশেদসহ কয়েকজন বক্তব্য দেন।
সকালে রণজিৎ রক্ষিত আবৃত্তি করেন রবিঠাকুরের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি। এরপর একক, দলীয় সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করেন বিভিন্ন শিল্পী। ‘ফাগুন হাওয়ায় দুলেছে যে দোল’, ‘মধুর বসন্ত এসেছে’, ‘তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব’ ইত্যাদি গানের সঙ্গে নেচে-গেয়ে বসন্তকে বরণ করেন তরুণ-তরুণীরা। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই উৎসবে সংগীত পরিবেশন করে।
এদিকে, সকালে চারুকলা ইনস্টিটিউটে প্রমার বসন্ত উৎসব উদ্বোধন হয় বেহালার সুরে সুরে। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক। এরপর রক্তকরবী ও অভ্যুদয় সংগীত অঙ্গন দলীয় সংগীত পরিবেশন করে।
একক সংগীত পরিবেশন করেন সামিনা চৌধুরী, সন্দীপন ও শ্রেয়সী রায়।
প্রতিটি উৎসবস্থলে ছিল উপচে পড়া ভিড়। বাসন্তী রঙের শাড়ি, পাঞ্জাবি আর হলুদ গাঁদায় রাঙানো নর-নারী বসন্ত আবাহনে মেতে ছিল সারা দিন।