আলো ছড়ানো ল্যাম্প
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের এক হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সঙ্গে বসেছিলেন জাপানি প্রতিষ্ঠান ই-এডুকেশনের কর্মকর্তারা। হোলি আর্টিজান হামলা, রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবন...আরও নানা প্রসঙ্গে আলাপ করতে করতে মনে হলো, আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা টেলিভিশনে তরুণেরা যা দেখেন, তা-ই কোনো রকম অনুসন্ধান ছাড়াই সত্য বলে মেনে নেন। শুধু বাংলাদেশ বা মিয়ানমার নয়, সারা বিশ্বেই এই সমস্যা ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে।
এই বাধা দূর করতেই কাজ করছে ই-এডুকেশন ও টয়োটা ফাউন্ডেশন। তাদের উদ্যোগের নাম—ল্যাম্প (লার্ন, অ্যাক্ট, মেক প্রোগ্রাম)। প্রধান উদ্দেশ্য হলো—বাস্তবমুখী এবং হাতেকলমে শিক্ষার মাধ্যমে এ সময়ের ছেলেমেয়েদের জীবন গড়তে সহযোগিতা করা। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে বিভিন্ন বাছাইপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং জাপান থেকে ১৫ জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীকে বাছাই করা হয়। তাঁদের নিয়ে শুরু হয় ল্যাম্পের জাপান কর্মসূচি। এই কর্মসূচির আওতায় জাপানে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ থেকে আমরা ৬ জন—মো. আরিফ উল্লাহ খান, ফরিদ উদ্দিন, ইকরাম হোসেন, নাফিজ ইমতিয়াজ, সিমরান তাবাসসুম আলি ও আমি। গত ৯ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আমরা শিখেছি, কীভাবে নতুন পরিস্থিতি ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়।
লার্ন (শেখা), অ্যাক্ট (কাজ করা) ও মেক (তৈরি)—প্রতিটি বিষয়ের ওপর ভিন্ন ভিন্ন সেমিনার ও লেকচারের আয়োজন করেছিল ল্যাম্প। লার্ন পর্বে উপস্থিত ছিলেন ই-এডুকেশনের বিখ্যাত বক্তা কাইতো মিওয়া। তিনি ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়েছেন, কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা যায়। অধ্যাপক সেইচিরো ইয়োনেকুরা বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, একটি জাতি কীভাবে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের মাধ্যমে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তাদের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করার জন্য ছিলেন জাপানে বসবাসরত, বার্মিজ রোহিঙ্গা অ্যাসোসিয়েশন ইন জাপানের (ব্রাজ) প্রধান, কেনিচি হাসেগাওয়া ও তাঁর মেয়ে রুরিকা।
অ্যাক্ট পর্বে কাজ করার জন্য উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের তিনটি আলাদা আলাদা দলে ভাগ করে পাঠানো হয় জাপানের বিখ্যাত তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। যে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। তারা সামাজিক সচেতনতা নিয়ে কাজ করেই নিজেদের মুনাফা অর্জন করতে চায়। প্রথম দলটি গিয়েছিল জাপানের একটি বিখ্যাত কাপড় তৈরির প্রতিষ্ঠানে, যারা তাদের পণ্যের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে জাপানের ঐতিহ্য। পুরো প্রতিষ্ঠান ঘুরে, কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দলটি বুঝতে চেষ্টা করেছে, কীভাবে ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করে তারা। দ্বিতীয় দল গিয়েছিল বোসাই গার্লস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা মিসাকি তানাকার কাছে। আর তৃতীয় দলটি গিয়েছে প্রবীণদের নিয়ে কাজ করছে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানে। সব শেষে আমরা ছোট ছোট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে আমাদের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছি।
মেক পর্বটিও অন্য সব পর্বের মতো মজার ও উপভোগ্য ছিল। এখানে উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত সব ব্লগার, আলোকচিত্রী এবং প্রামাণ্যচিত্র পরিচালকেরা। আলোকচিত্রী তারো কারিবে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, কীভাবে একটি ছোট ছবির মাধ্যমে মানুষের জীবনের নানা দিক তুলে ধরা যায়। ব্লগার হিরোকি মাতসুমোতো শিখিয়েছেন, কীভাবে ব্লগে সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে নিজের জীবিকা নির্বাহ করা যায়।
এই অসাধারণ প্রোগ্রাম শেষে ছাত্রছাত্রীরা চারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছে বলে আমার মনে হয়: দলবদ্ধ হয়ে কাজ করা, মানুষকে সহায়তা করা, অন্যের সমস্যা নিজের ভেতরে অনুভব করা এবং সঠিক উপায়ে সামাজিক সচেতনতামূলক কাজ করা।
এই শিক্ষার আলো সঙ্গে নিয়ে আমরা দেশে ফিরেছি। পরবর্তীকালে মিয়ানমার ও বাংলাদেশেও এই আয়োজন হবে।
লেখক: আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের এমবিএর শিক্ষার্থী