তিনি কিছুটা আলফা, বাকিটা আলমগীর কবির
>অভিনেতা আলমগীর কবিরকে দর্শক দেখেছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফের আলফা ছবিতে। এরপর দীপ্ত টিভির মিস্টার দয়াল নাটকেও বেশ পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। ভাবতে ভালোবাসেন এই শিল্পী। চিন্তার জগতে থাকলে তাঁকে খুঁজে পাওয়া ভার। তবে সম্প্রতি আলফা ছবির একটি বিশেষ প্রদর্শনীতে পাওয়া গেল তাঁকে, কথা হলো নানা বিষয় নিয়ে। লিখেছেন জিনাত শারমিন।
প্রায় চার বছর সময় লেগেছিল বাবাকে বলতে। সকালবেলা আইনজীবী বাবা আদালতে যাবেন বলে তৈরি হচ্ছিলেন। হঠাৎ শুনলেন, ‘বাবা, আমি আর পড়াশোনা করব না।’ তো কী করবে? ‘গিটার বাজাব।’ এটা শুনে একদৌড়ে ঘরে চলে গেলেন তাঁর বড় ভাবি। শাশুড়িকে জানাতে, যে তাঁর ছেলে পাগল হয়ে গেছে। যেদিন বাবাকে মনের কথাটা বলতে পেরেছিলেন, সেদিনই বদলে গিয়েছিল তাঁর জীবন।
হ্যাঁ, তাঁকে পাগল বললে ভুল বলা হবে না। তিনি গানের পাগল, তিনি সিনেমার পাগল। তিনি পাহাড় আর সমুদ্রের পাগল। তিনি ‘আলফা’ অথবা ‘মিস্টার দয়াল’। কিংবা তিনি শুধুই একজন আলমগীর কবির, যিনি নিজের শিক্ষার ভার অন্য কাউকে দেননি। তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। প্রচুর বই পড়তেন, সিনেমা দেখতেন, গান শুনতেন আর পাহাড় ডাকলে চলে যেতেন সব ফেলে। সমুদ্রের গর্জনও অগ্রাহ্য করতে পারতেন না।
আলমগীর কবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু দুই বছর খুব কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পর তাঁর মনে হয়েছিল, আর পারছেন না! আইন বিষয়ের চেয়ে গান তাঁকে টানছিল বেশি। তাই পড়াশোনা ছেড়ে দিনে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা করে গিটার বাজাতেন। দোতারা, বেহালা, বাঁশিও বাজাতেন। দীর্ঘদিন তালিম নিয়েছেন ধ্রুপদি সংগীতের ওপর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছেড়েও প্রচুর বই পড়তেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই ছিল বই পড়ার অভ্যাস। আর সেখান থেকেই তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছিল প্রশ্ন করার প্রবণতা।
তারপর একদিন চট্টগ্রামে তাঁরা কয়েকজন সংস্কৃতিকর্মী মিলে একটা সংগঠন করলেন—ফিল্মমেকার্স গিল্ড, চট্টগ্রাম। ২০১৪ সালে এই সংগঠন একসঙ্গে ১০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। তারই একটি লাইটম্যান। এটিই তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি। এর আগে এপিটাফ নামে একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন, অভিনয়ও করেছিলেন সেখানে। অভিনয় বলতে ওইটুকুই অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। এরপর হঠাৎ-ই এল নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত তৃতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আলফার নাম ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাব।
এপিটাফ–এর পরিচালক অঞ্জন সরকারই আলফার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন আলমগীর কবিরের কাছে। তিনি আলফার সহকারী পরিচালক। আলফার চিত্রনাট্য পড়ে অঞ্জনের চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল আলমগীর কবিরের চেহারা। আলমগীর কবির নাকি অনেকটাই আলফার মতো। এ অভিনেতা নিজেও স্বীকার করলেন যে বড় পর্দার আলফাকে তিনি খানিকটা হলেও ধারণ করেন। আর বাকিটা হতে হয়েছে। সেই হয়ে ওঠার পথটা সহজ ছিল না মোটেও। পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ নাকি তাঁকে ১৫ কেজি ওজন কমাতে বলেছিলেন, আর বলেছিলেন গায়ের রঙের ‘টোন’ কমাতে। আলমগীর কবির জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেন? আমি কি যথেষ্ট কালো নই?’
‘যথেষ্ট কালো’ হওয়ার জন্য তিনি গায়ে তেল মেখে তিন মাস রোদে থেকেছেন। মাটিতে ঘুমিয়েছেন। নাট্যজন শিমূল ইউসুফের নির্দেশনায় ‘হাড়ভাঙা’ ব্যায়াম করেছেন। সাব্বির আহমেদ খানের কাছে নাচ শিখেছেন। আর শুটিংয়ের সেটে পরিচালকের কাছ থেকে শিখেছেন ‘ডিসিপ্লিন’। নিজের চরিত্র নিয়ে আলমগীর কবিরের ভাষ্য, ‘আমরা সবাই সন্ধ্যায় ঘরে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু কোথাও ফিরছি না। এ অবস্থাটা ভাবায় আলফাকে, আমাকেও। আলফা জানে, নারী বা পুরুষ কেউ সম্পূর্ণ নয়। তাই সে ভাবে, যে নিজেই সম্পূর্ণ নয়, সে কী করে একটা শিল্পকে সম্পূর্ণ করবে?’
আলফা শেষ করে আলমগীর কবির হয়েছেন ‘মিস্টার দয়াল’। চলচ্চিত্রবোদ্ধা মহলের কাছে তিনি আলফা হিসেবে যতটা জনপ্রিয়, শিশুদের কাছে মিস্টার দয়াল তার চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। মজার বিষয় হচ্ছে, দীপ্ত টিভির এই নাটকের ২০ পর্বের শুটিং হওয়ার পর দেখা গেল, চিত্রনাট্যকার হারিয়ে গেছেন। সেখান থেকে ৬৫ পর্ব পর্যন্ত মিস্টার দয়ালই লিখেছেন বাকি কাহিনি। ইতিহাস ভালোই জানা ছিল। তার সঙ্গে কল্পনা আর রোমাঞ্চ মিলিয়ে দারুণ জমেছিল সেটিও।
বর্তমানে তিনি শুধুই আলমগীর কবির। কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন? এককথায় তাঁর উত্তর এল, ‘ভাবনা।’ অর্থাৎ তিনি ভেবে ভেবে ভাবার প্র্যাকটিস করছেন। যেমনটা বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। আবার যেদিন গান, চলচ্চিত্র, পাহাড় বা সমুদ্রের ডাক আসবে, সেদিন ভাবনার দরজায় আলগা করে কড়া লাগিয়ে ছুটে যাবেন। এই তাঁর জীবন। সবার বেছে দেওয়া জীবন ফেলে তিনি চলেন তাঁর বেছে নেওয়া জীবনের তালে।