হুমকিতে নেটফ্লিক্স?
গত শতাব্দীর আশির দশক ছিল ভিসিআর-ভিসিপির দখলে। মোটা মোটা একেকটি ক্যাসেটে পাওয়া যেত একটি করে ছবি। আমাদের দেশে তো ভিসিপি বা এর ক্যাসেট ভাড়া দেওয়া ছিল জমজমাট ব্যবসা। এরপর এল ভিসিডি। এর সুসময় অবশ্য বেশি দিন থাকেনি। দ্রুতই এর জায়গা নিয়ে নেয় ডিভিডি। ভিসিডির তুলনায় এতে ধরে কয়েক গুণ বেশি সিনেমা। তবে নেটফ্লিক্স এসে পাল্টে দিল সব।
ভিসিপি, ভিসিডি বা ডিভিডি—সব যুগেই টিকে ছিল সিনেমা হলকেন্দ্রিক নতুন ছবির ব্যবসা। টেলিভিশন চ্যানেল সম্পর্কিত ব্যবসাও চলছিল রমরমা। কিন্তু নেটফ্লিক্স এসে ভাগ বসিয়েছে দুই জায়গাতেই। নেটফ্লিক্স হলো অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং সেবা। উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই এর মাধ্যমে আপনি দেখতে পারবেন নিত্যনতুন সিনেমা, টিভি সিরিজসহ আরও কত কী! নেটফ্লিক্সের অনুষ্ঠানসূচিও বৈচিত্র্যে ভরপুর, অ্যাকশন-রোমান্টিক সবই পাবেন। ফলে একদিক থেকে যেমন মার খাচ্ছে চলচ্চিত্র শিল্প, অন্যদিকে কপাল পুড়ছে কেবল ব্যবসায়ীদেরও। তবে এতজনের ব্যবসায় ভাগ বসিয়ে কিছুদিন আয়েশে থাকলেও, হুমকিতে রয়েছে নেটফ্লিক্সও! কারণ ধীরে ধীরে ওয়ার্নার মিডিয়া, ডিজনি ও আমাজনের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান নাম লেখাচ্ছে অনলাইন স্ট্রিমিং সেবায়।
আসুন, আগে নেটফ্লিক্স সম্পর্কে কিছু জেনে নিই। ২০১১ সালে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসায়ে নামে নেটফ্লিক্স। এর গ্রাহকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেখতে পারেন নতুন নতুন ছবি বা টিভি সিরিজ। এ জন্য প্রতি মাসে মূল্য পরিশোধ করতে হয়। তবে এটি স্বীকার করতেই হবে, অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্ভার বিবেচনায় নিলে নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রিপশন ফি বেশ কমই। মজার বিষয় হলো, অনুষ্ঠান দেখার মাঝখানে অযথা বিজ্ঞাপন হজম করার কষ্ট কাউকে করতে হবে না!
নেটফ্লিক্স কীভাবে সিনেমা হল বা টেলিভিশন চ্যানেলের ব্যবসা কেড়ে নিচ্ছে? একটি হিসাব দিচ্ছি। ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ জানাচ্ছে, নেটফ্লিক্সের গ্রাহকেরা প্রতিবছর গড়ে ৮২টি করে নতুন ফিচার ফিল্ম দেখতে পান। আর হলিউডের ওয়ার্নার ব্রাদার্স একই সময়সীমায় মুক্তি দিতে পারে মোটে ২৩টি সিনেমা। সবচেয়ে ব্যবসাসফল স্টুডিও হিসেবে ডিজনি সিনেমা হল দেয় আরও কমসংখ্যক সিনেমা, মাত্র ১০টি। বর্তমানে ব্রাজিল, জার্মানি, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়াসহ প্রায় ২১টি দেশে অনুষ্ঠান নির্মাণের সঙ্গে জড়িত নেটফ্লিক্স।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই তিন মাসে বিশ্বব্যাপী ৭৪ লাখ নতুন গ্রাহক পেয়েছিল নেটফ্লিক্স। নতুন গ্রাহকেরা এই অনলাইন স্ট্রিমিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে দিচ্ছেন সাড়ে ১২ কোটি ডলার। বিখ্যাত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, ২০২২ সালের মধ্যে নেটফ্লিক্স অনুষ্ঠান বাবদ খরচ করতে পারে বছরে ২ হাজার ২৫০ কোটি ডলার।
তবে নেটফ্লিক্সের সুদিনের জোয়ারে দিন দিন ভাটার টান দেখা যাচ্ছে! কারণ এত দিন ধরে খালি মাঠে গোল দিয়ে আসছিল নেটফ্লিক্স, ছিল না কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। এবার মাঠে আসছে আমাজন, অ্যাপল, ফেসবুক, ইউটিউব, ওয়ার্নার মিডিয়া, ডিজনিসহ সব রথী-মহারথীরা। এরই মধ্যে নেটফ্লিক্সের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা করার মতো সক্ষমতায় পৌঁছে গেছে আমাজন। অন্তত যেসব জায়গায় নেটফ্লিক্স দেখা যায়, সেসব জায়গায় আমাজনও আবির্ভূত হয়েছে। গত বছরজুড়ে অনুষ্ঠান নির্মাণের পেছনে ৪০০ কোটি ডলারেরও বেশি খরচ করেছে জেফ বেজোসের প্রতিষ্ঠান। ‘গেম অব থ্রোনস’ ও ‘লর্ড অব দ্য রিংস’-এর মতো জনপ্রিয় সিরিজের স্বত্ব কেনার দিকে হাত বাড়িয়েছে আমাজন প্রাইম ভিডিও। বার্তা পরিষ্কার—এবার লড়াই হবে সেয়ানে সেয়ানে!
হুট করে প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা পেয়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গেছে নেটফ্লিক্স। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আগে যেসব সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান নেটফ্লিক্সের জন্য অনুষ্ঠান তৈরি করত, এবার তারাই প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে দেখা দিয়েছে। হলিউডের কিছু স্টুডিও গ্রুপ ইদানীং নেটফ্লিক্স থেকে সিরিজ বা সিনেমা সরিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। এরা যদি আরও আক্রমণাত্মক আচরণ করে, তবে তা সামলানো নেটফ্লিক্সের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
স্বাভাবিকভাবেই এই বাজার প্রতিযোগিতায় খুশি অনুষ্ঠান নির্মাতারা। কারণ আগে যেখানে ‘মহাজন’ একজনই ছিল, এখন সেখানে একাধিক। ফলে দর-কষাকষি করা যাচ্ছে। নেটফ্লিক্সের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আমাজন। কারণ এই প্রতিষ্ঠানের বাজারমূল্য নেটফ্লিক্সের তুলনায় ৬ গুণ বেশি! ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৯ সালেই বিশ্বব্যাপী স্ট্রিমিং সেবা নিয়ে হাজির হবে টেকজায়ান্ট অ্যাপল। তখন যে অনলাইন স্ট্রিমিং ব্যবসা আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০১৮ সালের শুরুটা ভালো হলেও, শেষের দিকটা নেটফ্লিক্সের কর্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। জানা গেছে, ২০১৮ সালজুড়ে কোম্পানিটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সেগুলোর বিপণন বাবদ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে, তা থেকে আয় হয়েছে বেজায় কম। ব্যবধান প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলার। গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে প্রকাশিত এক হিসাবে দেখা গেছে, নেটফ্লিক্সের নেট দেনা তখন ছিল প্রায় ৮৩৪ কোটি ডলার। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, বছরের শেষ নাগাদ নেটফ্লিক্সের শেয়ারের দামেও ধস নেমেছে। তিন মাস আগের চেয়ে প্রতিটি শেয়ারের দাম কমে গেছে প্রায় ২৯ শতাংশ।
এমন অবস্থায় একজন ‘ত্রাতা’র বড়ই প্রয়োজন ছিল নেটফ্লিক্সের। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক বিষয়গুলো দেখভালের জন্য স্পেনসার নিউমানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে ওয়াল্ট ডিজনির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিউমানকে আনা হয়েছে মূলত ক্ষতি সামাল দেওয়ার জন্য। ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে অর্থের সংস্থান চালু রাখা নেটফ্লিক্সের জন্য খুবই জরুরি। গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের ধরে রাখতে স্পেনসার নিউমানের মতো একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল নেটফ্লিক্সের। এরই মধ্যে আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মূলত ব্যয়বহুল ড্রামা সিরিজ দিয়েই জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছে এটি। কিন্তু ক্ষতি সামলাতে এবার তুলনামূলক সস্তা অনুষ্ঠানে মনোযোগ দিচ্ছে নেটফ্লিক্স।
লেখার শুরুতেই ভিসিপি, ভিসিডি বা ডিভিডি ক্যাসেট ভাড়া দেওয়ার ব্যবসার কথা বলেছিলাম। মজার বিষয় হলো, অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসায় নামার আগে নেটফ্লিক্স ছিল একটি ‘ডিভিডি রেন্টাল’ প্রতিষ্ঠান। তা সেই ২০০০ সালের কথা। অর্থাৎ সময় ও প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই তৈরি হয়েছে আজকের নেটফ্লিক্স, যা এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে। এবার ফের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিনোদন ব্যবসার ধরন পাল্টে দেওয়া নেটফ্লিক্স তাতে হেরে যাবে, নাকি নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাবে—সময়ের স্রোতেই লুকিয়ে আছে এর উত্তর।