জোড়াতালি কাহিনির জমজমাট ছবি

নবাব ছবিতে শাকিব খান
নবাব ছবিতে শাকিব খান

নবাব একটি ক্রাইম থ্রিলার, কলকাতা শহরের প্রেক্ষাপটে। চলচ্চিত্রটি যৌথ প্রযোজনার। বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার রাজীব চৌধুরী নবাব শিলিগুড়ি সীমান্ত দিয়ে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি অসুস্থ মাকে দেখতে আসার সময় সন্ত্রাসীদের হামলার মুখ থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে বাঁচায়। কলকাতার পুলিশ খুশি হয়ে তাকে সন্ত্রাসবাদ দমন ও অস্ত্র চোরাচালান বন্ধের দায়িত্ব দেয়। রাজীব অবশ্য সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র, পড়াশোনার সূত্রে এক দশকেরও বেশি কলকাতায় থেকেছে। সে সময়ই তার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে দিয়া নামের একটি মেয়ে। দিয়ার প্রেমের আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দেবে, এ রকম পরিস্থিতিতে বাবার মৃত্যুর খবর এলে সে বাংলাদেশে চলে যায়। ফলে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ। তবে এই দফায় রাজীব কলকাতায় এসে নতুন দায়িত্ব পেলে দিয়া রাজীবের দেখা পায়। দিয়া এখন টেলিভিশনের ক্রাইম রিপোর্টার, সেই সূত্রেই সে রাজীবকে খুঁজে পায়। রাজীবের সঙ্গে এবার তার সত্যিকারের প্রেম শুরু হয়। রাজীব অন্যান্য পুলিশ অফিসারের সহায়তা নিয়ে ছোট থেকে ক্রমশ বড় অপরাধীদের শনাক্ত করতে থাকে, দিয়াও তাকে সাহায্য করতে থাকে। একপর্যায়ে দেখা যায় উপমুখ্যমন্ত্রী অস্ত্র চোরাচালানের প্রধান অপরাধী আর মুখ্যমন্ত্রীর স্বামী মুখ্যমন্ত্রীকে হত্যা করে মসনদে বসতে চায়। তারা রাজীবের মাকে হাসপাতাল থেকে কিডন্যাপ করে এবং বঙ্গ সম্মেলনে বক্তৃতারত অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীকে হত্যা করার জন্য রাজীবকেই চাপ দেয়, নইলে রাজীবের মাকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয়। রাজীব ও দিয়া তাদের সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে রক্ষা করে এবং অপরাধীদের জনসমক্ষে ধরিয়ে দেয়।

শুভশ্রী গাঙ্গুলী ও শাকিব খান
শুভশ্রী গাঙ্গুলী ও শাকিব খান

ক্রাইম থ্রিলার যেমন হয়, ছবির পরতে পরতে অ্যাকশন ও উত্তেজনা। প্রেম আছে, জমজমাট নাচ-গান আছে। সিনেমাটোগ্রাফি ভালো, ছবির প্রিন্ট ঝকঝকে, কালার কারেকশনে মানোত্তীর্ণ। থ্রিলিং নেপথ্য সংগীত উত্তেজনার আবহ তৈরি করে রাখে। মোটামুটিভাবে গল্পটা বলতে পেরেছেন পরিচালক। দর্শককে চুম্বকের মতো আটকে রাখতে সক্ষম নবাব। মুশকিল হলো কাহিনিটি খুব একটা মৌলিক নয়। বলিউড চলচ্চিত্র বাদশাহ, সারফারোশ, বাজি—এ রকম কিছু চলচ্চিত্রের জোড়াতালি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশ আর যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র হিসেবে নায়ককে বাংলাদেশি দেখিয়ে গল্প সাজানোটুকুতে চিত্রনাট্যকারের অবদান আছে। ফলে যাঁরা ওই ছবিগুলো দেখেননি, তাঁরা আনন্দ পাবেন, তাঁদের জন্য প্রতারিত বোধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে আনন্দ পাবেন না তাঁরা, যাঁরা গল্পের কার্যকারণ খুঁজতে যাবেন। বাংলাদেশের গোয়েন্দা অফিসার অসুস্থ মাকে কলকাতায় দেখাশোনার পাশাপাশি কলকাতা পুলিশের হয়ে কাজ করতে পারে কি? এ ক্ষেত্রে অন্তত উভয় দেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটা সম্মতি দেখানোর দরকার ছিল। রাজীব যখন মুখ্যমন্ত্রীকে রক্ষা করতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তখন এক পিস্তল দিয়েই বেশ কয়েকজন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রধারীকে কুপোকাত করে দেয়। অন্যদিকে রাজীব যদি দিয়ার প্রস্তাবে সম্মতি দিতে প্রস্তুতই ছিল, তবে দেশে গিয়েও কেন দিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি? বা কলকাতায় আসার পরে দিয়াকে কেন খোঁজেনি? দিয়াই বা কীভাবে আগন্তুক হয়ে এত সহজে ডান্স ফ্লোরে ড্রেস পাল্টে আইটেম গান গেয়ে দিল বা হোটেলে গিয়ে ওয়েটার সেজে মুখ্যমন্ত্রীর রুম পর্যন্ত পৌঁছে গেল। অন্তর্ধানের পরও দিয়া রাজীবের জন্মদিন ভোলেনি কিন্তু আসল নাম ভুলে যায় কীভাবে (নবাব নামেই সে রাজীবকে ডাকে)? আর ‘ষোলো আনা’ গানের সময় এত সহনৃত্যশিল্পী কোত্থেকে উদয় হলো, তাই-বা কে বলবে? প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার উপায় নেই, তবে সেই গানের সেট ডিজাইন ও কোরিওগ্রাফি চমত্কার হয়েছে তা বলতেই হবে।

নবাব
পরিচালক: আব্দুল আজিজ ও জয়দেব মুখার্জি
অভিনয়: শাকিব খান, শুভশ্রী গাঙ্গুলী, রজতাভ দত্ত, অমিত হাসান ও অপরাজিতা আঢ্য
প্রযোজনা: জাজ মাল্টিমিডিয়া (বাংলাদেশ) ও এসকে মুভিজ (ভারত)

যা হোক, এ রকম বলিউড-প্রভাবিত মাসালা মুভিতে অবাস্তব নানান ঘটনা থাকে, দর্শককে বিনোদন দিতে গিয়ে যুক্তি ও কার্যকারণ সূত্রকে বলি দেওয়া হয়ে থাকে। এসব চলচ্চিত্রের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো দর্শকের জন্য ‘মেক-বিলিভ’-এর অনুভূতি দেওয়া। আরও কেতাবি ভাষায় বলা যায়, ‘ভেরিসিমিলিটিউড’ উপহার দেওয়া বা অবাস্তবকে বাস্তবের মতো করে হাজির করা। সেই অর্থে ধার করা কাহিনি বা অবাস্তব কাহিনি হলেও নির্মাণশৈলী দিয়ে বাস্তব ঘটনা দেখার অনুভূতি দর্শকের মধ্যে তৈরি হয়। অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়শৈলীও এ ক্ষেত্রে অনেকখানি সাহায্য করেছে। রাজীবের চরিত্রে শাকিব খান খুব মানানসই। অ্যাকশন ও রোমান্টিক হিরো হিসেবে তিনি দুই বাংলাতেই অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছেন। উপমুখ্যমন্ত্রীর চরিত্রে খরাজ মুখার্জির অভিনয় সবার চোখে পড়বে। দিয়ার চরিত্রে শুভশ্রী মানানসই। বলা যায়, অন্যান্য ছোট-মাঝারি চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন, সবাই ভালো করেছেন। বিশেষত সব্যসাচী চক্রবর্তী, অপরাজিতা আঢ্য প্রমুখের কথা বলতে হয়।

নবাব চলচ্চিত্রের পরিচালক জয়দীপ মুখার্জি। তিনি গত বছরও শাকিব খানকে নিয়ে শিকারী নামে উভয় বাংলার জন্য যৌথ প্রযোজনার হিট চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। যৌথ প্রযোজনার অন্যান্য চলচ্চিত্রের মতো এই চলচ্চিত্রেও বাংলাদেশের জন্য তৈরি বিপণন উপকরণ বা পোস্টারে সহপরিচালক হিসেবে আব্দুল আজিজের নাম দেখা গেছে আর পশ্চিমবঙ্গে তাঁর নাম বাদ পড়েছে। এ ধরনের বিপণন বার্তা বিভ্রান্তি ছড়ায়। এর অবসান হওয়া দরকার।

লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক ও গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক।