ঢাকার মৌলভীবাজার-চকবাজারে ব্যবসার জন্য জীবনই এখন ঝুঁকিতে
>
- ঢাকার বড় পাইকারি বাজার মৌলভীবাজার ও চকবাজারে
- ঘিঞ্জি এলাকায় সরু গলি, সারাক্ষণই যানজট লেগে থাকে
- কোনো ভবনেই নেই অগ্নিনির্বাপণের ন্যূনতম ব্যবস্থা
- আতঙ্কিত মৌলভীবাজার–চকবাজারের ব্যবসায়ীরা
- ব্যবসায়ীরা আর ঝুঁকির মধ্যে থাকতে চান না
চুড়িহাট্টার চেয়েও ঘিঞ্জি আর সরু গলির ছড়াছড়ি রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার মৌলভীবাজার ও চকবাজারে। সারা দিনই যানজট লেগে থাকে। বহুতল মার্কেটগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে লাগানো। গলির মতো অধিকাংশ ভবনের সিঁড়িও অপ্রশস্ত। ঘুপচি ঘরের মতো ছোট্ট দোকানের প্রতিটি পণ্যসামগ্রীতে ঠাসা। এমন পরিবেশেই প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছেন কয়েক হাজার ব্যবসায়ী।
চকবাজারের চুড়িহাট্টায় গত বুধবার রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। সেই ঘটনার পর আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন মৌলভীবাজার ও চকবাজারের সাধারণ ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ড কিংবা ভূমিকম্প হলে পাইকারি বাজারের অবস্থা কী হবে, তা কল্পনাতীত। পেটের তাগিদে বাধ্য হয়ে ব্যবসা করলেও ঝুঁকির মধ্যে আর থাকতে চান না তাঁরা। ঝুঁকি দূর করতে সরকার শিগগিরই যথাযথ উদ্যোগ নেবে—এমনটাই প্রত্যাশা ব্যবসায়ীদের।
জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে মৌলভীবাজার, বেগমবাজার ও চকবাজারে পাইকারি বাজার গড়ে উঠেছে। পুরোনো ভবনগুলো অপরিকল্পিতভাবে হয়েছিল। অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। পার্কিং নেই। বেগমবাজারে এমন ভবনও আছে, যেখান থেকে মানুষের মরদেহ দড়ি দিয়ে নামাতে হয়। নতুন ভবনগুলোর ক্ষেত্রেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। ভবনের ভূগর্ভস্থ তলাগুলো বেআইনিভাবে দোকানপাট ভাড়া দিয়ে দিচ্ছেন মালিকেরা।’ তিনি বলেন, ঝুঁকি কমাতে হলে পাইকারি বাজারটি নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা করা দরকার।
নদীপথে যোগাযোগকে কেন্দ্র করে মৌলভীবাজার ও চকবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাইকারি ব্যবসার যাত্রা শুরু হয়েছিল মোগল আমলে। এরপর ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল পেরিয়ে এখনো মৌলভীবাজার দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসাকেন্দ্র। সময়ের ব্যবধানে চালের ব্যবসা বাবুবাজার-বাদামতলীতে, পেঁয়াজ, রসুন ও আদার ব্যবসা শ্যামবাজারে এবং ডালের ব্যবসা রহমতগঞ্জে সরে গেছে। তবে ভোজ্যতেল, চিনি, মসলা ও গুঁড়া দুধের ব্যবসা এখনো মৌলভীবাজারেই রয়েছে। নতুন করে যোগ হয়েছে প্লাস্টিক, প্রসাধনী, রংসহ বিভিন্ন পণ্য। আর চকবাজারে ইমিটেশনের গয়না, ব্যাগ, জুতা ও কাপড়ের ব্যবসায় জমজমাট। প্রতিদিনই ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য কিনতে মৌলভীবাজার ও চকবাজারে আসেন।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের সদস্যসংখ্যা প্রায় তিন হাজার। আর দোকানের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। এসব দোকানের অনেকগুলোতে দৈনিক কোটি টাকার বেশি কেনাবেচা হয়। সব মিলিয়ে কত কেনাবেচা হয়, তার সঠিক হিসাব না থাকলেও ব্যবসায়ী নেতাদের ধারণা, সংখ্যাটি শতকোটি টাকার হয়। অন্যদিকে চকবাজারকেন্দ্রিক বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, তাদের সদস্যসংখ্যা সাড়ে সাত শ। তবে সব মিলিয়ে হাজার পাঁচেক দোকান আছে চকবাজারের বিভিন্ন মার্কেটে।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বেগমবাজার দিয়ে মৌলভীবাজারে যেতেই যানজটের কবলে পড়তে হলো। সরু গলির পুরোটাই রিকশা, ভ্যান আর মোটরসাইকেলের দখলে। যদিও অন্যান্য দিনের তুলনায় গতকাল দোকানগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা ছিল কম। ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের অনেকেই চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড নিয়ে কথা বলছেন। তবে কিছু দোকানে ক্রেতা সামলাতে ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততাও দেখা গেল। প্লাস্টিক প্যাকেজিং রোল বিক্রির কিছু দোকান সারা দিন বন্ধ ছিল। কারণ, চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে ব্যবসায়ী মো. ইসমাইল নিহত হন। তিনি বাংলাদেশ প্লাস্টিক প্যাকেজিং রোল ম্যানুফ্যাকচারার্স ওনার্স অ্যান্ড ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। সমিতির সিদ্ধান্তেই দোকানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
আড়াই ঘণ্টা ধরে আল-মদিনা, তাজমহল মার্কেট, মমতাজ প্লাজাসহ বেশ কয়েকটি মার্কেট ঘুরে দেখা গেল, ২০ বর্গফুট থেকে শুরু করে ৩০০-৪০০ বর্গফুটের দোকানগুলো পণ্য দিয়ে বোঝাই। দোকানি কোনোরকমে বসলেও অনেক দোকানে ক্রেতার বসার জায়গা নেই। ঘিঞ্জি পরিবেশে সারাক্ষণই ভ্যাপসা গরম। দুই ভবনের মাঝে তিন-চার হাত ফাঁকা জায়গায়ও পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ীরা বসেছেন। কোনোরকম নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই মমতাজ প্লাজার ভূগর্ভস্থ তলায় দোকানের সারি। সেসব দোকানে যাওয়ার যে সিঁড়ি, তা দিয়ে একসঙ্গে দুজন মানুষ যেতে পারবেন না। তাজমহল মার্কেটের ভূগর্ভস্থ তলায়ও দোকান ভাড়া দিয়েছেন ভবনমালিক। অনেক ভবনের ওপরের তলাতে রয়েছে গুদাম। প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের ছোট কারখানাও আছে।
তাজমহল মার্কেটের জাহিদ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর আতঙ্কে আছি। আসলে আমরা ব্যবসায়ীরা সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকি। অগ্নিকাণ্ড বা ভূমিকম্পের মতো জরুরি অবস্থায় ভবন থেকে দ্রুত বের হতে পারব না। চাপা গলি দিয়ে দুজন মানুষ গেলেই ধাক্কা লাগে।’ তিনি বলেন, ‘ঝুঁকি থেকে মুক্তি দিতে ব্যক্তি নয়, সরকারি উদ্যোগ লাগবে। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করব। ব্যবসা পরে, আগে তো জীবন।’
কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি মৌলভীবাজার বর্তমানে প্রসাধনীর বড় বাজার। দেশি-বিদেশি আসল পণ্যের পাশাপাশি নকল শ্যাম্পু, স্নো, পাউডার, পারফিউম ইত্যাদি প্রসাধনী বিক্রি হয় দেদার। সে জন্য পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছোট কারখানা গড়ে তুলেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। সেসব কারখানায় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহারে ঝুঁকি বাড়ছে।
আরেক ব্যবসায়ী মো. রায়হান বলেন, ‘আমরা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে মৌলভীবাজারে ব্যবসা করছি। দুর্ঘটনা ঘটলে বাঁচার উপায় নাই। অবশ্যই এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। কোনো ভবনে কেউ যাতে রাসায়নিক রাখতে না পারে, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। গ্যাস সিলিন্ডারের নিরাপত্তা নিশ্চিতেও সরকারের উদ্যোগ দরকার।’
মৌলভীবাজারের মতো চকবাজারেও একই অবস্থা। মূল সড়কটি কিছুটা চওড়া হলেও মার্কেটের ভেতরের চলাচলের জন্য সরু পথ। সেই পথ আবার অনেক সময় পণ্য ফেলে আটকে রাখেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নাছের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কয়েকবার ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় অগ্নিনির্বাপণ মহড়া করেছি। কিন্তু অধিকাংশ ব্যবসায়ী কথা শোনেন না। নিয়মকানুন মানতে চান না।’
মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলা বলেন, কোনো একটি ঘটনা ঘটলে সবাই তৎপর হয়। কিন্তু ১৫ দিন পার হলেই সব ঠান্ডা হয়ে যায়। নিমতলীর ঘটনার পর ৯ বছরেও পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানো যায়নি। সমস্যার সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, নতুন ভবন অনুমোদন দিতে রাজউককে সতর্ক হতে হবে। যাতে করে আবাসিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে কেউ বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাতে না পারে। ভবন নির্মাণে নিয়মকানুন মানা হচ্ছে কি না, সেটিরও তদারকি দরকার।