প্রশান্তর মুঠোয় আরও তিন
>সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি করে দেশ ছেড়ে পালানো প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার শেয়ার কিনে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।
শুধু চার আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল নয়, প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের হাত প্রসারিত হয়েছিল পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত অন্য প্রতিষ্ঠানেও। শেয়ার কিনে রাতারাতি তিনটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। পরিচালক পদে বসান স্বজনদের। প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যালয়ও এক ভবনে, কারওয়ান বাজারের ডিএইচ টাওয়ারে নিয়ে এসেছেন তিনি।
পি কে হালদারের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া তিন প্রতিষ্ঠান হলো সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, রহমান কেমিক্যালস ও নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। এর বাইরে আজিজ ফাইবার্স জুট মিলের নিয়ন্ত্রণও এখন তাঁর হাতে, যেটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আজিজ পাইপসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনতে পি কে হালদার যে বিনিয়োগ করেছেন তার উৎস নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
পি কে হালদার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারি করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ৮ জানুয়ারি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
পি কে হালদারের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া সিমটেক্স, রহমান কেমিক্যালস ও নর্দান জুটের নামের ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস থেকে ১৭০ কোটি ঋণ নেওয়া হয়। এই ইন্টারন্যাশনাল লিজিং সেই চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একটি, যা পি কে হালদার দখল করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ওই ১৭০ কোটি টাকা ঋণের সুবিধাভোগী পি কে হালদারই।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ছাড়া পি কে হালদারের দখল করা বাকি তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।
পি কে হালদার শেয়ারবাজারে লেনদেন করতেন নিজের ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমেই। কেএইচবি সিকিউরিটিজ ও হাল ক্যাপিটাল লিমিটেডের মালিকানা তাঁর। এর বাইরে আরও অন্তত ১০টি ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা করতেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ওই ১০ প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং সিকিউরিটিজ ও আইএল ক্যাপিটাল রয়েছে। এ দুটি আবার পি কে হালদারের দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সহযোগী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শেয়ারবাজার থেকে নর্দান জুটের শেয়ার কেনেন পি কে হালদার। সেখানে চেয়ারম্যান করা হয় পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জল কুমার নন্দীকে। আর পরিচালক করা হয় পি কে হালদারের খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারীকে। কোম্পানিটির পর্ষদে পরিচালক মাত্র এ দুজনই।
পি কে হালদারের মতো অমিতাভ অধিকারীও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র। পাশাপাশি অমিতাভ অধিকারী বিসিএস ক্যাডারের (প্রশাসন) কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরি ছেড়ে তিনি পি কে হালদারের আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট ও রহমান কেমিক্যালের অংশীদার ও পরিচালক হন।
নর্দান জুটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এর কার্যালয় কারওয়ান বাজারের ডিএইচ টাওয়ারে নিয়ে আসা হয়, যা আগে মতিঝিলে ছিল। নর্দান জুটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনঙ্গ মোহন রায় গত রোববার বলেন, ‘পি কে হালদারের সঙ্গে কয়েক মাস ধরে যোগাযোগ নেই। আমি বেতনভুক্ত কর্মকর্তা। আমার কোনো শেয়ার নেই।’
অনঙ্গ মোহন রায় নর্দান জুটের পাশাপাশি আজিজ ফাইবার্স জুট মিলও দেখাশোনা করেন।
রহমান কেমিক্যালের শেয়ার কেনা হয় পি কে হালদার, অমিতাভ অধিকারী, কেএইচবি সিকিউরিটিজের এমডি রাজীব সোম, আনন্দ মোহন রায়, রতন কুমার বিশ্বাস, পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল, রেপ টাইলস ফার্ম, আর্থস্কোপ লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেডের নামে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে রহমান কেমিক্যালের নামে ৫৩ কোটি টাকা, রেপটাইল ফার্মের নামে ৬০ কোটি টাকা, আর্থস্কোপ লিমিটেডের নামে ৬০ কোটি টাকা, নিউট্রিক্যাল লিমিটেডের নামে ৭৪ কোটি টাকা ঋণ বের করা হয়। রহমান কেমিক্যালের পরিচালকও পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী।
দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজে ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান, তাঁর স্ত্রী মাহফুজা রহমান, পুত্র নিয়াজ রহমান ও ইসতিয়াক রহমানের নামে ২৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন পি কে হালদার। আবার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে সিমটেক্সকে দেওয়া হয় ৮০ কোটি টাকার ঋণ। সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজে সিদ্দিকুর রহমানের একক শেয়ার ২৫ শতাংশের বেশি।
ফরিদপুরের আজিজ ফাইবার্স জুট মিলটি একসময় শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত আজিজ পাইপসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সালে আজিজ ফাইবার্স জুট মিলটি কিনে নেন পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল ও রামপ্রসাদ রায়, যার প্রকৃত ক্রেতা পি কে হালদার। পুরো প্রতিষ্ঠানটি এখন পি কে হালদারের নিয়ন্ত্রণে। এর পরিচালকও অমিতাভ অধিকারী।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল ৫৭ কোটি টাকা ঋণ পায়, যার সুবিধাভোগী পি কে হালদার নিজেই। রেপটাইল ফার্ম, কেএইচবি সিকিউরিটিজের পাশাপাশি আজিজ ফাইবার্সেরও এমডি রাজীব সোম।
রাজীব সোম রোববার রাতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এসব প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্ত কর্মচারী। পরে কিছু শেয়ারও পেয়েছি।’
নামে-বেনামে পি কে হালদার আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন। তার মধ্যে একটি ক্লিউইস্টন ফুড অ্যান্ড অ্যাকোমোডেশন। দুদকের এজাহারে বলা হয়েছে, ক্লিউইস্টন ফুডে অমিতাভ অধিকারী, মো. জাহাঙ্গীর আলম ও তাঁর জেড এ অ্যাপারেলস লিমিটেড, আবদুল আলিম চৌধুরী, মো. সিদ্দিকুর রহমান, রতন কুমার বিশ্বাস, পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল, সিমটেক্স টেক্সটাইল, মো. আলমগীর হোসেন, পি অ্যান্ড এল অ্যাগ্রো ফার্ম, আনন কেমিক্যাল ও উইনমার্ক লিমিটেডের নামে মোট ৩১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন পি কে হালদার।
পি কে হালদারের বেনামি বিনিয়োগে জেড এ অ্যাপারেলসের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নির্বাচনে স্বাধীনতা পরিষদ গঠন করে আলোচনায় এসেছিলেন। তাঁর মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান আবার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৪৮ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে। এর মধ্যে জেড এ অ্যাপারেলস পেয়েছে ৩২ কোটি টাকা ও ডিজাইন অ্যান্ড সোর্স পেয়েছে ১৬ কোটি টাকা। যার সুবিধাভোগী পি কে হালদার বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে নানাভাবে চেষ্টা করেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তাঁর মুঠোফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়।
পি কে হালদারের দখল করা চার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীরা জমা করা অর্থ ফেরত পেতে এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
আরও পড়ুন:
৩৫০০ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট