চলচ্চিত্রে আসার আগে থেকেই আমজাদ ভাইকে আমি চিনতাম। তিনি আমাদের পাড়াতেই থাকতেন। তেজগাঁও থানার পাশেই পোস্ট অফিস রোডে। ছাত্রজীবনে আমার আড্ডা ছিল ফার্মগেটে। ওই সময় মাঝেমধ্যে দেখতাম, সুন্দর সুন্দর কাপড়চোপড় পরে তিনি এফডিসিতে যাচ্ছেন, আসছেন। তাঁর একজন ভক্ত হিসেবে শুধু দূর থেকে তাঁকে দেখতাম।
বাহাত্তর সালে আমি চলচ্চিত্রে আসি। আমজাদ হোসেনের খুব কাছের মানুষ ছিলেন পরিচালক আলমগীর কুমকুম, যিনি আমাকে চলচ্চিত্রে এনেছেন। তাঁর মাধ্যমেই এফডিসিতে একদিন আমজাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। এরপর থেকেই যেকোনো কাজেই তাঁর সঙ্গে দেখা হলে সালাম বিনিময় হতো, কথা হতো।
ওই সময় আমজাদ ভাই ফারুক ও ববিতাকে নিয়ে নয়নমনি এরপর গোলাপী এখন ট্রেনে ছবি দুটি করলেন, এরপর ববিতা ও ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে সুন্দরী বানালেন। আমিও তখন বেশ কিছু ছবিতে কাজ করে ফেলেছি। একদিন আমজাদ ভাইয়ের ছবিতে আমার ডাক এল। ছবির নাম কসাই। আমার বিপরীতে ববিতা। ১৯৮০ সালে কসাই মুক্তি পেল। এরপর আমজাদ ভাইয়ের আরও দুটি ছবিতে অভিনয় করি ভাত দে এবং সখিনার যুদ্ধ। দুটি ছবিতেই আমার বিপরীতে ছিলেন শাবানা। দুটি ছবিই ১৯৮৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর একই দিনে মুক্তি পায়। এই তিনটি ছবির বাইরে আমজাদ ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে আবদুস সামাদ খোকনের বড় বাড়ির মেয়ে ছবিতে কাজ করি। এই হলো আমজাদ হোসেনের সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ।
যেখানে একজন বিখ্যাত পরিচালকের একটি ছবিতে কাজ করা মানেই সারা জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করা। সেখানে আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে আমজাদ ভাইয়ের তিনটি ছবিতে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমজাদ ভাইয়ের ছবি নির্মাণের যে মুনশিয়ানা, সংলাপের যে মুনশিয়ানা, চিত্রায়ণের যে মুনশিয়ানা, এমনকি লেখা গানগুলো। তাঁর কাজের সঙ্গে আর কারও তুলনা চলে না। বলা যায়, আমজাদ ভাইয়ের তুলনা তিনি নিজেই। অসাধারণ একজন বহুমখী প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু আমরা খুব অভাগা যে আমজাদ হোসেনের শ্রেষ্ঠটুকু আমরা ঠিকমতো তুলে আনতে পারিনি।
তাঁর কাজ করার ধরনটাই ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি কখন ছবির শুটিং শুরু করবেন, কখন শেষ করবেন—এই প্রশ্ন কখনোই তাঁকে করা যায়নি। মনে পড়ে ভাত দে ছবির শুটিংয়ের কথা। মাঘ মাসে শীতের মধ্যে শুটিং। বেউতা ঘাটে নদীর পাড়। ভোর ৪টার সময় উঠে, মেকআপ নিয়ে আমি আর শাবানা ওই ছবির একটি গানের শুটিং করেছি। গানটি ছিল আমজাদ ভাইয়েরই লেখা, সৈয়দ আব্দুল হাদী ও সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ‘চিনেছি তোমারে আকারে প্রকারে, দিনের আলো রাতেরও আঁধারে’। ছবিটি মুক্তি পেল, প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখলাম। সেই ভোরের দৃশ্য, সূর্য উঠছে, শীতের দিনে কুয়াশার তিনটি লেয়ার পড়ে। সেই তিনটি লেয়ারের মধ্যে আমাকে আর শাবানাকে দেখা যাচ্ছে। বাকিটি কুয়াশা। কী অসাধারণ! এটা আমজাদ হোসেন বলেই সম্ভব।
আমজাদ ভাইয়ের সঙ্গে বেশি আড্ডা হতো পরিচালক সমিতির অফিসে। যখনই আড্ডা দিতাম, তখন কোনো সময় বাঁধা থাকত না। কীভাবে তিনি সংলাপ লিখেন, গল্পের কাঠামো তৈরি করেন—এগুলো তাঁর কাছে জানতে চাইতাম। তিনি কথা বলতে বলতে তখন আমাদের কাছে শিক্ষক হয়ে যেতেন। সত্যিকার অর্থে তাঁর উপস্থিতিটাই আমাদের জন্য একটা ক্লাসের মতো হয়ে যেত ওই সময়টা।
তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা এফডিসিতে, তিনি অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন আগে। সম্ভবত সেদিন এটিএন বাংলার একটা কাজ করে এফডিসিতে এসেছেন। দেখা হতেই আমি মজা করে বললাম, কী ভাই, আপনি নাকি এটিএন থেকে আসার সময় আপনার ড্রাইভারকেই চিনতে পারেন নাই। তিনি বললেন, আর বোলো না, আমি তো আমার গাড়িটাই চিনতে পারছিলাম না। আমি বললাম, এখন আপনি আমাদের ক্লাসের অনেক ওপরে চলে যাচ্ছেন। আপনাকে আমরা আর খুঁজে পাব না।
তাঁকে বাঁচানোর জন্য তাঁর ছেলেমেয়েরা অনেক চেষ্টা করেছে। আর আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমজাদ ভাইয়ের জন্য যা করেছেন, তাতে তাঁকে ধন্যবাদ দিলে ছোট করা হবে। তিনি শুধু আমজাদ ভাইয়ের জন্য নয়, চলচ্চিত্রের মানুষদের জন্য তিনি যা করছেন, তা অকল্পনীয়। তিনি বলেন, ‘আমার চোখে সবাই শিল্পী। আমার দেশের শিল্পী।’ কে কোন মতাদর্শের, তা তিনি দেখেননি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্রশিল্পের সবাইকে প্রধানমন্ত্রী চিরদিনের জন্য ঋণী করে দিলেন।
মানুষ চলে যাওয়ার পর আমরা বুঝি তাঁর অনুপস্থিতি। আমজাদ হোসেন নেই। আমরা বুঝতে শুরু করেছি আমরা কী হারালাম, কাকে হারালাম।
আলমগীর: অভিনেতা