পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যারা অংশগ্রহণ করবে, স্কুলে সেদিন তাদের অডিশন চলছিল। ‘কারা গান গাইতে চাও, হাত তোলো।’ শিক্ষক বলতে না–বলতেই মাঈশা মারিয়াম আবিষ্কার করলেন, তাঁর দুই হাত ওপরে উঠে গেছে। নিজের ইচ্ছায় হাত তোলেননি তিনি, দুই পাশে বসে থাকা দুই বন্ধু নিজ দায়িত্বে মাঈশার দুই হাত তুলে দিয়েছে। কী মুশকিল! সেবারই জীবনে প্রথম মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান গেয়েছিলেন তিনি। তখন ক্লাস টুতে পড়েন। যিনি তবলা বাজাচ্ছিলেন, তিনি রাজশাহীর এক নামকরা গানের শিক্ষক। প্রশ্ন করলেন, ‘মা, তুমি কার কাছে গান শেখো?’ মাঈশা বললেন, ‘এখনো তো কারও কাছে শিখি না। বাড়িতে বাবা একটু একটু দেখিয়ে দেয়।’ তখন সেই শিক্ষক নিজেই বললেন, ‘আমার কাছে শিখবে?’ সেই থেকে তাঁর গান শেখার শুরু।
এখন মাঈশা পড়ছেন রাজশাহীর নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে। ইংরেজি বিভাগের এই শিক্ষার্থী স্বরব্যাঞ্জো নামে একটি ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। এখন আর অবশ্য তিনি ব্যান্ডটির সঙ্গে নেই। কেন? মাঈশা বললেন, ‘লেখাপড়ার জন্য ব্যান্ডের কিছু সদস্য দেশের বাইরে চলে গেল। তখন আমরা একটু ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিলাম। আমিও তখন ব্যক্তিগতভাবে মিউজিকের ক্যারিয়ারের প্রতি মন দিলাম। তাই আর এগোনো হয়নি।’ তা যে উদ্দেশ্যে ব্যান্ড ছেড়ে দেওয়া, অর্থাৎ নিজেকে এগিয়ে নেওয়া, সেটা চলছে তো? ‘হ্যা!। এখন পণ্ডিত অমরেশ রায় চৌধুরীর কাছে ক্ল্যাসিক্যাল শিখছি। তা ছাড়া গান লিখি, কম্পোজ করি। কিছুদিন আগে টম প্যাক্সটনের লেখা একটা গান অনুবাদ করেছি। সেটা স্বরব্যাঞ্জো গেয়েছে। আমি সেখানে হারমোনিকা বাজিয়েছি।’
মাঈশার আগ্রহের বিশাল একটা জায়গা জুড়ে আছে ছোট্ট এই বাদ্যযন্ত্রটি। নিজে দারুণ হারমোনিকা বাজান, পাশাপাশি অন্যদেরও শেখান তিনি। হারমোনিকা নিয়ে আগ্রহীদের জন্য একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে তাঁর। সেখানে নিয়মিত লাইভে এসে দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের হারমোনিকার ‘লেসন’ দেন তিনি। প্রায় ২ হাজার সাবস্ক্রাইবার আছে তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে। সেখানে নিয়মিত আপলোড হয় ‘টিউটোরিয়াল’।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে অনেকের খানিকটা নেতিবাচক ধারণা আছে বলে মনে হয় মাঈশার। তিনি বিশ্বাস করেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা কম মেধাবী কিংবা পিছিয়ে আছে, এমন ভাবাটা ভুল। বললেন, ‘২০১৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছিল। সারা দেশের অনেক ছেলেমেয়ে এসেছে। সেখানে একেকজন এত মেধাবী, দেখে অবাক হয়ে গিয়েছি। কেউ নাচে অসাধারণ, কেউ দুর্দান্ত গায়। আমি উপস্থিত বক্তৃতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম।’
তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া মাঈশা অবশ্য সব নেতিবাচক ধারণার থোড়াই কেয়ার করেন। স্নাতক শুরু করার পর গত তিন বছরে তিনি বেশ কয়েকটি আর্ট সামিটে অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছেন, নিবন্ধ লিখেছেন, ছোট ছোট বই অনুবাদ করেছেন, গান লিখেছেন, গান অনুবাদ করেছেন। এখন একটি প্রকল্পের আওতায় ছোটদের জন্য লেখা কিছু বই ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করছেন। এখানেই শেষ নয়। ‘একটা পাঠচক্রের রাজশাহী অঞ্চলের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করছি। দুইটা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আছি। এর মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, কনসার্ট লেগেই আছে সারা বছর,’ বলছিলেন তিনি।
বারো ভাজা নামের একটা সংগঠনের সদস্য মাঈশা। বারো ভাজা হলো রাজশাহীর একটা ঝালমুড়ি ধরনের খাবার। বারো রকমের উপকরণ দিয়ে তৈরি বলে এই নাম। জানালেন, ‘আমরাও এ রকম একটা সমাজ গড়তে চাই, যেখানে সব ধরনের মানুষ মিলেমিশে থাকবে। সমাজ সহজে যাদের গ্রহণ করতে চায় না, যেমন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, আমরা চাই তারাও পড়ালেখা করে আর সবার মতো সম্মান নিয়ে বাঁচার সুযোগ পাক।’
মাঈশা ভবিষ্যতেও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে নিয়ে কাজ করতে চান। পাশাপাশি সংগীত সাধনা চালিয়ে যেতে চান পুরোদমে। তাঁর কাছে ‘সংগীত’ একটি সর্বজনীন ভাষা। কিছুদিন আগে কলকাতা হারমোনিকা অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে ইন্ডিয়ান মাউথ অর্গান প্লেয়ার্সের একটা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। মজার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে সেখানে। শুনুন মাঈশার মুখ থেকে—
‘একটা রিসোর্টে সবার থাকার ব্যবস্থা হলো। আমার রুমমেট ছিলেন একজন প্রায় আশি বছর বয়সী বৃদ্ধা। মুম্বাইয়ের বাসিন্দা। তিনি ছিলেন ফিরোজ দামরির ছাত্রী। ফিরোজ দামরি ভারতবর্ষে প্রথম হারমোনিকা নিয়ে আসেন, সেই ব্রিটিশ আমলে। তো তিনি বাজাচ্ছিলেন বাখের জয় অব ম্যানস ডিজায়ারিং। আমি সুরটা ধরে বাজানো শুরু করলাম। তখনো জানি না কে কোন ভাষায় কথা বলি। উনি লিড করছিলেন, আমি ফলো করছিলাম। বাজানো শেষে ভাঙা ইংরেজিতে আলাপ করে বন্ধুত্ব হলো। অপরিচিত দুজন মানুষ প্রথম দর্শনেই একসঙ্গে বাজিয়ে ফেললাম, কেউ কারও ভাষা না বুঝেই। এটা শুধু সংগীতের মাধ্যমেই সম্ভব।’
এই সুরই বোধ হয় মেয়েটিকে আত্মবিশ্বাসী করে। মন দিয়ে তাঁর ছবিটা লক্ষ করুন, চেহারায় ভালো কিছু করার প্রত্যয় নিশ্চয়ই চোখে পড়বে।