সুশাসন নিশ্চিত করলেই দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব

ফজলুল হক
ফজলুল হক
>

টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করছে। সরকারের কাছে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ও প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার

প্রথম আলো: নতুন বছর, নতুন সরকার। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করছে। আপনি তো সরকারের দুই মেয়াদ দেখছেন। তৃতীয় মেয়াদে অর্থনীতির কোন কোন বিষয়ের ওপর সরকারের বেশি জোর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন?

ফজলুল হক: আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দুই মেয়াদে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হয়েছে। পণ্য রপ্তানিতে আয় বেড়েছে। তবে অর্থনীতির কয়েকটি খাতে ঘাটতি রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় ঘাটতি ছিল সুশাসন ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, যদিও এর কোনো শেষ নেই। তারপরও এটি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা দরকার।

গত এক–দেড় বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত এলোমেলো হয়ে গেছে। অর্থনীতির স্বার্থেই এই খাত ঠিকঠাক করা দরকার। কারণ, ব্যাংকিং খাত হচ্ছে অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এখানে গন্ডগোল হলে কোনো কিছুই সঠিকভাবে কাজ করে না। অন্যদিকে শেয়ারবাজার এখন পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। চীনের দুটি শেয়ারবাজারের একটি জোট বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের অংশীদার হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এটিকে চমৎকার পদক্ষেপ মনে করি। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, চীনের জোট আসার পরও আমাদের শেয়ারবাজারের মন্দাভাব কাটেনি। মন্দার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না জানি না, তবে আমাদের অর্থনীতির বর্তমান চেহারার সঙ্গে শেয়ারবাজারের চেহারা ঠিক মিলছে না। তাই সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য হলেও শেয়ারবাজারের চেহারাটা ঠিক করা জরুরি।

অন্যদিকে অবকাঠামো খাতে সরকার অনেকগুলো মেগা (বড়) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তার বাইরে কিছু কাজ জরুরি ভিত্তিতে করা দরকার। যেমন বিদ্যুতের সরবরাহ আরেকটু নিশ্চিত করা, যাতে নতুন সংযোগ দেওয়া যায়। গ্যাসের সংকট সমাধানে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আনা হচ্ছে। তবে অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে যদি এই সংকটের সমাধান করা হয়, তাহলে শিল্পকারখানা চাপে পড়বে। তাই দাম না বাড়িয়ে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, সেই পথ খুঁজতে হবে। এটি নিশ্চিত করা সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তবে নতুন সরকার নতুন উদ্যমে কাজগুলো করবে বলে ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা করবেন।

প্রথম আলো: দেশের পণ্য রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ তৈরি পোশাক খাত থেকে আসছে। খাতটির ব্যবসায়ী নেতারা প্রায়ই বলেন, অন্য প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে আছে বাংলাদেশ। খাতটির জন্য নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা কী?

ফজলুল হক: পোশাকশিল্পের জন্য সরকার যেটি করতে পারে তা হলো, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পোশাক খাতের সংযোগ ঘটানো। বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা আরও বেশি পোশাক খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারে। পাশাপাশি নতুন ব্যবস্থাটি জনপ্রিয় করতে হবে। জনগণকে আশ্বস্ত করতে হবে, বিবিএ-এমবিএ না করেও ভালো চাকরি পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রচুর বিদেশি লোক কাজ করেন আমাদের পোশাকশিল্পে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যায়। কিন্তু দেশের তরুণ-তরুণীদের দক্ষ করে বিদেশিদের জায়গায় বসানো গেলে প্রকৃত অর্থেই পোশাকশিল্পের সক্ষমতা অনেক বাড়বে। এতে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

বাংলাদেশ ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হবে। ফলে আগামী পাঁচ বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জিএসপি–সুবিধা হয়তো আমরা পাব না। তাই জিএসপি প্লাস কিংবা অন্য আঙ্গিকে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত–সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে এখন থেকেই সরকারকে চেষ্টা করতে হবে। সেই প্রক্রিয়াটা এখনই শুরু করা দরকার। তাই প্রত্যাশা থাকবে, নতুন সরকার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে কাজ করবে।

প্রথম আলো: ২০২১ সালের মধ্যে পণ্য রপ্তানি ছয় হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তার মধ্যে পোশাক রপ্তানি থাকবে পাঁচ হাজার কোটি ডলার। সেই পরিমাণ রপ্তানি সামলানোর জন্য সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারকে কী করতে হবে?

ফজলুল হক: বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকার ইতিমধ্যে কয়েকটি বড় প্রকল্প নিয়েছে। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর এবং পটুয়াখালীতে পায়রা বন্দর হচ্ছে। তবে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে পাঁচ বা সাত বা দশ বছর লাগবে। পাশাপাশি আরও কিছু কাজ করা দরকার। যেমন আমাদের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামেই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। সেই ঘাটতি পূরণ করেই বন্দরের সক্ষমতা অনেকটা বাড়ানো সম্ভব। এ জন্য খুব বেশি টাকাও লাগে না। শক্ত পদক্ষেপ নিলে এক বছরের মধ্যেই কাজগুলো শেষ করা সম্ভব। এ ছাড়া ঢাকা বিমানবন্দরে কাস্টমের ওয়্যারহাউস খুবই অগোছালো অবস্থায় আছে। এর উন্নতি করা খুব কঠিন কাজ নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করলে এসব ছোট জায়গায় উন্নতি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথম আলো: নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের (শূন্য সহিষ্ণুতা) নীতির কথা বলেছে। বিষয়টি নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী? দুর্নীতি বন্ধ করতে পারবে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ?

ফজলুল হক: নতুন সরকার ক্ষমতায় আসছে। ফলে এখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার মতো অজনপ্রিয় বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার সঠিক সময়। কারণ, তিন-চার বছর চলে গেলে সরকারকে আবার ভোটের হিসাব করতে হয়। তখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আমি মনে করি, সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব। তখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে না। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। সহজ কথা হচ্ছে, চোর ধরার চেয়ে চোর যাতে তৈরি না হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এখানেই বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। আমি প্রত্যাশা করি, সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়টি নতুন সরকার এক নম্বর অগ্রাধিকার তালিকায় রাখবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন অনেকবার। তাই সরকারের নতুন মেয়াদে সেটির বাস্তবায়ন হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

প্রথম আলো: রপ্তানি বহুমুখীকরণের জন্য অনেক বছর ধরেই কাজ হচ্ছে। তবে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। গলদ কোথায়? নতুন সরকার কী করতে পারে?

ফজলুল হক: রপ্তানি বহুমুখীকরণের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। প্রণোদনা দিয়েছে। সেগুলো খারাপ ছিল না। তাই সরকারকে দোষারোপ করা যাবে না। আমার মনে হয়, মূল ঘাটতি উদ্যোক্তাদের তরফ থেকেই ছিল। যাহোক, পণ্য রপ্তানি আয় বাড়ানো ও রপ্তানি খাতে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছানোর জন্য পণ্যের বহুমুখীকরণ দরকার। সরকার বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি একটি গবেষণা করা যেতে পারে। তারপর সে অনুযায়ী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

প্রথম আলো: সহজে ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশ এখনো তলানিতে আছে। গত বছর মাত্র এক ধাপ উন্নতি হয়েছে। সহজে ব্যবসা করার সূচকে বড় ধরনের উন্নতির জন্য নতুন কী করতে পারে? আপনার পরামর্শ কী?

ফজলুল হক: ব্যবসা সহজ না হলে আমাদের মতো দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। সহজে ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশ যখন তলানিতে থাকে, তখন বিদেশি উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হয়। এক ধাপ উন্নয়ন আসলে উন্নতি নয়। এই জায়গায় উন্নতি করতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করতে হবে। যেমন গ্যাসের সরবরাহ যদি পর্যাপ্ত থাকে, তাহলে গ্যাস–সংযোগ পাওয়া সহজ হবে। একইভাবে বিদ্যুতের সরবরাহ যদি পর্যাপ্ত থাকে, তাহলে বিদ্যুতের সংযোগ মিলবে। তখন এসব খাতে দুর্নীতি কমে যাবে। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। একসময় টিঅ্যান্ডটির লাইন নেওয়ার জন্য জুতার তলা ক্ষয় করে ফেলতে হয়েছে। এখন চাইলেই আপনি খুব সহজে টেলিফোন নিতে পারেন। টিঅ্যান্ডটি লাইন নিয়ে এখন আর দুর্নীতি নেই।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ

ফজলুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।