তোমাকে দিয়েই হবে
আমি আর প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক—দুজনই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়েছি, রাজনীতি করেছি, ছাত্র সংসদে বার্ষিকী সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছি এবং প্রকৌশল পেশা ছেড়ে পত্রিকা জগতে চলে এসেছি। গত ৩০ নভেম্বর আনিসুল হক প্রথম আলোতে তাঁর লেখায় এক মায়ের আর্তি লিখেছেন যে তাঁর ছেলেটি কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। সবাই বলছে—ওকে দিয়ে হবে না।
লেখাটি পড়তে পড়তে আমার চোখের সামনে একঝাঁক তরুণ-তরুণীর মুখ ভেসে উঠেছে, যাদের কেউ কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি। ওদের কেউ কেউ পড়েছে হয় কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কোনো কলেজে। সে কলেজটাও হয়তো ঢাকার বাইরের কোনো জেলা শহরের অলিগলির ভেতর! প্রথম আলোর তারুণ্যের জয়োৎসব, গণিত অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান জয়োৎসব, চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব—এমন কর্মকাণ্ডগুলোতে যারা সার্বক্ষণিকভাবে আমাকে সাহস জুগিয়ে যায়, তাদের বড় অংশই আনিস ভাইয়ের লেখার সেই ‘উদ্বৃত্ত’ শিক্ষার্থীদের মতো।
মনে পড়েছে জার্মানির রেইনিশ-ওয়েলভাসি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের ছাত্র বায়েজিদ বোস্তামীর কথা। খুব জনপ্রিয় নয়, এমন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে পড়ে সে পেয়েছে প্রকৌশল বিষয়ে জার্মান সরকারের দেওয়া সম্মানজনক বৃত্তি—‘দাদ মাস্টার্স স্কলারশিপ।’
সাড়ে আট লাখ এইচএসসি উত্তীর্ণের মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার শিক্ষার্থী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। বেশির ভাগই আসলে নিজের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় বা স্বপ্নের বিভাগে ভর্তি হতে পারে না। কাজেই ভর্তি নিয়ে মাথা থেকে চিন্তা ঝেড়ে ফেলো। দেশে এখন অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১ হাজার ৬০০ কলেজ আছে, কারিগরি শিক্ষার ইনস্টিটিউট আছে, নার্সিং ইনস্টিটিউট আছে, ফিজিওথেরাপির কলেজ আছে। মনস্থির করে একটিতে ঢুকে পড়ো। হয়তো তোমার শখ প্রোগ্রামিংয়ের, কিন্তু পড়তে যাচ্ছ মেডিকেলে। অনলাইনে বাংলা লেখার জনপ্রিয় সফটওয়্যার অভ্রের নির্মাতা মেহদী হাসানের কথা মনে রেখো। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় তৈরি করেছিলেন অভ্র। তারপর পড়েছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে। কিন্তু পড়ালেখা শেষ করার পর বেছে নিয়েছেন পছন্দের পেশা—কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। কাজেই তুমি কোন বিষয়ে, কোন কলেজে ভর্তি হলে, স্বপ্নপূরণের জন্য সেটি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। দরকার একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসার শক্তি।
এ তো কেবল উচ্চশিক্ষার কথা বললাম। সবাই তো আর জজ-ব্যারিস্টার হবে না। তুমি তো জানো বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীদের ৪৭ শতাংশ কোনো চাকরি পায় না। কাজেই ইচ্ছে করলে তুমি অন্য দিকেও যেতে পারো। নিতে পারো কোনো প্রশিক্ষণ। দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে এখন লাখ লাখ লোকের প্রশিক্ষণ হচ্ছে, সেখানে ভাতাও দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ নিয়ে এমনকি চলে যেতে পারো বিদেশেও। ২০২০ সালে দুবাইয়ে হবে দুবাই ফেয়ার, ২০২২ সালে কাতারে হবে বিশ্বকাপ ফুটবল। সেসব দেশে ব্যাপক তোড়জোড় চলছে, সৃষ্টি হচ্ছে লাখ লাখ কর্মসংস্থান।
এমনকি তুমি হতে পারো একজন উদ্যোক্তা। এর জন্য তোমার দরকার সাহস, চোখ–কান খোলা রাখার অভ্যাস তৈরি করা। উদ্যোক্তা হয়ে যেকোনো একটা সমস্যার সমাধান করতে পারো। এই যেমন ধরো, চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার লোক ঢাকার বাইরে থেকে এসে হাসপাতাল-ক্লিনিকে ভর্তি হয়। এদের রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাস নেই, সামর্থ্যও নেই। তাদের জন্য ‘সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যকর খাবারের’ ব্যবস্থা করতে পারো কিংবা সদরঘাটে রাত কাটানো ভাসমান লোকদের জন্য হতে পারো ‘নিরাপত্তার চাদর’। উদ্যোগের সাফল্যের জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, স্কিটি কিংবা কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারো, মূলধনের জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংক, মাইডাস কিংবা সে রকম প্রতিষ্ঠানে যেতে পারো। ছোট করে ফেসবুকে একটা দোকানও দিতে পারো।
গত বছর বাংলাদেশে এসেছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হ্যারল্ড ভারমাস। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে শুরু করলেও ভালো না লাগায় দর্শন হয়ে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথমে ডিগ্রি করেন। পরে আবার চিকিৎসাশাস্ত্রে ফিরে এসে এমন কাজ করলেন যে শেষ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কারই পেয়ে গেলেন।
স্বপ্নপূরণ একটি নিরন্তর চেষ্টা। সেটা সবার ক্ষেত্রে সোজা রাস্তায় হয় না। কাউকে কাউকে ভিন্ন পথে ঘুরে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। আবার কারও কারও মাঝপথে স্বপ্ন বদলে যায়। তখন নতুন গন্তব্যে পৌঁছানো সহজ হয়ে যায়।
কাজেই তুমি কোথায় ভর্তি হলে আর কোন বিষয়ে পড়ছ, কিংবা আদৌ কোনো ফরমাল কোর্সে ভর্তি হয়েছ কি না, সেটি মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমার কাজ হচ্ছে, তোমার স্বপ্নপূরণের চেষ্টা জিইয়ে রাখা।
এ সময় অনেকেই তোমাকে হতাশ করবে, বলবে তোমাকে দিয়ে হবে না।
তুমি শুধু তাদের সামনে গিয়ে উচ্চ স্বরে বলে আসবে—
আমি পারব। আমাকে দিয়েই হবে।
লেখক: প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি সমন্বয়কারী