উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে, একই সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট। যে পরীক্ষার্থী এবার প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ পেয়েছেন, তিনি বেছে নেবেন কোনটি? সহজ করে ভাবলে খেলাধুলা বাদ দিয়ে পরীক্ষাটাই বেছে নেওয়ার কথা। কিন্তু ‘কঠিনেরে ভালোবেসে’ একসঙ্গে দুটিই চালিয়ে গেছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপির) চার তরুণ ক্রিকেটার—পারভেজ হোসেন, মুকিদুল ইসলাম, মুজিবুল হোসেন ও নওশাদ ইকবাল। তাঁরা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন, আবার প্রিমিয়ার লিগের মতো দেশের ঘরোয়া আসরের সর্বোচ্চ পর্যায়েও খেেলছেন নিয়মিত। আজ যাঁদের দেখা যাচ্ছে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে পরীক্ষার হলে, কালই তাঁরা ব্যাট-বল নিয়ে ছুটছেন ফতুল্লা স্টেডিয়ামে।
খেলায় যাঁরা বল-রান-ওভারের হিসাব করছেন, ফেরার পথে বাসে উঠে তাঁদের পরদিনের পরীক্ষার হিসাব কষতে হচ্ছে। কিংবা উল্টো করে বললে, পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে বাতাসে হাত ঘুরিয়েই তাঁরা হয়তো ঠিকঠাক জায়গায় বল ফেলার কিংবা স্কয়ার লেগের শটটা ঠিকভাবে খেলার ‘শ্যাডো প্র্যাকটিস’ করে নিচ্ছেন।
ব্যাকরণ, আইসিটি আর ব্যাটিংয়ের পরীক্ষা
ওপেনিং ব্যাটসম্যান ও উইকেট রক্ষক পারভেজের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে ‘এ’ গ্রেড পাওয়া পারভেজ দলের ব্যাটিংয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ। প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ারে ১০ ম্যাচ খেলে রান করেছেন ১৯৮। আহামরি কিছু নয়। তবে ইংরেজি ব্যাকরণ ও আইসিটির মারপ্যাঁচ সামলে ২২ গজে গিয়ে দেশসেরা বোলারদের সামনে এই তরুণের ব্যাট হাতে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা একবার ভাবুন। ১৭ বছরের ছেলেটি লফটেড ড্রাইভ ভালো করলেও পড়াশোনায় কাঁচা ইংরেজি ও আইসিটিতে। কিন্তু খেলার চাপে দুটি বিষয়ের প্রতি বাড়তি যত্ন নেওয়ার সময় আর হলো কই!
তবু তিনি হাল ছাড়ছেন না। পারভেজ হোসেন বলেন, ‘পরীক্ষার আগে এসে আর ভাবার সুযোগ নেই পরীক্ষা কেমন হবে। একটাই লক্ষ্য—মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করতে হবে। দুই বেলা প্র্যাকটিসের পরে শরীর আর চলে না। কিন্তু ভালো কিছু করতে হলে কষ্ট করতেই হবে। খেলাটাও যেমন আমার জীবনের অংশ, পড়াশোনা না থাকলেও চলবে না।’ এই তাড়নাতেই ইংরেজি প্রথম পর্ব পরীক্ষার জন্য লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের বিপক্ষে তিনি মাঠে নামেননি।
মাঠে নামলে সব ভুলে যাই
বাঁহাতি স্পিনার নওশাদ ইকবালের গল্পটাও অভিন্ন নয়। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল আইসিটি পরীক্ষার আগের দিন। পাস মার্ক তুলতে হবে। কিন্তু প্রাণপ্রিয় বিকেএসপি দলটা পাস মার্ক পাবে তো? পারবে তো প্রিমিয়ার লিগে টিকে থাকতে? এই ভাবনা ভোগাচ্ছিল তাঁকে। (যদিও গত বৃহস্পতিবার উত্তরার বিপক্ষে হেরে প্রিমিয়ার লিগে অবনমিত হয়ে গেছে বিকেএসপির দল।) ছোট মাথায় আর কতটুকুই বা চাপ নেওয়া যায়! তবু দুটি বিষয়েই সাফল্যের আশায় নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।
মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সন্তানের জন্য মা-বাবারা কত কী করেন, তা তো সবারই জানা। পরীক্ষা চলাকালীন ছেলে বা মেয়ের মাথার কাছে দুধ, ডিম বা ফলের জুস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অনেক অভিভাবক। পারভেজ, নওশাদদের হোস্টেল–জীবন। মাঠের হাসান স্যার বা কলেজের গণিতের মাস্টারখ্যাত ইকরাম স্যাররাই তাঁদের মা-বাবা। শিক্ষকদের কাছেও এই ছেলেরা সন্তানতুল্য। জীবনের এই কঠিন সময়গুলোতে ছাত্রদের মাথায় হাত রেখে স্মরণ করিয়ে দেন, ‘হার মানলে চলবে না বাবা।’
নওশাদরা বিকেএসপির জার্সি গায়ে চাপিয়ে হুংকার দিয়ে মাঠে নামেন। বাঁহাতি অফ স্পিনে ঘোল খেয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নের পথ ধরলেই সার্থক হয় কষ্ট। মাঠ থেকে উঠে আবার শুরু হয় পরীক্ষার চিন্তা। ৭ ম্যাচে ৯ উইকেট পাওয়া নওশাদ ভালো করেই জানেন কীভাবে পাড়ি দিতে হবে কঠিন সময়টা, ‘যখন মাঠে যাই, পৃথিবীর সব ভুলে যাই। আমাকে ভালো খেলতে হবে, দলকে জেতাতে হবে—সব সময় এই চিন্তা। খেলা শেষ করে কোনো রকম ফ্রেশ হয়েই পরীক্ষার চিন্তা করি। কষ্ট আছে। আবার সাফল্য পেলে অন্যদের চেয়ে আমাদের আনন্দটাও বেশি।’
বিশ্বকাপ বা বিশ্ববিদ্যালয়
মুজিবুলের গল্পটা একটু আলাদা। খেলা ও পড়া একসঙ্গে চালিয়ে গেলেও বাস্তববাদী এই তরুণ একাডেমিক শিক্ষাকে একধাপ এগিয়ে রাখেন। মাঠের বাইরে থাকলে সারাক্ষণ তাঁর মাথায় ঘোরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন। শুধু তা–ই নয়, ভালো বিষয়ও পাওয়া চাই। দলের এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান বলছিলেন, ‘খেললেও মাথায় রাখি ভালো রেজাল্ট করতে হবে। ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারব না। এরপরে ভালো সাবজেক্ট পাওয়ার বিষয় তো আছেই। খেলা সারা জীবন থাকবে না। খেলা ছাড়ার পর ভবিষ্যতে একাডেমিক রেজাল্টটাই কাজে আসবে। তাই খেলছিও যেমন, পড়ার চেষ্টা করছি আরও বেশি।’ একদিন এই তরুণই হয়তো বিশ্বকাপে খেলবেন। তবে এখন বিশ্বকাপ আর বিশ্ববিদ্যালয়—ঘুরেফিরে দুটিই আসে তাঁদের স্বপ্নে।
মুগ্ধয় মুগ্ধতা
সবশেষে বলি মুকিদুল ইসলামের কথা। তাঁর ডাকনাম মুগ্ধ বলেই হয়তো কথা শুনে মুগ্ধ হতে হলো। ৬ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার এই বোলারকে চোখে পড়বে দূর থেকে। ৬ ম্যাচে ৫১.২ ওভার বল করে তিনি নিয়েছেন ৮ উইকেট। পরিসংখ্যান খুব আহামরি নয়। কিন্তু রংপুরের ছেলেটি নজর কেড়েছেন বলের গতি দিয়ে। বন্ধুমহলে অনেক জোরে একটানা বল করতে পারার খ্যাতি আছে। ২০১৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বিপক্ষে তিনি খেলেছিলেন দুটি ম্যাচ। পাকিস্তানের বিপক্ষে খুব একটা সুবিধা না করতে পারলেও আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটায় দারুণ বোলিংয়ে পেয়েছিলেন তিন উইকেট।
তাই বলে পড়াশোনায় তিনি কম যান না। এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে ‘এ’ পাওয়া মুগ্ধের কাছে হিসাবটা খুবই সহজ, ‘পরীক্ষার আগের দিনটা শুধু প্র্যাকটিস করি না। আবার পরীক্ষা শেষ করে এসে বেশি করে প্র্যাকটিস করার চেষ্টা করি। কষ্ট হলেও আমি দুটিই উপভোগ করছি। কষ্টের ফল সব সময় ভালো হয়।’
এই কষ্টের ফলই কিন্তু এখন পাচ্ছেন তাঁদের পূর্বসূরি সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমরা। তাঁরাও একসময় একই সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন, আবার প্রিমিয়ার লিগও খেলেছেন। তাঁদের দেখানো পথ ধরেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভাবনা মাথায় রেখে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মুগ্ধরা। লড়াই জেতার চেয়ে আনন্দের আর কি আছে!