মেহ্জাবীনের পোড়া হাত, ট্রল ও কড়া জবাব
সে অনেককাল আগের কথা। কত আগের, তা ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে যে ঘটনাটি বলব, সেটি ঘটার কিছুদিন আগেই ধুমধাম করে উদ্যাপিত হয়েছে মেহ্জাবীনের প্রথম জন্মদিন। মাত্র হাঁটি হাঁটি পা পা করে কয়েক পা এগিয়ে ‘ধাম’ করে বসে পড়েন ছোট্ট মেহ্জাবীন। ফ্রক পরে বাবার কোলে চড়ে গিয়েছিলেন কোনো এক বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে।
তারপর ঘটল সেই দুর্ঘটনা
বিয়েবাড়িতে ড্যাগ (ডেকোরেটর বড় হাঁড়ি) ভর্তি খাবার মাত্রই রান্না করে রাখা হয়েছে। আর মেহ্জাবীনও সদ্য শেখা হাঁটা হাঁটছেন। হঠাৎ কী হলো, মেহ্জাবীন পড়ে গেলেন। আর হাত গিয়ে পড়ল চুলা থেকে মাত্র নামানো তরকারির ভেতর। সঙ্গে সঙ্গে নরম হাতের চারটি আঙুল পুড়ে জোড়া লেগে গেল।
হাসপাতালে ১৫ দিন ও ৩টি সার্জারি
বিয়ে ভুলে বাবা ও কাছের মানুষেরা মেহ্জাবীনকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালে। দেড় বছর বয়সে হলো প্রথম অপারেশন। সেবার আঙুলগুলো আলাদা করা হলো। এর কয়েক বছর পর দ্বিতীয় দফায় অপারেশন হলো। সেবার আঙুলগুলো সোজা করা হলো। এরপর তৃতীয় অপারেশনে হাতে, আঙুলে মাংস লাগানো হলো। এভাবেই প্রায় ১০ বছর চলল।
আমার তো হাত আছে, অনেকের যে হাতই নেই
১০ বছর বয়সে চিকিৎসক মেহ্জাবীনের হাতে প্লাস্টিক সার্জারি করতে চাইলেন। সেই বয়সেই মেহ্জাবীন বলেছিলেন, ‘আমি তো আমার এই হাত দিয়ে স্বাভাবিকভাবে সবকিছু করতে পারছি। প্লাস্টিক সার্জারির কোনো প্রয়োজন নেই। আমার হাত যথেষ্ট সুন্দর আছে। রংও ঠিকই আছে। আমার তো স্বাভাবিক হাত আছে, কত মানুষের যে হাতই নেই।’ মেহ্জাবীনের মা–বাবাও তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করেছিলেন। তাই আর প্লাস্টিক সার্জারির পথে হাঁটেননি মেহ্জাবীন।
একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্ট ও কটু মন্তব্যের বন্যা
এরপর মেহ্জাবীন পানীয় হাতে একটি ছবি পোস্ট করলেন ইনস্টাগ্রামে। ক্যাপশনে লিখলেন, ‘ব্যাংককে এটিই আমার প্রিয় পানীয়।’ গতকাল পর্যন্ত ছবির নিচে জড়ো হলো ৬৩ হাজার ৩৬৫ ‘লাভ’ আর ১ হাজার ১২৮ জনের মন্তব্য। সেই হাত দেখে অসংখ্য মন্তব্য ছিল এ রকম: ‘এ কী, এ তো একটা বুড়ির হাত।’ ‘হাতের কী অবস্থা!’, ‘করোনাভাইরাসে ধরছে?’, ‘বয়স যে কম হয় নাই, হাত দেখেই বোঝা যায়। বিয়ের কোনো খবর নাই। কী হবে এই টাকাপয়সা দিয়ে’, ‘বুড়ি হয়ে গেলেন বিয়ের আগেই? টাকা কামাইতে কামাইতে শেষ’, ‘বোঝার আর কিছু বাকি নাই। করোনা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে ঢুকানোর জন্য উঠে পড়ে লাগছে। আজ ব্যাংকক, কাল সিঙ্গাপুর, পরশু চীন’ ইত্যাদি। অবশ্য কেউ কেউ যে মন্তব্যেই ট্রলকারীদের জবাব দেননি এমন নয়।
মেহ্জাবীনের পাল্টা জবাব
পরদিন হাতের দুটি ছবি পোস্ট করে ট্রলকারীদের কড়া ভাষায় উত্তর দিলেন খোদ মেহ্জাবীন। সেই ছবির নিচে জড়ো হয়েছে ১ লাখ সাড়ে পাঁচ হাজার ‘ভালোবাসা’। লিখলেন, ‘হ্যাঁ, এটা আমার বাঁ হাত। কোনো ধরনের এডিট বা ফিল্টার ছাড়া এটাই আমার আসল হাত। মাত্র এক বছর বয়সে হাঁটা শিখতে গিয়ে একটি দুর্ঘটনায় আমার হাত পুড়ে যায়। তিনটা অস্ত্রোপচারের দরকার পড়ে। আমি নিজের সিদ্ধান্তে প্লাস্টিক সার্জারি করাইনি। কারণ, যতবার আমি আমার হাতের দিকে তাকাই, আমার মনে পড়ে যায়, আমি কতটা সাহসী। সমস্ত যন্ত্রণা পেরিয়ে আমি আজকের আমি হয়েছি।’ মেহ্জাবীন আরও জানান, তিনি তাঁর হাত নিয়ে মোটেও লজ্জিত নন। তাই ঢেকে রাখার প্রয়োজন বোধ করেন না।
‘আমার হাত নয়, আপনাদের হৃদয় বাজে’
মেহ্জাবীন আরও লেখেন, ‘যে মন্তব্যগুলো আপনারা আমার হাতের ছবিতে করেছেন, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এসব টিটকিরি, বডি শেমিং আমার হাত নয়, আপনাদের হৃদয় কতটা বাজে, সেটাই প্রকাশ করে। আমি আপনাদের একটা মন্তব্যও ডিলিট করিনি। কারণ, আমার হাত নিয়ে আপনারা কে কী ভাবলেন বা লিখলেন, তাতে আসলে আমার কিছু আসে–যায় না। আপনারা কেমন, সেটিই প্রকাশ করে আপনাদের এসব মন্তব্য।’
নারী, পুরুষ সমতা, টিটকিরি নয়, বর্ণবৈষম্য নয়—এসব কোথায়?
মেহ্জাবীন এসব নিয়ে কথা না–ও বলতে পারতেন। যেহেতু, এসব বাজে কথায় তাঁর কিছু আসে–যায় না। তিনি ওই মানুষদের এতটা ক্ষমতাশীল করেননি যে তাঁদের এসব কটু মন্তব্যকে তিনি পাত্তা দেবেন। তাহলে কেন? উত্তরে প্রথম আলোকে মেহ্জাবীন বলেন, ‘এখন ২০২০ সাল। এখনো যদি আমরা এসব নিয়ে কথা না বলি, তাহলে আর কে বলবে? কবে বলবে? আমরা মুখে মুখেই সমতা, নো বুলিং, নো বডি শেমিংয়ের কথা বলি। কিন্তু আমাদের জীবনে এসবের প্রয়োগ কোথায়?’
কথা কম, কাজ বেশি
মেহ্জাবীন বলেন, ‘এখন সময় কম কথা বলে কাজটা ঠিকঠাক করার। আর সেটা নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হবে। আগে নিজেকে বদলান। ভালোবাসা ছড়ান।’
মেহ্জাবীনের কাছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা
মেহ্জাবীন সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় বিশ্বাসী নন। তাঁর মতে, ‘এর কোনো মাপকাঠি নেই। কেউ ঠিক করে দিতে পারে না যে এত ইঞ্চি পর্যন্ত সুন্দর, এরপর অসুন্দর। ব্যাপারটা এ রকম নয়। কেউ হয়তো মোটা বলে সুন্দর। কারও দাঁতটা বাঁকা বলে ভালো লাগে। কারও সৌন্দর্য তাঁর চিন্তায়, শক্তিতে, কথায় আর আচরণে। এসব নিয়েই প্রতিটি মানুষ তার নিজের মতো করে সুন্দর।’