তিন কণ্ঠে বাংলা ছবি

জয়া আহসান, নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: কবির হোসেন
জয়া আহসান, নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: কবির হোসেন
>শুরু হলো লুই কান দিয়ে। ঢাকার ভেতর কোথায় ঘোরা যায়, সবার আগে এ প্রশ্ন করলেন নন্দিতা রায়। স্থাপত্যশিল্পের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বিশেষ। তাই লুই কানের দিকে তাঁর পক্ষপাত। শিবপ্রসাদের আকর্ষণ আবার পদ্মার ইলিশে। তিনি জানতে চাইলেন, ‘পদ্মায় গিয়ে ফিরে আসা যাবে কতক্ষণে? ইলিশ খাওয়া যাবে তো?’ 

কিন্তু কথা চলে এল ইলিশ থেকে সরাসরি সিনেমায়।
নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরিচালক–জুটি প্রথমবার ঢাকায় এসেছিলেন ২০১৫ সালে, বেলাশেষে ছবিটি নিয়ে। এবার কণ্ঠ এনেছেন। এ দুই নির্মাতার সঙ্গে কণ্ঠ ছবিতে যোগ দিয়েছেন আমাদের জয়া আহসান। তিনি আছেন পশ্চিমবঙ্গের এ ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। ৮ নভেম্বর বাংলাদেশের ২২টি প্রেক্ষাগৃহে কণ্ঠ মুক্তি পেয়েছে।
তাঁদের সঙ্গে আলাপে জমে গেলেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ

সাজ্জাদ শরিফ: কলকাতার পরিচালকদের মধ্যে বাংলাদেশে আপনাদেরই সবচেয়ে বেশি ছবি মুক্তি পেয়েছে। কণ্ঠ নিয়ে মোট তিনটি। বাংলাদেশে ছবি দেখানোর জন্য এত আগ্রহের কারণ কী?

নন্দিতা রায়:
আমরা সারা পৃথিবীর বাঙালির জন্য ছবি বানাই। আমাদের ভাষা এক, অনুভূতি এক, ভালোবাসার জায়গা এক। কলকাতার বাঙালি ছবিটি দেখছে। বাংলাদেশের বাঙালিরা দেখবে না কেন? দর্শকের পরিধিটা বাড়লে তো আমাদের ভালোবাসার পরিধিটাও বেড়ে যায়।

শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দ
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দ

সাজ্জাদ: কণ্ঠ অবশেষে ঢাকাতে এল। জয়া আহসান ছবিটিতে আছেন। পশ্চিমবঙ্গে সামনের কাতারের পরিচালকদের প্রায় সবার সঙ্গেই জয়া কাজ করে ফেলেছেন। আপনাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন সবার শেষে। কেন এত পরে?

শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
: ছবিটা হওয়ার কথা কিন্তু তিন বছর আগে। সবার আগে এই ছবিতে কিন্তু জয়াই ছিল। সমস্যা হয়েছিল এর আরেক চরিত্র অর্জুন মল্লিককে নিয়ে। অভিনেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি এ চরিত্রের জন্য তৈরি ছিলাম না। নন্দিতাদিও অন্য কাউকে নিয়ে ছবিটা করতে রাজি ছিলেন না। তাই কাজ এগোচ্ছিল না। কিন্তু জয়া সব সময়ই ছিলেন। কারণ এ চরিত্রে জয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। পশ্চিম বাংলায় জয়ার যে ফ্যান বেইজ, সেটা ভাবাই যায় না। তার ওপর এই চরিত্রে যে মানের অভিনয়ের পারদর্শিতা দরকার, তাতেও জয়ার বিকল্প ছিল না। সত্যি বলতে কি, অনেক বছর পর বাংলায় এমন একজন অভিনেত্রী পাওয়া গেল, যাঁকে কেন্দ্র করে সিনেমা বানানোর সাহস করা যায়। আমি ব্যবসার দিক থেকেও বলছি। পশ্চিমবঙ্গে জয়ার প্রতিটি ছবি ব্যবসায়িক সফলতা পাচ্ছে। সেখানকার প্রযোজকদের জন্য জয়া এখন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য শিল্পী। তাঁর ওপর বিনিয়োগ করা যায়।

নন্দিতা: চরিত্রটির জন্য যখন প্রথম জয়াকে ডাকি, তখনো নিশ্চিত ছিলাম না যে, ওকে নিয়ে কাজ করব। কারণ রমিলা চরিত্রটি ছিল স্পিচ থেরাপিস্টের। তাকে শ্বাসনালি দিয়ে কথা বলতে হবে। জয়া পারবে কি না আমি জানতাম না। চরিত্রটির প্রস্তুতির জন্য অনেক সময় দিতে হবে। স্পিচ প্যাথোলজিস্টদের সঙ্গে কর্মশালা করতে হবে। কণ্ঠনালির ক্যানসারের রোগী, রোগীর পরিচর্যাকারী, ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। জয়া বাংলাদেশে আসা–যাওয়া করে কাজ করত বলে শুরুতে দ্বিধা ছিল, ও সময় দিতে পারবে তো? জয়া আমার অফিসে এল। আমি ওকে বললাম, ‘তুমি কি শ্বাসনালি দিয়ে কথা বলতে পারবে?’ জয়া দুই মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে ঢেকুর তুলে কথা বলতে শুরু করল। আমি তো অবাক। একজন মানুষ এত দ্রুত এভাবে চরিত্রের জন্য তৈরি হতে পারে? বুঝলাম, এ চরিত্রে জয়াকেই চাই। চরিত্রটি লেখার সময় রমিলা বাংলাদেশের মেয়ে ছিল না। জয়ার সেই অভিনয় দেখার পর চিত্রনাট্য বদলে ফেললাম। রমিলা হয়ে গেল ফরিদপুরের মেয়ে।

সাজ্জাদ
: জয়া, শিবপ্রসাদ–নন্দিতার সঙ্গে আপনারও প্রথম। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

জয়া: কণ্ঠ আমার কাছে ছিল একটা অদ্ভুত লার্নিং প্রসেস। সব ছবি থেকেই আমরা কম–বেশি শিখি। কিন্তু এ ছবির বিষয়টা ছিল খুব সংবেদনশীল। ক্যানসার শব্দটা শুনলেই তো মন কেমন আঁতকে ওঠে। কিন্তু এ ছবিতে পুরো ব্যাপারটা উঠে এসেছে একেবারে ভিন্নভাবে। স্পিচ থেরাপিস্টের কোনো চরিত্র মনে হয় না বাংলা ছবিতে আগে কেউ করেছেন। ঢেকুর তোলা ভদ্র কিছু নয়। সবার সামনে তোলা তো রীতিমতো বিব্রতকর। সেখানে আমি অভিনেত্রী হয়ে পর্দায় ঢেকুর তুলব, মুখ–চোখ বাঁকিয়ে কথা বলব—বিষয়টা সহজ ছিল না। কিন্তু শিল্পীর তো নিজেকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে হবে, তাই না? আমরা যত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ব, তত উত্তরণ হবে। তাই চরিত্রটা পেয়ে আর ডানে–বাঁয়ে ভাবিনি। চরিত্রের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে অনেক দিন ধরে আমাকে কর্মশালা করতে হলো। প্রস্তুত হতে গিয়ে স্পিচ থেরাপির ওপর ছোটখাটো ডিপ্লোমা করে ফেললাম প্রায়।

সাজ্জাদ:
এর আগে যে বাংলাদেশে বেলাশেষে আর পোস্ত মুক্তি দিয়েছিলেন, আপনাদের কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল?

শিবপ্রসাদ
: এ দেশের দর্শকেরা যে ভালোবেসে আমাদের ছবি দেখেন, কিছু ঘটনায় তা আমরা বুঝতে পারি। কলকাতায় আমাদের ছবি মুক্তি পেলে বাংলাদেশের অনেক মানুষকে শুধু ছবি দেখার জন্য সেখানে যেতে দেখেছি। ছবি মুক্তি পেলে আমরা নিয়মিত সিনেমা হল ভিজিটে যাই। কারা আমাদের দর্শক, সেটা বুঝতে না পারলে তাঁদের জন্য ছবি বানাব কী করে। আর সে সময়ই কলকাতার দর্শকদের পাশাপাশি বাংলাদেশের দর্শকদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। কেউ কেউ এসে বলেন, ‘মনে আছে, ইচ্ছে ছবিটার সময় দেখা হয়েছিল?’ একই রকম মানুষের সঙ্গে প্রাক্তন আর বেলাশেষের সময়ও দেখা হয়েছিল।

আলাপে জয়া আহসান, নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দ
আলাপে জয়া আহসান, নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দ

নন্দিতা: বাংলাদেশের এক দর্শকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল, যিনি আমাদের একটা ছবি সতেরোবার দেখেছিলেন। সেটাই এখানে আমাদের ছবি নিয়ে আসার পেছনে আগ্রহের কারণ।

শিবপ্রসাদ
: ভারতে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইরেসির জন্য সে ছবি নিমেষেই সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটা নিয়ে নানা কথা দেখি। দেখলাম, সেখানে কথা বলছেন বেশির ভাগই বাংলাদেশের দর্শক। ছবি মুক্তি পেলে দর্শক তো দ্রুত দেখতে চাইবেনই, সেটা যেভাবেই হোক না কেন। বাংলাদেশে ছবি মুক্তি দেওয়ার সময় খুবই আনন্দের অনুভূতি হয়। কারণ আমাদের দর্শকের পরিধি বেড়ে গেল, ভালোবাসার পরিধি বেড়ে গেল। দুঃখের অনুভূতিও হয়। ছবিটি তো সময়মতো এ দেশের দর্শকদের দেখাতে পারিনি। যে সময় ছবিটা পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পাচ্ছে, সে দিনটিতে বাংলাদেশেও মুক্তি দেওয়া গেলে সবাইকে বক্স অফিসে বাংলা সিনেমার জাদু দেখিয়ে দেওয়া যেত। বাড়িয়ে বলছি না, পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা হলে আমাদের কোনো ছবি তোলা হলে চার সপ্তাহ অন্য আর কোনো ছবি হলে ওঠে না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমার স্বপ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের সিনেমা হলে আমাদের ছবি শুক্র, শনি, রোববার টানা অথবা সাত দিনে সাতটা হাউসফুল শো দেখা।
সাজ্জাদ: দর্শকদের আগ্রহ তো দেখেছেনই, কিন্তু বাংলাদেশে সিনেমা–বাজার নিয়ে আপনাদের কোনো সমীক্ষা আছে? 

শিবপ্রসাদ: পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের বাজার তো একই। একই শ্রেণির দর্শক সিনেমা হলে এসে ছবি দেখছে। কলকাতায় যে দর্শকেরা সিনেমা হলে আসছে, বাংলাদেশেও তেমন দর্শকই ছবি দেখছে। যে ধরনের দর্শক পশ্চিমবঙ্গে ছবি দেখছে না, তেমন দর্শক এখানেও আছে। মোদ্দাকথা, সিনেমার যে বাজারটা আমাদের ওখানে আছে, এখানকার বাজারও সেই একই। শুধু আমাদের ছবিটা এখানে দেরি করে আসছে বলে বা ছবি মুক্তির দিনই পাইরেসি হয়ে যাচ্ছে বলে আর এখানে সিনেমা দেখানোর মতো পর্যাপ্ত সিনেমা হল নেই বলে আমরা সেটা বুঝতে পারি না।
আমি ওখানকার একটা হিসাব দেখাই। কলকাতা শহরে কেবল বাংলা ছবি দেখানোর সিনেমা হল ১৭০টা। এগুলোর মধ্যে পরিবার নিয়ে দেখার যোগ্য হলো এক শর মতো। অর্থাৎ, আমি কোনো বড় বাজেটের ব্লকবাস্টার ছবি বানালেও সেটা এক শর বেশি হলে মুক্তি দিতে পারব না। অন্যদিকে আমরা যে দক্ষিণ ভারতে ছবির ২০০–৩০০ কোটি রুপি আয়ের কথা বলি, তাদের হিসাবটা দেখুন। শুধু অন্ধ্র প্রদেশেই সিনেমা দেখার জন্য ১ হাজার ৬০০ পর্দা রয়েছে। তাহলে প্রতিদিন এতগুলো পর্দায় একটা ছবির পাঁচটা করে প্রদর্শনী হলে আর সেটা এক সপ্তাহ চললে বাহুবলী কেন ব্লকবাস্টার হিট হবে না? আমরা ওখানেও বারবার বলি, হিন্দি ছবি আমাদের ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি করছে, আমাদের ব্যবসা হচ্ছে না। কিন্তু আসল কথা হলো, দর্শকদের আমরা আমাদের ছবি দেখাতে পারছি না। বাংলা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। এই শক্তি আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। বিজিবি নামে তেলেগু একটা ছবি ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে মাত্র সাত দিনে। হৃতিক রোশনের ছবিও সেটা করতে পারে না। কীভাবে করল? কারণ দর্শকদের ল্যাংগুয়েজ লয়ালটি, নিজের ভাষার প্রতি আনুগত্য। সেই আনুগত্যের সুফল আমরা নিতে পারছি না। বাহুবলী ছবিটা কী? পুরোটাই লোকগাথা। বাঙালির লোকগাথা তো আরও সমৃদ্ধ। বড় ক্যানভাসে মৈমনসিংহ গীতিকা বা সোজন বাদিয়ার ঘাট নিয়ে কি আমরা ছবি বানানোর কথা ভাবতে পারি? আমাদের ভাবতে হয়, দেখাব কোথায়? টাকা উঠবে কি না?

জয়া আহসান, নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: কবির হোসেন
জয়া আহসান, নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: কবির হোসেন

সাজ্জাদ: জয়া, আপনি তো দেবী ছবিটা প্রবাসী বাঙালি দর্শকদের জন্য বাইরের কয়েকটা দেশে মুক্তি দিয়েছিলেন। আপনার অভিজ্ঞতা কী?

জয়া আহসান
: সিনেমার বেলাতে আমরা বলি এপার বাংলা, ওপার বাংলার দর্শকদের কথা। কিন্তু এর বাইরেও কিন্তু প্রবাসী বাঙালিদের একটা বিরাট অংশ নানা দেশে ছড়িয়ে আছে। তারা প্রবাসে বাংলার সংস্কৃতির চর্চা করছে। তারা বাংলা সিনেমা দেখতে চায়। সেটাও বড় বাজার। দেবীর বেলায় আমি তাদের বাংলা সিনেমা দেখতে চাওয়ার সেই খিদেটাকে মেটাতে চেয়েছি। আমার কথা ছিল, আমি আমার ছবি দেখাবই। আমি তো সিনেমাটা বানিয়েছি দর্শককে দেখানোর জন্যই। দর্শক দেখেছেনও প্রাণভরে। দেশের বাইরে বাংলা ভাষার কোনো ছবি প্রথম সর্বোচ্চ ৩০টি জায়গায় প্রদর্শন করার স্বীকৃতির জন্য আমরা গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে আবেদনও করেছি।
প্রদর্শন ও পরিবেশনের নানা জটিলতার কারণে নিজের ঘরে হয়তো পুরো টাকাটা নিয়ে আসতে পারিনি, কিন্তু আমাদের হলমালিক ও প্রদর্শকেরা দেবীর কারণে পুনরুজ্জীবিত বোধ করেছিলেন। এই একই ঘটনা ঘটেছিল দেশের বাইরেও। প্রচুর লোক দেবীর জন্য অপেক্ষা করেছে এবং দেখেছে।

সাজ্জাদ
: কণ্ঠ এ দেশে এসেছে, আবার আপনার অভিনীত খাঁচা ছবিটি ভারতে যাচ্ছে। আপনার কি মনে হয়, ছবিটা ভারতে ঠিকঠাক প্রদর্শিত হবে?

জয়া
: চ্যানেল আই এই বিনিময়ের সঙ্গে আছে। আমার চেয়ে তারাই সেটা ভালো বলতে পারবে।

সাজ্জাদ
: পশ্চিমবঙ্গের দর্শকদের মধ্যে দেবী দেখার জন্য আগ্রহ প্রবল। আপনিও ছবিটা ওখানে নিয়ে যেতে চাইছেন বহুদিন থেকে। আপনি কেন পারছেন না?

জয়া:
এখানে–ওখানে দুজায়গা মিলিয়েই জটিল একটা অবস্থা। অজস্র লাল ফিতার বাধা পার হতে হতে দম ফুরিয়ে যায়। এখানকার ছবি নিয়ে ওখানে মুক্তি দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটা এত জটিলতা ও ঝক্কির যে, বলে বোঝানো যাবে না। এর ভেতর দিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে প্রতিদিন নতুন করে শক্তি সঞ্চার করতে হয়। এগুলো সহজ না করলে ক্ষতি আমাদেরই। তবে যত দেরিই হোক তারপরও আমি চাইছি, পশ্চিমবঙ্গের দর্শক বড় পর্দায় দেবী দেখুক। সে চেষ্টা করছি।
শিবপ্রসাদ: আমাদের দুদেশের ছবি একই দিনে একই সময়ে দুই দেশে মুক্তি দিতে পারলে এক বছরে বাংলা চলচ্চিত্র–বাজারের আয় দাঁড়াবে অন্তত ১০০ কোটি টাকা। আমরা যে মাটির ময়না বা আহার মতো বাংলাদেশের ছবিগুলো দেখতে পেলাম না, এতে ক্ষতিটা কিন্তু হলো আমাদের সবার। নিয়ম মেনে দুই দেশেই প্রদর্শনের ক্ষেত্র খোলা থাকলে কেউই বঞ্চিত হতো না। জানেন, একটা সময় প্রযোজকেরা আমাদের তামিল–তেলেগু ছবির ডিভিডি দিয়ে বলত, ‘এ রকম একটা ছবি বানিয়ে দিন। আমরা তা করিনি। তেমন ছবির বাজার ছিল ৮ থেকে ১০ কোটি রুপির। আর আমাদের ধারার ছবির বাজার ছিল ১০–১২ লাখের মতো। সে সময় আমরা আপসহীন ছিলাম বলে পুরো চিত্রটাই এখন পাল্টে গেছে। এখন আমাদের সিনেমাই হয়ে উঠেছে আমাদের শক্তি।

সাজ্জাদ:
বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে একসময় লা দলচে ভিতা বা জেড–এর মতো ছবি চলেছে। এখন তো ভাবাই যায় না। ভারতেও হলিউডের বাইরে অন্য দেশের ছবির প্রদর্শিত হয় না। ধরা যাক, সিনেমা পারাদিসোর মতো ইতালীয় ব্লকবাস্টার ছবিও সেখানে হলে মুক্তি পায় না। পশ্চিমবঙ্গে কি বাংলা এবং হিন্দি বা বিদেশি ছবি দেখানোর জন্য কোনো প্রদর্শন–মডেল আছে?

শিবপ্রসাদ: হিন্দি আর বিদেশি ছবির সঙ্গে আমাদের ভয়ংকর প্রতিযোগিতা করতে হয়। দেশি–বিদেশি ছবি দেখানোর কোনো কোটা সেখানে নেই। যে ছবি চলবে, তাকেই হল দিয়ে দেওয়া হবে। এমনও হয়েছে, বাংলা ছবির স্লট নিয়ে গেছে হলিউডের ইংরেজি ছবি। আবার ইংরেজি ছবির শো–ও অনেক সময় বাংলা ছবিকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেটা যে সময় ভালো চলে, সেটাই চালানো হয়। কনটেন্টের জোর যার থাকবে, সেটাই চলবে।

সাজ্জাদ
: দেশি ছবিকে প্রটেকশন দেওয়ার নামে যে এক দিকের ছবি আরেক দিকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। এতে কী লাভ হচ্ছে কে জানে! ভালো ছবি হচ্ছেই না প্রায়। দর্শকও যেভাবে হোক বাইরের ছবি দেখেই ফেলছে। মাঝখান থেকে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে। অথচ সেটা না হলে প্রদর্শকেরাও টাকা পেতেন। হলগুলো টিকে থাকত। এমন কথা কিন্তু অনেকেই বলছেন।
শিবপ্রসাদ: এতে পাইরেসির রমরমাটাই প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। পাইরেসিই এখন ছবির সবচেয়ে বড় হুমকি। মুক্তির প্রথম দিনেই যে লোকটি ছবি পাইরেসি করে দিল, সে জানে না কত বড় ক্ষতি করে দিল সিনেমাটার। বিনিময়ে সে হয়তো খুব অল্প অর্থই পাচ্ছে। কিন্তু এর কারণে সরকারের রাজস্ব এবং শত শত মানুষের শ্রম এক নিমেষে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে দুই দেশের সরকারের। নিয়ম মেনে দুই দেশেই প্রদর্শনের ক্ষেত্র খোলা থাকলে আর কেউ বঞ্চিত হতো না। সরকার রাজস্ব পেত। অবৈধভাবে এখন টাকা নিয়ে যাচ্ছে মাঝখানের এক গোষ্ঠী। ছবি না বানিয়ে এবং কর না দিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে তারা। চলচ্চিত্রের মঙ্গলের জন্য দুই বাংলায় পরস্পরের ছবির প্রদর্শন খুলে দেওয়া দরকার। তবে আমাদের স্বচ্ছতাও বাড়াতে হবে, কমাতে হবে জটিলতা ও লাল ফিতার প্রভাব।

সাজ্জাদ: স্বচ্ছতার ব্যাপারে একটু জয়ার কাছে শুনব? দেবী ছবির টাকা কি হিসাবমতো পেয়েছেন?

জয়া
: দেবী নিয়ে অস্বচ্ছতার কারণে অনেক জটিলতার মুখে পড়েছি। তবে দেবী দেখাতে গিয়ে আমি এ–ও দেখেছি, মানুষ সিনেমা দেখার জন্য কতটা উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকে। আমি দেখেছি সাদা মার্কিন কাপড়ের ওপর প্রজেক্টর দিয়ে আলো ফেলে সিনেমা চালানো হচ্ছে। ধুলো উড়ছে চারপাশে, আসনে ছারপোকা। এরপরও মানুষ দেখছে। দর্শকদের আমরা ছোট করে দেখি। এটা মোটেই ঠিক নয়। ভালো ছবি দিলে তাঁরা অবশ্যই তা দেখবেন। আর ভালো পরিবেশে দেখতে পারলে আরও বেশি মানুষ যাবেন।

সাজ্জাদ
: ছবির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কোলাবরেশন বা বিনিময়ের অভিজ্ঞতা একেক সময় একেক রকম। যৌথ প্রযোজনার বেলাতেও তাই। ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের উৎকৃষ্টতম সমবায়ী উদ্যোগ। ঋত্বিক পরে এ ছবির চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলামকে কলকাতায় নিয়ে যান যুক্তি তক্কো আর গপ্পো করাতে। সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। এ ধরনের বিনিময় সফল করার জন্য, চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পরিধি দুদিকেই বাড়ানোর জন্য আর কী করা যায়?

শিবপ্রসাদ
: যৌথ প্রযোজনা আর যৌথ পরিবেশনার মাধ্যমে যৌথ প্রদর্শন। যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে লাল ফিতে আছে। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বার্থেই সেটা সরাতে হবে। যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণের প্রক্রিয়ায় চলচ্চিত্রবান্ধব মানুষদের বেশি করে যুক্ত থাকতে হবে। তাহলে তারা বুঝবে, বেশি দিন অপেক্ষা করালে ছবিটা পড়ে যায়। এই সমস্যাটা বাংলাদেশে যেমন আছে, তেমনি পশ্চিমবঙ্গেও আছে।
আজকে আপনি একটা পথের পাঁচালী বা ভিলেজ রকস্টার বানাতে পারবেন না। কারণ একটা ছবি বানাতে গেলে এখন আপনাকে ১০০ জন কলাকুশলী নিয়ে ঘুরতে হবে। একটা বর্ষার শট নিতে গেলেও ওদের নিয়ে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। ব্যবসায়িক দিক থেকে তো সেটা সম্ভব নয়, কিন্তু সিনেমার দিক থেকে ভাবলে অপেক্ষাটা আপনাকে করতেই হবে। এভাবে বাংলা সিনেমা একটা স্থবিরতার মধ্যে ফেঁসে গেছে। একেকটা ছবি হয়ে উঠেছে একেকটা প্রকল্প। আমি শুনেছি, ঋত্বিক ঘটক নাকি শুটিংয়ের প্রথম দিন সেটে গিয়েই প্যাকআপ করে দিয়েছিলেন। প্রযোজক হাবিবুর রহমান খানকে বলেছিলেন, ‘তুমি তো বুর্জোয়া। আমি চাই তোমার পকেট থেকে একটু টাকা খসুক। টাকাটা শ্রমিক শ্রেণির জন্য দিলাম একটু।’ এ সময়ে এমন সম্পর্ক ভাবা যায়?

সাজ্জাদ: অভিজ্ঞতার বিনিময়ও তো লাভজনক হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে কাজ করার কারণে আপনি কি এমন কিছু শিখেছেন, যেটা দেবী ছবিকে সহায়তা করেছে?

জয়া
: ছবি তো শুধু বানালেই হয় না, দেখাতেও হয়। পশ্চিমবঙ্গে সিনেমা করতে গিয়ে দেখলাম, ছবি মুক্তির আগে প্রযোজক–পরিচালকেরা মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। কেন এত উত্তেজনা? না, প্রচারের জন্য। বুঝলাম, শুধু ছবি বানিয়ে বসে থাকলেই হয় না, প্রচারের জন্যও সমান শ্রম দিতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে চলচ্চিত্র–বাজার থেকে আমি এটা শিখেছি। ওই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা নিজেরা প্রচারের নানা অভিনব উপায় বের করেছি। সেটা কাজেও দিয়েছে।

সাজ্জাদ
: আমাদের এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবির ধারণা প্রোডাকশনের শৃঙ্খলার অভাবে তলিয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা কি আপনার কাজে লেগেছিল?

জয়া
: অবশ্যই। এখানকার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। কিছুদিন আগে বিউটি সার্কাস নামে আমি একটি ছবি করেছি। সার্কাস–শিল্পীর কাজটি কী যে কষ্ট করে শিখে অভিনয়টা করেছি। কষ্ট করেছি, কিন্তু আনন্দও পেয়েছি অনেক। একজন অভিনয়শিল্পী এমন চরিত্রের জন্য স্বপ্ন দেখেন। শুধু প্রোডাকশন ডিজাইনের অভাবে ছবিটা আটকে আছে। আমাদের এখানে সবাই প্রথমেই পরিচালক হয়ে যেতে চায়। কিন্তু একজন নির্মাতাকে তো লাইট থেকে প্রোডাকশন পর্যন্ত সব কাজ বুঝতে হয়। পরিচালককে পুরো জিনিসটা দেখতে পারতে হয়। সেখানে আমাদের প্রবল ঘাটতি। নির্দিষ্ট বাজেটের মধ্যে ছক কেটে কী করে একটা ছবি শেষ করে ফেলতে হয়, কলকাতা থেকে আমি সেটা শিখেছি। নইলে দারুণ সব আইডিয়ার দিক থেকে আমরা কিন্তু ওদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। আমাদের ভাবনা ভালো, ওদের বাস্তবায়ন।