ঘর থেকে বের হওয়াই বিপদ
সাধারণত যেটা হয়, আমরা দেখি, কোনো একটি দেশ সমস্যায় পড়েছে, কোনো একটি শহর সমস্যায় পড়েছে কিংবা একটি পরিবার সমস্যায় পড়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এখন বিশ্বের প্রতিটা দেশ, প্রতিটা শহর, প্রতিটা পরিবার সমস্যায় পড়েছে। আমাদের সবাইকে একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এটা অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি—যা আমরা কেউই কখনো ভাবিনি। মানবসভ্যতার জন্য এ ধরনের ঘটনা প্রথম। বসে বসে ভাবছিলাম, ১৯৮৮ সালে যখন বন্যা হলো, তখন আমরা সবাই মানুষের বিপদে ছুটে গিয়েছি। ক্যাম্পে থেকে স্যালাইন বানিয়েছি, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি—বিশ্বব্যাপী এই দুর্যোগে আমাদের সেই পরিস্থিতি নেই। এখন তো ঘর থেকে বের হওয়াই যেন দেশ ও মানুষের জন্য বিপদ। সবাই সবাইকে ভালো রাখার জন্যই ঘরে থাকতে হচ্ছে। তারপরও নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে বাজারে, দোকানে যেতে হচ্ছে।
করোনাভাইরাস–সংকটের এই মুহূর্তে আমাদের ব্যক্তিগত করণীয় ‘আত্মশুদ্ধি’। সবাই আমরা ঘরে আছি। এই সময়টায় নিজের যত্ন নেব, পরিবারের যত্ন নেব। পরিস্থিতি যা–ই আসুক, কোনোভাবে ভয় পাওয়া যাবে না। সবাই চিন্তিত থাকব, সেই সঙ্গে সতর্ক এবং সাবধানও থাকতে হবে। অন্য যেকোনো বিপদে মানুষের পাশে ছুটে যেতে পারলেও এই মানবিক বিপর্যয়ে আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছি না। ছুটে গেলেই যেন বিপদ। কারও পাশে দাঁড়ানোটাই দুজনের জন্য ঝুঁকির কারণ। এই সময়টা ঘরে থাকার। ঘরে বসেই আমরা প্রার্থনা করতে পারি। সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য শুভ কামনা করতে পারি।
আমরা এখন করোনাভাইরাস–সংকটের প্রথম ধাপে আছি। একটু একটু করে করোনা ছড়াচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপে করোনা মহামারি আকারে ছড়াতে পারে। তৃতীয় ধাপ—যেটা করোনা শেষ হওয়ার পরবর্তী সময়—এটি সারা বিশ্বকে কোন দিকে নিয়ে যায়, তা আমরা কেউই জানি না। করোনা নিয়ে এখন পর্যন্ত যা কিছু ভাবছি ও বলছি, সেটা পুরোপুরি অনুমানের ওপর নির্ভর করে। বিশ্বের করোনা পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যাবে, বিভিন্ন দেশের গ্রাফ উচ্চমুখী ও নিম্নমুখী হচ্ছে, এটা হতেই থাকবে। কিন্তু এই পরিস্থিতি কখনো যদি থেমে যায়, তাহলে পরবর্তী পরিস্থিতি কী হবে? এখন পর্যন্ত আমরা করোনা নিয়ে যেটুকু জেনেছি, যে অভিজ্ঞতা হয়েছে—তা খুব বেশি নয়।
আমাদের সরকারপ্রধানের প্রতি আস্থা আছে। আমি নিশ্চিত, আমাদের কিছু ভালো পলিসি তৈরি করা হবে। কারণ, আমাদের এখানে করোনা পরিস্থিতি মহামারি হলে সামাল দেওয়াটাও মুশকিল হবে। যদিও আমরা বিভিন্ন সময় চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। এই যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেছি। কিন্ত এই পরিস্থিতি সারা বিশ্বের মতো আমাদের জন্যও নতুন।
আমার মনে হয়, এ সময় আমাদের প্রধানতম জায়গা আত্মশুদ্ধি বাড়ানো। কদিন আগেও আমরা খুবই অস্থির ছিলাম। এখন সবাই স্থির। আমাদের হাতে এখন অনেক সময়। আমরা পরিবারের পাশে থাকতে পারি। সম্পর্কগুলোকে যত্ন নিতে পারি। ঘরের অনেক কাজ ছিল, সেগুলো করা হতো না, গৃহপরিচারিকার ওপর নির্ভর ছিলাম; সেগুলো এখন নিজেই দায়িত্ব নিয়ে করছি। এটাও আমার কাছে মনে হয় নতুন উপলব্ধি। আমরা নির্ভর করতে করতে অনেক দূর চলে গেছি, কিন্তু এখন আমরা আত্মনির্ভরশীল হতে পারছি। আমার মনে হয়, পুরো মানবসভ্যতার একটা নতুন ধরনের উপলব্ধি হবে। এই দিনে আমি একটা নতুন স্বপ্নও দেখছি, আমার মনে হচ্ছে করোনার কারণে সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। মানবিক ও সুন্দর পৃথিবী গড়ে উঠবে। আমার এ–ও মনে হয়, সারা পৃথিবীর সব মানুষ এখন একই কথা ভাবছেন। অপরিসীম অমঙ্গল থেকে হঠাৎ একটা ভীষণ মঙ্গল কিছু বের হয়ে আসবে। এই করোনা ওলট–পালট পৃথিবীর মধ্য দিয়ে হয়তো মানবসভ্যতার কোনো নতুন উপলব্ধি হবে। সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে।