পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অনিশ্চয়তা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপাচার্য ফারজানা ইসলামের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। গতকাল বুধবার দিনভর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল, সংহতি সমাবেশ এবং অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন তাঁরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের সব ভর্তি কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া দেশের আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অস্থিরতা। এর মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) এক মাস ধরে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ফিরবেন, তাও অনিশ্চিত। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা ১০ দিন ধরে উপাচার্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছেন।
দুই হলের শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। অন্যদিকে প্রথম বর্ষে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের হলে অবস্থান, সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি না করা এবং বিতর্কিত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত না রাখার দাবিতে আন্দোলন করছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও লিখিত অভিযোগ এলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তেমনি অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জাবিতে বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করেই আন্দোলন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য ফারজানা ইসলাম গতকাল সারা দিন তাঁর বাসভবনে অবস্থান করেছেন। সরেজমিনে তাঁর বাসভবনের ফটকে শতাধিক পুলিশের পাহারা দেখা যায়। গত মঙ্গলবার ছাত্রলীগের সহায়তায় বাসভবন থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। এরপর সন্ধ্যা থেকে বাসভবনে অবস্থান নেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও সুশৃঙ্খল পরিবেশের স্বার্থে সবাই যেন সহনশীল হন। কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেন। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে উপমন্ত্রী এ কথা বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে উপাচার্যের ‘মধ্যস্থতায়’ ছাত্রলীগকে বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগের তদন্তের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গত ২৩ আগস্ট শুরু হওয়া এ আন্দোলন ২ অক্টোবর মোড় নেয় উপাচার্যকে অপসারণের দাবিতে। ১০ দিন উপাচার্যের কার্যালয় অবরুদ্ধ রাখার পর গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। পরদিন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তাঁদের পিটিয়ে সরিয়ে দেন।
এর প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাতে হল থেকে বেরিয়ে আসেন শিক্ষার্থীরা। রাত দেড়টা পর্যন্ত উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি প্রশাসনিক ভবন ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বের করে দেওয়ার মাধ্যমে আবারও আন্দোলন শুরু করেন। সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে পুরোনো প্রশাসনিক ভবনের সামনের ‘উপাচার্য অপসারণ মঞ্চে’ গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে অংশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন মোজাম্মেল হক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন।
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সন্ত্রাসী দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পেটানোয় উপাচার্যের নৈতিকতার পূর্ণ অবক্ষয় হয়েছে। সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণার পর আবাসিক হলগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। কিছু শিক্ষার্থী অবস্থান করছিলেন। গতকাল প্রাধ্যক্ষ কমিটি সভা করে কমিটির সভাপতি অধ্যাপক বশির আহমেদ জানান, বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যে হল না ছাড়লে তল্লাশি চালানো হবে। এ-সংক্রান্ত লিখিত আদেশ আবাসিক হলগুলোর নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পরে পাঁচটা নাগাদ হলগুলো শিক্ষার্থীশূন্য হয়ে পড়ে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নজির আমিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা হল ছাড়ার নির্দেশ মানছি না। রাতে হলেই থাকব।’ রাত নয়টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করছিলেন আন্দোলনকারীরা।
অচল বুয়েট সচল কবে
গত ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। গতকাল এই ঘটনার এক মাস পূর্ণ হয়েছে। এই ঘটনার পর বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফেরেননি। এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র এবং বুয়েটের করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের পর শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে তাঁদের অবস্থান জানাবেন।
আবরার হত্যা মামলার তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, খুব দ্রুত অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। সেটি বৃহস্পতিবারও (আজ) হতে পারে।
বুয়েটের তদন্ত কমিটির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, কমিটি অতিরিক্ত ১০ কার্যদিবস সময়ও নিয়েছে।
আবরার হত্যার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১১ অক্টোবর বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন বুয়েটের উপাচার্য সাইফুল ইসলাম। পরে সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে ১৬ অক্টোবর গণশপথের মধ্য দিয়ে মাঠের আন্দোলনে ইতি টানেন শিক্ষার্থীরা।
তবে মামলার অভিযোগপত্রে যাদের নাম আসবে তাদের স্থায়ী বহিষ্কার না করা পর্যন্ত একাডেমিক অসহযোগের ঘোষণা দেন তাঁরা। আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বে থাকা বুয়েট ছাত্র মাহমুদুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মামলার অভিযোগপত্র এবং বুয়েটের করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবেন তাঁরা।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
উপাচার্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল শিক্ষার্থীরা দিনভর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। উপাচার্যের উদ্দেশে লাল কার্ড প্রদর্শন করেন শিক্ষার্থীরা।
১৫ নভেম্বর পাবিপ্রবির প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ১৪ নভেম্বরের মধ্যে দাবি না মানা হলে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, নির্ধারিত দিনেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
গত ২৪ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উত্তীর্ণ হতে না পেরে এক প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে উপাচার্যের পথ আটকে ৮ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তোলেন এবং টাকা ফেরত চান। ওই দিন রাতে এ-সংক্রান্ত একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় আন্দোলন। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রীতম কুমার দাস আশা করছেন, আলোচনার মাধ্যমে খুব শিগগির সমস্যার সমাধান হবে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ও মহাসড়ক অবরোধ করেন। প্রথম বর্ষে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের হলে অবস্থান, সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি না করা এবং বিতর্কিত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত না রাখার দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা।
বেলা একটা থেকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা রংপুর-কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট মহাসড়কের পার্ক মোড়ে সমবেত হয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন শুরু করেন। পরে বিকেল সাড়ে চারটায় উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ শিক্ষার্থীদের অবরোধস্থলে উপস্থিত হয়ে তিন দফা দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন।
বন্ধ কুয়েট
অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার রাতে দুই হলের শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনার পর এ পদক্ষেপ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. নূরুন্নবী মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, খেলা ছিল দুটি হলের মধ্যে। অথচ সংঘর্ষের ঘটনায় তিনটি হলের শিক্ষার্থীরা জড়িত। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে কিছুটা সময় লাগবে।
সার্বিক বিষয়ে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনকার সমস্যা মূলত উপাচার্যকেন্দ্রিক, শিক্ষক রাজনীতিকেন্দ্রিক অথবা ছাত্রলীগকেন্দ্রিক। এ জন্য উপাচার্য নিয়োগে সতর্ক হতে হবে। নির্মোহ অধ্যাপককে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় উপাচার্য পদে নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষকদের দলভিত্তিক রাজনীতির পরিবর্তে আদর্শ ও বিবেকভিত্তিক রাজনীতি করতে হবে। এ ছাড়া নোংরা ছাত্ররাজনীতিকে দূরে রেখে সুস্থধারার ছাত্ররাজনীতির চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রতিনিধি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদকেরা]