ব্রেকিং ব্যাড : ছোট পর্দায় সিনেমাটিক স্বাদ
‘ব্রেকিং ব্যাড’ সিরিজ নিয়ে আলোচনার কমতি নেই। ১১ অক্টোবর মুক্তি পাচ্ছে এই সিরিজ অবলম্বনে নেটফ্লিক্সের নতুন ছবি এল কামিনো: আ ব্রেকিং ব্যাড মুভি। তবে সিনেমায় ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে আমরা জেনে নিই এই সিরিজ নিয়ে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতা আদনান আল রাজীব–এর কথাগুলো। ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ব্রেকিং ব্যাডের প্রতিটি পর্ব দেখে এই লেখা লিখেছেন তিনি।
ইদানীং ল্যাপটপ নিয়ে বসে দর্শক হিসেবে আমাকে অনেক চিন্তা করতে হয়। কী দেখব, কোনটা এখন বেশি সমসাময়িক—এ নিয়ে ভাবতে হয় লম্বা সময়। প্রতিদিন কোনো না কোনো নতুন টিভি বা ওয়েব সিরিজ, সিনেমা বের হচ্ছে। সিনেমার আলাদা ঘরানার পছন্দ-অপছন্দ বেছে দেখা হয়। কিন্তু কোনো টিভি সিরিজ শুরু করা মানে বেশ লম্বা সময়ের জন্য কিছুর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে যাওয়া। চরিত্রগুলোর সঙ্গে একটা লম্বা সফরে বেরিয়ে পড়া। ‘গেম অব থ্রোনস’, ‘নার্কোস’, ‘মাইন্ডহান্টার’, ‘পিকি ব্লাইন্ডার্স’, ‘ব্ল্যাক মিরর’ আমার খুবই পছন্দের সিরিজ। দীর্ঘদিন ধরে এগুলোর প্রত্যেকটা চরিত্র, বিশ্লেষণ, এর শেষে কী হবে, এ বিষয়ে অনুমান—এসব নিয়ে আড্ডাবাজি করেছি। পিকি ব্লাইন্ডার্সের স্টাইল, ব্ল্যাক মিরর–এর গল্প বলার ঢং অদ্ভুতভাবে আমার ওপর প্রভাব ফেলেছে। তবে আমাকে অনেক ভাবিয়েছে, অনেক অনেক দিন ধরে আমাকে আটকে রেখেছে ‘ব্রেকিং ব্যাড’।
কমবেশি যারা সিরিজ দেখে বা খানিক খোঁজ রাখে, আমার ধারণা সবাই এটার সম্পর্কে জানে। প্রান্তিক জীবনের কাহিনি বরাবরই মানুষের সঙ্গে অনেক দ্রুত কানেক্ট করে। তবে ব্রেকিং ব্যাডের প্রভাব এই সিরিজে থাকা আলোচিত মাদক ‘মেথ’–এর মতোই প্রবল। পুরো সিরিজে চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক সফর যতটা বিশাল পরিসরে সিনেম্যাটিক মোড় আর মোচড় নেয়, সেটা টেলিভিশনে আগে দেখা গেছে বলে জানি না। আমি অন্তত প্রথমবার দেখেছি। দ্য ওয়ার, সোপরানোর মতো সিরিজগুলো ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ একটা আবহ তৈরি করেছে, যেখানে ব্রেকিং ব্যাড আমার কাছে মনে হয়েছে অনেক বেশি লিনিয়ার স্টোরি টেলিং।
আপনি ওয়াল্টার হোয়াইট-এর চরিত্রের চড়াই–উতরাই খেয়াল করে দেখুন। খুবই সাধারণ জীবন যাপন করা এক শিক্ষক। নিজের সংসার, বাচ্চা, ভবিষ্যৎ নিয়ে আর দশটা মানুষের মতোই একটা চাপ কাজ করে তার মস্তিষ্কে। ওয়াল্টার যখন ঠিক এই ছাপোষা জীবনটাকেই অভ্যাস বানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ে। ওয়াল্টারের স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা, তাঁদের বড় ছেলে জন্ম থেকেই খানিকটা মানসিক ভারসম্যহীন। সবকিছু মিলিয়ে ওয়াল্টারের ওপর যখন সামাজিক আর অর্থনৈতিক চাপ পড়ে, তখন মৃত্যুভয়ের থেকেও তাঁকে বেশি উদ্বিগ্ন তাঁর পরিবারের ভবিষ্যৎ। এখানে চরিত্রটাকে খুব সহজেই সমাজের অন্য সব সুবিধাবঞ্চিত সংগ্রামী মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা যেত, কিন্তু ব্রেকিং ব্যাডের মূল হর্তাকর্তা ভিন্স গিলিগান খুবই সহজভাবে ওয়াল্টারকে শক্তিমান, আপসহীন আর অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক যোদ্ধার রূপ দিয়েছেন। গিলিগান যখন প্রথম এই ধারাবাহিকের প্রস্তাব দেন, তিনি বলেছিলেন, ‘এই শো পরিবর্তনের কথা বলবে।’ (ইটস আ শো অ্যাবাউট চেঞ্জ)
জেসি পিংকম্যানের চরিত্রের ছকও সিরিজজুড়ে প্রচণ্ড অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু খুবই আকর্ষণীয়। সে তরুণ, অনেক দারুণ একটা ভবিষ্যৎ তার সামনে থাকার কথা। স্কুলে সে ওয়াল্টারের ক্লাসে ঘুমিয়ে যেত, রসায়ন তার পছন্দের বিষয় ছিল না কখনোই। অথচ পিংকম্যানকে ধীরে ধীরে পরিপক্বতার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে শুরু করেছিল একজন ঝরে পড়া ছাত্র হিসেবে, যে লুকিয়ে মেথ নামের মাদক বিক্রি করে, যেটা আসলে খুব ভালো মানের মেথও না। আসলে জেসির যে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির সমীকরণ, সেটা অনেকটাই ক্যানসারে আক্রান্ত ওয়াল্টার হোয়াইটের সঙ্গে মিলে যায়। জেসির চরিত্রটা নিয়ে আমি এখনো অনেক কৌতূহলী, সামনে একটা সিনেমাও আসছে ব্রেকিং ব্যাডের। যতটুকু জানি, সেটার প্রধান চরিত্র জেসি পিংকম্যান।
দুটি ভিন্ন বয়সী, ভিন্ন চিন্তার চরিত্রের মধ্যে একটা মানবিক সম্পর্কের যে ওঠা-নামা, এটা আসলে গল্প, অভিনয়, চিত্র গ্রহণের মাধ্যমে বের করে আনা বেশ কঠিন। সিরিজটার ক্যামেরার কাজ দুর্দান্ত। প্রচুর ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ শট, ওয়াইড শট থেকে শুরু করে মোন্টাজ শট সিরিজটিতে সিনেম্যাটিক ভিজ্যুয়ালের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, সব মিলিয়ে এটা ছোটপর্দায় বড় পর্দার বড় কাজ দেখার অভিজ্ঞতা। একটি দৃশ্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আবহ সংগীত কতটা বেশি শক্তিশালী হতে পারে, সেটার দৃষ্টান্তও ব্রেকিং ব্যাড দেখলে পাওয়া যাবে। প্রতিটা পর্ব অনেক বেশি পরিপূর্ণ। শুরু থেকে শেষ অবধি একটা আবেগ আছে। আবার প্রতিটা পর্বের সঙ্গে পরের পর্বের সংযুক্তিটাও ঠিকঠাক।
ভালো চিত্রনাট্য, চরিত্রের গঠন কিংবা অভিনয়—শিখতে হোক বা নিছক নিজের আনন্দের জন্য হলেও ব্রেকিং ব্যাডকে আমি আমার দৃষ্টিতে অনেক এগিয়ে রাখব, এটা সবাইকে দেখার জন্য বলব। সব মিলিয়ে এটাকে বলা যায় ছোট পর্দায় দেখা সিনেম্যাটিক অভিজ্ঞতা।