পক্ষের প্রথম বক্তা
আনিকা আরেফীন
দ্বাদশ শ্রেণি, হলিক্রস কলেজ
আমরা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে অবস্থান করছি মূলত চারটি বিষয় মাথায় রেখে: কষ্ট রোধ, প্রশ্ন ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়ন, দুর্নীতি রোধ এবং কোচিং ব্যবসা বন্ধ করা। এখনকার নিয়মে একজন শিক্ষার্থীকে যখন একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ফরম তুলতে হয়, একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ২০ থেকে ২৫ হাজার বা এর বেশি টাকা খরচ হয়ে যায়। আমাদের দেশে সব শিক্ষার্থীর পক্ষে এই খরচটা বহন করা সম্ভব নয়। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে পড়ে। তা ছাড়া একজন শিক্ষার্থীকে যখন বারবার মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষা দিতে হয়, তখন সে মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যদি একটি প্রশ্ন তৈরি করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের মানোন্নয়ন হবে। ভালো শিক্ষার্থীদের নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও উন্নত হবে। আজ শিক্ষার্থীরা ফরমের জন্য যে টাকা দিচ্ছে, সেই টাকার মাত্র ৩০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব তহবিলে যায়। বাকিটা শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ–বাঁটোয়ারা হয়। এটি দুর্নীতির স্পষ্ট উদাহরণ। সব শেষে আসি কোচিং সেন্টার প্রসঙ্গে। কোচিং সেন্টারগুলো নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কোচিং ব্যবসা চালু করেছে। এই সমস্যাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতেই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত।
বিপক্ষের প্রথম বক্তা
আফিফা রহমান
একাদশ শ্রেণি, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
আজকের বিতর্কে আমাদের অবস্থান সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে। পক্ষ দলের বক্তা বলছেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একসঙ্গে প্রশ্ন তৈরি করলে প্রশ্নের মানোন্নয়ন হবে। কিন্তু সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নের ধরন কি এক? যেমন দেখুন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন হয়। অন্যদিকে বুয়েটে হয় লিখিত পরীক্ষা। এই সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে হবে? পক্ষ দলের বক্তা বললেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে কোচিং ব্যবসাটা কমবে। এখন কিন্তু মেডিকেলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে। তাতে কি কোচিং ব্যবসা কমেছে? আবার দেখুন, একজন শিক্ষার্থী ১২ বছর ধরে যে শিক্ষা অর্জন করেছে, আপনি শুধু একটি পরীক্ষা দিয়ে তার সেই দক্ষতা যাচাই করতে চাইছেন। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের হাতে দ্বিতীয় কোনো সুযোগ থাকছে না। এখনকার নিয়মে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা খারাপ হলেও শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় আরেকটি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে দুর্ঘটনাক্রমে যদি পরীক্ষা খারাপ হয়, তাহলে দ্বিতীয় আর কোনো সুযোগ থাকবে না। তা ছাড়া যদি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটা র্যাঙ্কিংয়ের মধ্যে চলে আসবে। সরকারের তো দায়িত্ব সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সমান রাখা।
পক্ষের দ্বিতীয় বক্তা
মো. আহনাফ তাহমীদ ভূঁঞা
দ্বাদশ শ্রেণি, ঢাকা কলেজ
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে প্রশ্নের ধরন কী হবে, বিপক্ষ দলের বক্তারা সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। দেখবেন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিয়েছে, এ বছর তারা বহুনির্বাচনী প্রশ্নে পরীক্ষা নিলেও সামনের বছর থেকে তারা লিখিত পরীক্ষা নেবে। অর্থাৎ প্রশ্নের ধরনে পরিবর্তন আনা সম্ভব। বিপক্ষের বক্তারা ‘দ্বিতীয় সুযোগ’–এর কথা বললেন। উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের ভিত্তিতেও তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির সুযোগ রাখা যেত। সেটা না করে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়াই হচ্ছে তাকে একটা দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমরা মনে করি, ‘কোন বিশ্ববিদ্যালয়’–এর চেয়ে ‘কোন বিষয়’-এ আমি পড়ব, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন আজ আপনি কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়তে চাচ্ছেন। কিন্তু আপনি বুয়েটে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ না পেয়ে পুরকৌশলে ভর্তি হলেন। অন্যদিকে আপনার হয়তো চুয়েট বা রুয়েটে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ ছিল। বর্তমান সমাজের মানসিকতার জন্য আপনি চাইলেও অন্য কোথাও গিয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়তে পারবেন না, বুয়েটে চান্স পেলে আপনাকে বুয়েটেই পড়তে হবে। আপনার কাছে দিন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটাই বড়। কিন্তু সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাপিয়ে নিজের আগ্রহ, নিজের পছন্দের বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
বিপক্ষের দ্বিতীয় বক্তা
সুমাইয়া খানম
দ্বাদশ শ্রেণি, বিএএফ শাহীন কলেজ
আজকের বিতর্কে আমি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে অবস্থান করছি। ধরুন, আজকে আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই। কিন্তু অসুস্থতার কারণে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। তাহলে কিন্তু আমার রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোয় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় এই সুযোগ না পেলে আমি হয়তো হতাশ হয়ে পড়ব। অতএব কষ্ট রোধের যে বিষয়টি আপনারা বলছেন, সমন্বিত পরীক্ষা হলে সেটা না কমে বেড়েও যেতে পারে। আপনারা বলছেন প্রশ্নের উন্নয়নের কথা। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা একেক রকম, নিয়মকানুন একেক রকম। যখন আমি একই প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দেব, তখন হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মান অনুযায়ী শিক্ষার্থী পাবে না। সব চেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এত বড় একটা পরীক্ষা নিয়ে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা অনুযায়ী বণ্টন করার মতো সাধ্য আমাদের আছে কি না। আপনারা যে সমস্যাগুলোর কথা বলছেন, যেমন দুর্নীতি বা কোচিংয়ের দৌরাত্ম্য, এসব সমাধানে অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এসব সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে না।
পক্ষের তৃতীয় বক্তা
ওয়াসী আজমাঈন চৌধুরী
দ্বাদশ শ্রেণি, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবার জন্যই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা একটি সুন্দর মডেল হতে পারে। শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে তিনটি দিক থেকে: খরচ কম হবে, শারীরিক ও মানসিক চাপ কমবে এবং প্রশ্নের ধরনটাও সহজ হবে। একটাই পরীক্ষা হলে আপনি নিজেকে আরও সময় দিতে পারবেন। নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে মানসিক ও শারীরিক চাপ নিতে হবে না। ভর্তি পরীক্ষার জন্য আমরা অভিভাবকদের ওপর যে আর্থিক চাপের বোঝা দিচ্ছি, এটা তো তাঁদের পাওয়ার কথা না। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে ভর্তি পরীক্ষার জন্য এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়া-আসার খরচটা বাঁচবে। বিপক্ষ দল বলছেন, প্রশ্নের ধরন বুয়েট আর শাবিপ্রবিতে আলাদা। লক্ষ করুন, প্রশ্নের ধরন আলাদা হলেও সিলেবাস কিন্তু একই। উচ্চমাধ্যমিকে আমরা যা পড়েছি, তা-ই। শাবিপ্রবি বা বুয়েট কিন্তু প্রকৌশল বিষয়ে প্রশ্ন করে না, প্রশ্ন করে উচ্চমাধ্যমিকের বইয়ের ওপর। বুয়েট এবং শাবিপ্রবির শিক্ষকেরা যদি একসঙ্গে বসে একটা প্রশ্নের ধরন তৈরি করেন, সেটা নিশ্চয়ই আরও ভালো হবে। আপনি গরিব হন বা ধনী, আপনার নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের মডেলে আমরা সবার জন্য একটা সুন্দর সুযোগ দিয়েছি। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে স্বপ্ন পূরণের জন্য সবাই একটি সমান সুযোগ পাবে।
বিপক্ষের তৃতীয় বক্তা
শাহজালাল হোসেন
দ্বাদশ শ্রেণি, নটর ডেম কলেজ
পক্ষ দল বলছে, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে কোচিং ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। খুবই শিশুসুলভ একটা যুক্তি। বর্তমানে মেডিকেলেও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু মেডিকেল নিয়ে কোচিং ব্যবসাও অব্যাহত আছে। আপনারা বলছেন মেডিকেলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার কারণে মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেটা নেই। এটাও ভুল। বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট...সব কটিতে যখন আলাদা আলাদা পরীক্ষা হয়, সবার আলাদা আলাদা অস্তিত্ব থাকে। সবাই নিজেদের চেনানো বা তাদের শিক্ষার্থীদের যে মেধা আছে—সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করে। দুর্নীতি কিন্তু যেকোনো পদ্ধতিতেই হতে পারে। দুর্নীতির জন্য কোনো একটা পদ্ধতি ভালো বা খারাপ, এটা আপনি নির্ধারণ করতে পারবেন না। বুয়েটের প্রশ্ন ফাঁসের কথা না শুনলেও মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের কথা আপনি শুনেছেন। কারণ অনেক বড় পরিসরে পরীক্ষা হয়। প্রশ্নের হাতবদলটা খুব বেশি হয়। কিন্তু বুয়েটে একটা নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থী এসে বুয়েটের নিজস্ব পরিবেশে পরীক্ষা দেয়। নিজস্ব পরিবেশে পরীক্ষা দেওয়ার কারণে প্রশ্ন ফাঁসের মতো দুর্নীতিগুলো কম হয়। বুয়েট লিখিত পরীক্ষা নেয়, শাবিপ্রবি বহুনির্বাচনী প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়, এটা তাদের নিজস্ব চাহিদা। আপনি তো তাদের নিয়মে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।
পক্ষ দলের যুক্তিখণ্ডন
বিপক্ষ দল একটা দিক ধরতে ভুল করছে। আমরা বলছি না সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা বলছি কোচিং–নির্ভর হবে না। প্রশ্নের আলাদা আলাদা ধরন থাকলে আলাদা আলাদা কোচিং করতে হয়। এখানেই সমস্যা। আপনারা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়মে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। ভুল। আমরা এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে কথা বলছি। অতএব তাদের নিয়মে হস্তক্ষেপ করার পূর্ণ অধিকার সরকারের আছে।
বিপক্ষ দলের যুক্তিখণ্ডন
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় এত বড় পরিসরে এতগুলো মানুষ পরীক্ষা দেবে, আপনি কি মনে করেন দুর্নীতির কোনো সুযোগ না দিয়ে এই পদ্ধতিটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? কোচিং ব্যবসা আমাদের দেশে একটি সামাজিক সমস্যা। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্তও কোচিং ব্যবসা আছে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আপনি কোচিং ব্যবসা বন্ধ করতে বা কমাতে পারবেন না। আপনারা বলছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের তো একটা স্বকীয়তা থাকা উচিত।