ফুটবলে যেমন ফিফা, ক্রিকেটে আইসিসি, কর্মকৌশলে ফারাক থাকলেও থিয়েটারেরও তেমন সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট বা আইটিআই। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে, ইউনেসকোর উদ্যোগে। উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাট্যকর্মীদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়। ৭০ বছর পূর্ণ করল থিয়েটারের এই বিশ্ব সংগঠন আইটিআই। ইউনেসকোই পৃষ্ঠপোষক। সক্রিয় এই সংগঠন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশ্ব কংগ্রেস, থিয়েটার অব নেশনস, কর্মশালা, সেমিনার, ভ্রাম্যমাণ নাট্য প্রযোজনা এবং নাটক ও নৃত্য বিষয়ে নানা আয়োজন করে চলেছে। এই আন্তর্জাতিক সংস্থার ৭০ বছর উদ্যাপনে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কেন্দ্র গতকাল আয়োজন করেছে তিন দিনের উৎসব।
নাটকের বিভিন্ন শাখার মানুষেরা যেমন নাট্যকার, নির্দেশক, নাট্যপ্রশাসক, ডিজাইনার, অভিনয়শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, থিয়েটার-নৃতত্ত্ববিদ, প্রবন্ধকার, তাত্ত্বিক, সমালোচক—সবাই আইটিআইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেন। তাই গতকালের অনুষ্ঠানটিও শুধু নাটকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নাচে, গানে জমজমাট ছিল আয়োজন। ছিল সমকালীন নাটকের কোলাজ। দর্শকের সারিতে ছিল থিয়েটার, নৃত্যাঙ্গন, সংগীতশিল্পীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি।
অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশ্ব আইটিআইয়ের সাম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার, নাট্যজন আতাউর রহমান, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল কামাল বায়েজিদ। আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক দেবপ্রসাদ দেবনাথ। সঞ্চালনা করেন লাকী ইনাম।
আসাদুজ্জামান নূর স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নাট্যচর্চার সামগ্রিক জ্ঞান থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন। তিনি মনে করেন, আইটিআই এমন সব উৎসব, কর্মশালার আয়োজন করবে, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের নাটকের সঙ্গে মেলবন্ধন সৃষ্টি করবে।
জাতীয় নাট্যশালার লবিতে চলছে বিশেষ প্রদর্শনী ‘ফিরে দেখা (১৯৮১-২০১৮) ’। বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভসের সংগৃহীত বিভিন্ন আলোকচিত্র ও নানা স্মারক প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে আইটিআইয়ের দীর্ঘ পথচলা। প্রদর্শনীটি উপস্থাপন করেন বাবুল বিশ্বাস।
উদ্বোধনী আলোচনা পর্ব শেষে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা নৃত্য পরিবেশন করেন। পল্লবী ড্যান্স সেন্টারের নৃত্যশিল্পীরা পরিবেশন করেন ‘শান্তি’ শিরোনামের নৃত্য প্রযোজনা। শেষে সাতটি নাট্যদল তাদের বিভিন্ন দর্শকপ্রিয় লোকজ নাটকের অংশবিশেষ নিয়ে পরিবেশন করে থিয়েটার কোলাজ। দেশের স্থানীয় নাট্যশৈলী কীভাবে হাল আমলে বেঁচেবর্তে বা রয়েসয়ে আছে, তার সংক্ষিপ্ত চিত্র পাওয়া গেল এ পর্বে।
আইটিআইয়ের বিশ্ব সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন রামেন্দু মজুমদার। তিনি জানান, ১৯৪৮ সালে প্রাগে অনুষ্ঠিত আইটিআইয়ের প্রথম বিশ্ব কংগ্রেসে মাত্র ১২ দেশ অংশ নিয়েছিল। ধীরে ধীরে এ ব্যাপ্তি বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় ১০০টি দেশে এর জাতীয় কেন্দ্র রয়েছে। প্যারিসের ইউনেসকো ভবনেই এর প্রধান কার্যালয় ছিল দীর্ঘদিন। ২০১৫ সালে প্যারিস থেকে আইটিআইয়ের সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয় চীনের সাংহাইতে। বিভিন্ন দেশে যে জাতীয় কেন্দ্রগুলো রয়েছে, সেগুলো তাদের নিজস্ব নিয়মে চলে।
বাংলাদেশ ১৯৮২ সালে আইটিআইয়ের সহযোগী সদস্যপদ এবং ১৯৮৯ সালে পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে। বাংলাদেশ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক রামেন্দু মজুমদার। আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্র প্রতি দুই বছর পর আন্তর্জাতিক সেমিনারসহ নাট্যোৎসবের আয়োজন করে। এ কেন্দ্র বাংলাদেশের নাট্যচর্চার স্বরূপকে বিদেশে পরিচিত করছে।
আজ শুক্রবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন বেলা সাড়ে তিনটায় শুরু হবে উৎসব। জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে ‘অন্তরঙ্গ কথন: আমার নাট্যপথ’ শীর্ষক পর্বে আমন্ত্রিত বক্তা থাকবেন ভারতের প্রখ্যাত নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা বিভাস চক্রবর্তী। সন্ধ্যা সাতটায় গাইবান্ধার চিন্তক থিয়েটার পরিবেশন করবে লোকনাট্য বেহুলা ভাসান। কাল শনিবার সাতটায় মানিকগঞ্জের ফকির আজিজ সরকার ও তাঁর দলের গাজীর গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হবে আইটিআইয়ের ৭০ বছর পূর্তি উৎসব।