দেশে স্যামসাং মোবাইল ফোন ও ইলেকট্রনিক পণ্যের পরিবেশক ফেয়ার ইলেকট্রনিকস। তারা স্যামসাংয়ের স্মার্টফোন ও অন্যান্য পণ্য তৈরির জন্য একটি কারখানা করেছে। এ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আলম আল মাহবুব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশরাফুল ইসলাম।
প্রথম আলো: স্যামসাংয়ের সঙ্গে ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের ব্যবসার শুরু কীভাবে?
রুহুল আলম আল মাহবুব: স্যামসাংয়ের আগে আমরা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন নকিয়ার পরিবেশক হিসেবে কাজ করেছি। কিন্তু একসময় নকিয়ার বাজার খুব খারাপ হয়ে যায়। তখন টিকে থাকার জন্য আমাদের নতুন ব্র্যান্ড দেখতে হয়। আর তখন স্যামসাংয়েরও বাংলাদেশে ব্যবসার বাজার বড় ছিল না। এই অবস্থায় ২০১৪ সাল থেকে ফেয়ারের সঙ্গে স্যামসাং মোবাইলের চুক্তি হয়। তখন বাংলাদেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার মাত্র শুরু হয়েছে। সারা দেশে আমাদের একটি শক্তিশালী পরিবেশক নেটওয়ার্ক আগে থেকেই আছে। এ কারণে স্যামসাং নিয়ে কাজ করা আমাদের জন্য সহজ হয়েছে।
প্রথম আলো: এত কম সময়ে এতটা সাফল্য অর্জন কীভাবে সম্ভব হলো?
রুহুল আলম আল মাহবুব: স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল মোবাইলের দাম সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসা। এ ক্ষেত্রে স্যামসাং সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছে। সারা দেশে পরিবেশক নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করেছি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্যামসাং ব্র্যান্ড শপ তৈরি করা হয়েছে, যাতে গ্রাহকেরা ফোন কেনার সময় পণ্যের গুণগত মান যাচাই করতে পারে এবং প্রতারিত না হয়। স্মার্টফোনের বাজার সম্প্রসারণে এ তিনটি বিষয় মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
প্রথম আলো: স্যামসাংয়ের একটা মানসম্মত স্মার্টফোনের দাম এখন কত?
রুহুল আলম আল মাহবুব: স্যামসাংয়ের মানসম্মত একটি ফোর-জি স্মার্টফোনের দাম এখন সাড়ে ৯ হাজার টাকা। কাছাকাছি ফিচারের অন্য ব্র্যান্ডের সেটের দাম কিছুটা কম। স্যামসাং পণ্যের মান ও বিক্রয়-পরবর্তী সেবা বিবেচনায় নিলে এর দাম ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে।
প্রথম আলো: স্মার্টফোনের এ দাম কি আরেকটু কমিয়ে আনা সম্ভব?
রুহুল আলম আল মাহবুব: সরকারের নীতিসহায়তা নিয়ে বাংলাদেশে যখন পুরোপুরি মোবাইল ফোন উৎপাদন শুরু হবে, তখন মোবাইলের দাম অবশ্যই আরও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
প্রথম আলো: আপনাদের কারখানার অগ্রগতি কত দূর?
রুহুল আলম আল মাহবুব: নরসিংদীর শিবপুরে স্যামসাং ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন ও ইলেকট্রনিক পণ্যের কারখানা করছি। ইলেকট্রনিকসের মধ্যে রয়েছে ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন। এ ছাড়া টেলিভিশন, ওয়াশিং মেশিনের মতো অন্য যেসব ইলেকট্রনিক পণ্য আছে, সেগুলোও ভবিষ্যতে আমরা বানানোর চেষ্টা করব। এ কারখানায় যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ শেষ। আশা করছি ঈদের আগেই দেশে সংযোজিত স্মার্টফোন আমরা ক্রেতাদের হাতে তুলে দিতে পারব।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে ফোর-জি টেলিযোগাযোগ সেবা সম্প্রতি চালু হয়েছে। এ প্রযুক্তির স্মার্টফোনের বাজার চাহিদা কেমন?
রুহুল আলম আল মাহবুব: এখন দেশে যত মোবাইল ফোন আমদানি হয়, তার ১০ থেকে ১২ শতাংশ ফোর-জি প্রযুক্তির। কিন্তু ফোর-জি নেটওয়ার্ক এখনো সারা দেশে সেভাবে সম্প্রসারিত হয়নি। ভালো নেটওয়ার্ক যখন গ্রাহকেরা পাবেন, তখনই তাঁরা বেশি টাকা দিয়ে ফোর-জি হ্যান্ডসেট কিনতে আগ্রহী হবেন। আশা করি, মোবাইল ফোন অপারেটররা যত দ্রুত সম্ভব সেরা মানের ফোর-জি নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করবে। আমাদের কারখানায় শুধু ফোর-জি হ্যান্ডসেটই উৎপাদিত হবে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের বাজারের সার্বিক অবস্থা এখন কেমন?
রুহুল আলম আল মাহবুব: বাংলাদেশে এখন বছরে তিন কোটির বেশি মোবাইল ফোন আমদানি হয়। এখন আমরা স্বপ্ন দেখি, মোবাইল ফোন উৎপাদনের পাশাপাশি একটা সময় বাংলাদেশ থেকেই মোবাইল ফোন রপ্তানি হবে। দেশে এখন অনেক মোবাইল ব্র্যান্ড। সবাই মিলে আমরা একটি প্রযুক্তিবান্ধব শিল্প গড়ে তুলতে চাই। প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প যদি আমরা না করতে পারি, তাহলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে না।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে স্মার্টফোনের প্রবৃদ্ধি যে হারে বেড়েছে, এ বছর তেমনটা হয়নি। এমনটা হওয়ার কারণ কী?
রুহুল আলম আল মাহবুব: নেটওয়ার্ক যত ভালো হবে, মানুষ তত বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশির ভাগ গ্রাহক নেটওয়ার্কের মান নিয়ে অসন্তুষ্ট। বাজারে অনেক খারাপ মানের হ্যান্ডসেট চলে আসায় গ্রাহকেরা প্রতারিত হয়েছেন। থ্রি-জি, ফোর-জি হিসেবে তাঁরা স্মার্টফোন কিনেছেন কিন্তু আসলে তা ঠিকভাবে কাজ করেনি। নিম্নমানের নকল হ্যান্ডসেট যাতে বাজারে না আসে, এ জন্য বিটিআরসি কাজ করছে। যখন এটি বন্ধ হবে তখন হ্যান্ডসেটের বাজারে আবার সুদিন ফিরে আসবে।
প্রথম আলো: মোবাইল ফোন নিবন্ধনের একটি তথ্যভান্ডার তৈরির উদ্যোগ কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়টা এখন কোন পর্যায়ে আছে?
রুহুল আলম আল মাহবুব: বিষয়টি কিছুদিন আগেই বিটিআরসির চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। বাংলাদেশ মোবাইল ফোন আমদানিকারক সমিতি (বিএমপিআইএ) নিজস্ব উদ্যোগে মোবাইল ফোনের আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি) তথ্যভান্ডার তৈরির কাজ অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ তথ্যভান্ডার ও সার্ভার চালু করা সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করছি। এটা তৈরি হয়ে গেলে সারা দেশের গ্রাহকেরা মোবাইলে একটা খুদে বার্তার মাধ্যমে জানতে পারবেন, তাঁদের কেনা হ্যান্ডসেটটি বিটিআরসি অনুমোদিত কি না।
প্রথম আলো: আগামী বাজেটে মোবাইল ফোন সংযোজনে সারচার্জ তুলে দেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। সব মিলিয়ে মোবাইল ফোন আমদানির কর ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত?
রুহুল আলম আল মাহবুব: চলতি অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল ফোন উৎপাদনমুখী একটি নীতিমালা করা হয়েছে। তবে এখনো বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজনে ১ শতাংশ সারচার্জ রয়েছে। এ ছাড়া কিছু যন্ত্রাংশ আমদানিতে করহার এখনো অনেক বেশি। সব ধরনের যন্ত্রাংশ আমদানিতে করহার অন্তত ২ বছরের জন্য ১ শতাংশ করা উচিত। আস্তে আস্তে আমাদের এখানে যখন মোবাইল ফোন সংযোজন এবং একটি পরিপূর্ণ সরবরাহ অবস্থা দাঁড়িয়ে যাবে, তখন কর যদি বাড়ানো হয়, তখন তা গ্রাহকের জন্য তেমন অসুবিধা হবে না। সরকার যদি সংযোজন ও উৎপাদনে সারচার্জ তুলে দেয়, উৎপাদনে যেসব বাধা আছে সেগুলো দূর করে এবং এ শিল্পের জন্য কর অবকাশ সুবিধা দীর্ঘ মেয়াদে দেয়, তাহলে অবশ্যই আমরা উপকৃত হবো।
প্রথম আলো: হ্যান্ডসেট আমদানিতে করহার কেমন হওয়া উচিত?
রুহুল আলম আল মাহবুব: পর্যায়ক্রমে দেশে মোবাইল ফোন আমদানির কর বাড়াতে হবে। দেশে উৎপাদিত হ্যান্ডসেট বাজারে যত আসতে থাকবে, ততই আমদানি করা হ্যান্ডসেটের ওপর কর বাড়াতে হবে।
প্রথম আলো: অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইল ফোনের কারণে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে?
রুহুল আলম আল মাহবুব: অবৈধ পথে আসা ও ভুয়া আইএমইআই হ্যান্ডসেট যাতে চালু না হয়, সে বিষয়ে বিটিআরসি ও অপারেটরদের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, এতে শুধু ক্রেতাই প্রতারিত হচ্ছেন তা নয়, প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধও বেড়ে যাচ্ছে। নিবন্ধিত হ্যান্ডসেট দিয়ে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহজেই তা ধরতে পারবে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়, এখানে নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এ জন্য আইএমইআই নিবন্ধন ব্যক্তি ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো: ভবিষ্যতে আপনি নিজের ব্যবসাকে কোথায় নিয়ে যেতে চান?
রুহুল আলম আল মাহবুব: স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশে ভবিষ্যতে প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পকারখানা হবে। এসব কারখানায় লাখ লাখ লোক চাকরি করবে। প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প স্থাপনকে এগিয়ে নিতে আমরা নেতৃত্ব দিতে চাই। প্রযুক্তিনির্ভর ইলেকট্রনিক শিল্পে স্যামসাং এখন বিশ্বের এক নম্বর ব্র্যান্ড। এই ব্র্যান্ড আজ আমাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে এসেছে। স্যামসাংকে অনুসরণ করে অন্য ব্র্যান্ডও বাংলাদেশে এগিয়ে আসবে, তাতে এ দেশের মানুষ প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে কাজের সুযোগ পাবে।